সুজন পরিচিতি

সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক

‘‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে।” গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান, অনুচ্ছেদ: ১১।

সুজন কেন
বহু আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অমিত সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলেও, আজও জাতিগতভাবে আমাদের সুদীর্ঘকালের লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জিত হলেও, অপরাজনীতি, অপশাসন, সর্বস্তরে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন এবং সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক অনুন্নয়ন ও তাদেও প্রতি ব্যাপক বঞ্চনা আমাদেরকে বিভিন্নমূখী সংকটের আবর্তে জড়িয়ে ফেলছে।  এ অবস্থা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর তথা রাষ্ট্রকে ক্রমাগতভাবে দুর্বল কওে ফেলছে এবং জাতিকে ফেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।

সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ…”। কিন্তু জনগণ তাদের এই মালিকানা হারিয়ে ফেলেছে একদল স্বার্থান্বেষী ব্যক্তির কাছে। এ সকল ব্যক্তিরা হয়েছে প্রভু, আর জনগণ যেন তাদের আজ্ঞাবহ করুণার পাত্র। দেশের নাগরিকরাও তাঁদের মালিকানা সম্পর্কে সচেতন নয়।  আমাদের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে এবং বহু কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে অর্থবহ  করে তুলতে হলে, এ অবস্থার অবসান একান্ত জরুরি।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার গুরু দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের, অন্য কারো নয়। বস্তুত রাজনৈতিক দলই গণতন্ত্রের চালিকা শক্তি। তাই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বিরাজমান সকল সমস্যার সমাধান হতে হবে – অন্য কোন বিকল্প বা অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নয়। শাসনকার্যে অনিয়ম, কার্যকর প্রতিষ্ঠান, দুর্বল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইত্যাদি অগণতান্ত্রিক শক্তিকে উৎসাহিত এবং তাঁদের ক্ষমতা দখলের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে। দুর্বৃত্তায়িত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং মানুষের প্রতি বঞ্চনা, উগ্রবাদী শক্তির উত্থানকেও উৎসাহিত করে।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন দেশে সুস্থ, স্বচ্ছ, দায়িত্বশীল, আদর্শভিত্তিক ও জনকল্যাণমূখী রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা এবং রাজনীতিকে কালো টাকা ও পেশী শক্তির অধিকারী তথা দুর্বৃত্তদের কবল থেকে রক্ষা করা। প্রয়োজন অনিয়মতান্ত্রিকতা ও অপরাজনীতি পরিহার করে সহিষ্ণুতা ও সমঝোতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা। সর্বোপরি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৎ, যোগ্য ও আদর্শবাদী রাজনীতিকদের রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া। একইসাথে তাঁদের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা করা। পাশাপাশি যথাযথ প্রশাসনিক কাঠামো (যেমন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, স্বাধীন নির্বাচন কমিশন) গড়ে তোলা, যাতে এর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হতে পারে। আর প্রয়োজন রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে সাধারণ জনগণকে সচেতন, সংগঠিত ও সোচ্চার করা।

নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে সুশাসন প্রতিষ্ঠাই আমাদেরকে নিয়ে যেতে পারে সংবিধানের নির্দেশিত অভীষ্ঠ লক্ষ্যের দিকে। কারণ সুশাসন মানেই আইনের শাসন, সর্বস্তরে গণতন্তের চর্চা, মানবাধিকার সংরক্ষণ, সমতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সম্পদের সুষম বন্টন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ। সুশাসন মানেই ফায়দাতন্ত্র ও দলদন্ত্রের অবসান। সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হলেই সাধারণ জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং তাদের প্রতি বঞ্চনার অবসান ঘটানো সম্ভব হবে। এজন্য প্রয়োজন ক্ষমতা ও সম্পদের ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ এবং সংবিধানের ১১, ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদের আলোকে শক্তিশালী ও স্বশাসিত স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা এবং গণমূখী প্রশাসন। আরো প্রয়োজন আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যাশায় জনগণকে জাগিয়ে তোলা এবং তাঁদেরকে, বিশেষত নারী ও সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত ও সংগঠিত করা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করা।

সুশাসনের যে প্রত্যাশা আমরা লালন করছি, বিরাজমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় তা অর্জন করা সম্ভব নয়। এজন্য রাষ্ট্র তথা সমাজের সকল স্তরে প্রয়োজন একদল সচেতন নাগরিক গোষ্ঠীর সক্রিয়তা, যারা তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ও রক্ষায় সচেতন থেকে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালন করবে। একইসাথে তাঁরা সরকার, নীতি-নির্ধারক ও বিভিন্ন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। সচেতন নাগরিকদের সংগঠিত, সক্রিয় ও সোচ্চার করার এই কাজটি করার চেষ্টা করছে সুজন। কেননা বিখ্যাত মার্কিন বিচারপতি ফ্যান্সিস ফ্যঙ্কফার্টারের মত সুজনও বিশ্বাস করে, “একটি রাষ্ট্রে নাগরিকের চেয়ে  গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদ নেই”।

সুজন-এর সৃষ্টি
সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে সজ্জনের শাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করার লক্ষ্যে ২০০৩ এর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে, ২০০২ সালের ১২ নভেম্বর দেশের একদল সচেতন নাগরিকদের উদ্যোগে সিটিজেনস্ ফর ফেয়ার ইলেকশনস্ (সিএফই) নামে একটি নির্দলীয় নাগরিক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। জন্মলগ্নে সিএফইর প্রচেষ্টা ছিলো নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের তথ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য প্রার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করে তা বিতরণ করা, যাতে ভোটাররা জেনে-শুনে-বুঝে তাদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। এ লক্ষ্যে ২০০৩ ও ২০০৪ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে সংগঠনটি জনগণের সঙ্গে পরামর্শের ভিত্তিতে নিজস্ব উদ্যোগে প্রশ্নপ্রত্র তৈরি করে প্রার্থীদের তথ্য সংগ্রহ এবং ভোটারদের মাঝে তা বিতরণ করে। এ অভিজ্ঞতার আলোকে ‘ভোটারদের তথ্যভিত্তিক ক্ষমতায়নে’র আন্দোলন ও আইনী লড়াই শুরু হয়। ফলে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের তথ্য প্রদান হাইকোর্ট কর্তৃক বাধ্যতামূলক করা হয়। পরবর্তীতে স্বার্থান্বেষী মহল কর্তৃক এই রায়কে ভণ্ডুল করার লক্ষ্যে জালিয়াতির মাধ্যমে আবু সাফা নামক জনৈক ব্যক্তিকে (যাকে আদালতে হাজির করা সম্ভব হয়নি) দিয়ে আপিল করানো হলেও ‘সুজন’-এর  সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ও আইনী পদক্ষেপে সুপ্রিম কোর্টে তা প্রতিহত করা সম্ভব হয়। তথ্যপ্রাপ্তির এই অধিকার পরবর্তীতে আইনে অর্ন্তভূক্ত করা হলেও, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা বাদ রাখা হয়েছে। তবে বিষয়টি নিয়ে এডভোকেসির পাশাপাশি সুজন আইনী লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।

ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীরা যাতে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারে সে লক্ষ্যে সিএফই’র সাথে জড়িত স্বেচ্ছাব্রতীদের উদ্যোগে বিভিন্নমূখী সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোসহ প্রার্থীদেরকে এক মঞ্চে এনে ‘জনগণের মুখোমুখি’ করা হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে অনেকগুলো এলাকায় নির্বাচনোত্তর ‘জনগণের মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। একইসঙ্গে তৃণমূল থেকে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘প্রকাশ্য বাজেট অধিবেশন’ আয়োজনের জন্য ইউনিয়ন পরিষদসমূহকে উৎসাহিত করা হয়। এ ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে সচেতন ও সংগঠিত হতে থাকেন বিভিন্ন এলাকার নাগরিকবৃন্দ এবং তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সংগঠনের বিস্তার ঘটতে থাকে। মানুষের এ ধরনের সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনের লক্ষ্যে একধরনের চাহিদার সৃষ্টি করে। এমনি একটি পেক্ষাপটে রাষ্ট্র তথা সমাজের প্রতিটি স্তরে গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে ২০০৩ সালের ২১ ডিসেম্বর সিটিজেনস ফর ফেয়ার ইলেকশনস এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’।

সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভিক পর্যায়ে ২০০৩ এর ইউনিয়ন পরিষদ ও ২০০৪ এর পৌরসভা নির্বাচনের পাশাপাশি সুজন-এর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল ২০০৫ ও ২০০৬ এ অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ৫টি আসনের উপনির্বাচনে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ভোটারদের তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা।

গণতান্ত্রিক উত্তরণে সুজন-এর ভূমিকা     
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সত্যিকারার্থে কার্যকর করতে হলে শুধুমাত্র সৎ, যোগ্য ও জনকল্যণে নিবেদিত ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার প্রচেষ্টাই যথেষ্ট নয়। এর জন্য আরো প্রয়োজন নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক সংস্কার। এ লক্ষ্যে ২০০৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর একটি গোলটেবিল বৈঠকের মধ্য দিয়ে সুজন একটি রাজনৈতিক সংস্কার আন্দোলনের সূচনা করে। আন্দোলনের অংশ হিসেবে সংস্কারের একটি বিস্তারিত রূপরেখা প্রকাশ এবং গণমাধ্যমের সক্রিয় সহযোগিতায় সারাদেশে সংস্কার কর্মসূচি তথা পরিবর্তনের পক্ষে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি করা হয়। জনমতের আলোকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত ১৪ দলীয় জোট তাদের নিজস্ব সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়ন করে, যাতে সুজন-এর প্রস্তাবিত অধিকাংশ সংস্কার ভাবনা অন্তর্ভূক্ত হয়।

পরবর্তীতে সুজন-এর সংস্কার প্রস্তাবের আলোকে ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ তথা মূল নির্বাচনী আইনের সংশোধিত খসড়া প্রধান উপদেষ্টা ও আইন উপদেষ্টাসহ নির্বাচন কমিশনে পেশ করা হয়। সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল: ¡ ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়ন ¡ নির্বাচন কমিশনকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে বিযুক্ত করে স্বাধীন ও শক্তিশালীকরণ ¡ নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুন:নির্ধারণ ¡ তত্ত্বাধায়ক সরকার পদ্ধতি বিধান দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিলুপ্তকরণ ¡ সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তকরণ ¡   রাজনৈতিক দলসমূহের কাঠামোর গণতন্ত্রায়ন ও বাধ্যতামূলক নিবন্ধন ¡ রাজনৈতিক দলসমূহের আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ ¡ তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলসমূহের প্রার্থী মনোনয়ন ¡ ঋণখেলাপীদের পাশাপাশি করখেলাপী, বিলখেলাপী ও আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণার বিধান প্রবর্তন ¡ নির্বাচনী ব্যয় হ্রাসের ব্যবস্থা গ্রহণ ¡ নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে প্রার্থীদের ব্যয় মনিটরিং ও প্রার্থীগণ প্রদত্ত তথ্য যাচাইপূর্বক অসত্য তথ্য প্রদানকারী ও আচরণবিধি ভঙ্গকারী প্রার্থীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ ও প্রয়োজনে প্রার্থিতা বতিলকরণ ¡ নির্বাচনকে টাকা ও পেশীশক্তির প্রভাবমুক্তকরণ ¡ ‘না’ ভোটের বিধান প্রবর্তন ¡ নির্বাচনী বিরোধের দ্রুত নিষ্পত্তিকরণ ইত্যাদি। উল্লেখ্য যে, সম্পূর্ণরূপে না হলেও সুজন-এর অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবই নির্বাচন কমিশনের ‘সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’ এবং পরবর্তীতে নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে পাশ করা আইনে সন্নিবেশিত হয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ’-এর বিধি-বিধানসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

নিকট অতীতে ‘সুজন’-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ ছিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, উপজেলা পরিষদ নির্বাচন, পৌরসভা নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন, সকল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করা। কার্যক্রমসমূহের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল: ¡ প্রার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করে তথ্যচিত্র তৈরি এবং সৎ, যোগ্য, আদর্শবান ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীদের নির্বাচিত করার আহ্বান সম্বলিত বক্তব্যসহ ভোটারদের মাঝে তা বিতরণ ¡ তথ্যসমূহ ওয়েবসাইটে প্রকাশ ¡ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এক মঞ্চে এনে জনগণের মুখোমুখিকরণ ¡ জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করার সপক্ষে প্রার্থীদের কাছ থেকে লিখিত অঙ্গীকার গ্রহণ ¡ সজ্জনকে নির্বাচিত করার প্রত্যয়ে ভোটারদের শপথ করানো ¡ ভোটারদের উদ্বুদ্ধকরণ ইত্যাদি ছিল অন্যতম। নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলের সংস্কারের পাশাপাশি এ সকল কার্যক্রম অবাধ, নিরপেক্ষ তথা সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে তথা গণতান্ত্রিক উত্তরণে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

উপরোল্লিখিত কার্যক্রমসমূহ ছাড়া ‘সুজন’-এর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল: ¡ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে স্বশাসিত ও শক্তিশালীকরণের লক্ষ্যে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে এডভোকেসি ¡ আইন-কানুন ও অধিকার সচেতনতাসহ তরুণদের ভিতরে দেশপ্রেম জাগ্রত করার লক্ষ্যে সৃজনশীল কার্যক্রম হিসেবে ‘নির্বাচনী অলিম্পিয়াড’, ‘গণতন্ত্র অলিম্পিয়াড’ ও ‘রাজনৈতিক সংস্কার বিতর্ক’ আয়োজন ¡ বিভিন্ন ইস্যুতে জনমত সৃষ্টি ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গোলটেবিল বৈঠক, মতবিনিময় সভা, কর্মশালা, সংবাদ সম্মেলন ইত্যাদির আয়োজন ¡ জনঅংশগ্রহণ নিশ্চিত করে স্থানীয় সরকারের তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও উন্মুক্ত বাজেট অধিবেশন আয়োজনে উদ্বুদ্ধকরণ ¡ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য তাঁদেরকে নিয়মিতভাবে জনগণের মুখোমুখিকরণ ¡ মিডিয়া ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে গণমাধ্যমের সহযোগিতায় বিভিন্ন ইস্যুতে জনসচেতনতা সৃষ্টি ¡ সর্বোপরি নিজেদের অধিকার আদায়ে সারাদেশে সচেতন নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালানো ইত্যাদি। এছাড়াও সুজন ‘ওয়ার্ডসভা’র মধ্য দিয়ে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার চর্চা, স্থানীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির উপকারভোগীদের অগ্রগতির তালিকা তৈরিসহ পদ্ধতিগত, সুশৃঙ্খল, পেশাদারিত্বের সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনায় ইউনিয়ন পরিষদকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছে। একইসাথে তরুণ সমাজকে সুশাসন প্রতিষ্ঠার চলমান আন্দোলনে সম্পৃক্ত করার জন্য ‘সুজন বন্ধু’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলারও উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

সংস্কার আন্দোলনসহ ‘সুজন’ এর কার্যক্রমসমূহ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কেননা এই আন্দোলনের অন্যতম দিক ছিল যথাযথ সংস্কার সাধন সাপেক্ষে ঘোষিত ‘রোডম্যাপ’ অনুযায়ী যথাসময়ে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। ২০০৮ এ অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের গণতান্ত্রিক উত্তরণের সেই আকাঙ্খা পূরণ হলেও বর্তমানে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা প্রত্যাশী রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ লালন বা গণতন্ত্র চর্চার কোন লক্ষণ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। রাজনীতিকদের মধ্যে ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণের কোন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। ফলে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে সচেতন নাগরিক তথা জনগণ ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন।

আর একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সুজন-এর পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সংস্কার প্রস্তাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্তির প্রস্তাব করা হলেও, তার পূর্বে সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার বিষয়টি শর্ত হিসেবে যুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল হলেও উল্লিখিত প্রতিষ্ঠানসমূহ এখনও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়। বিষয়টি গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক নয়। তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ে অবিরাম পথচলার মধ্য দিয়েই আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে স্বপ্ন পূরণের দিকে।

সুজন-এর কার্যক্রম পরিচালনা
দল নিরপেক্ষতা, একতা, সততা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, সমতা এবং অসম্প্রদায়িকতা; এসকল চেতনাই সুজন-এর সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনার নীতিগত ভিত্তি। এই চেতনারই ভিত্তিতেই স্বেচ্ছাশ্রমের ব্রত নিয়ে কেন্দ্রীয়, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়া শহরঞ্চলে মহানগর, পৌরসভা, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়েও সাংগঠনিক কাঠমো গড়ে তোলা হয়। স্থানীয় পর্যায়ে ‘সুজন’ এর সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে, নিজস্ব সম্পদ ও নেতৃত্বে। সুজন-এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পৃথক একটি নীতিমালা রয়েছে।

সুজন দাতাদের অর্থে পরিচালিত এনজিও নয়। এটি একটি নির্দলীয় স্বেচ্ছাব্রতী নাগরিক উদ্যোগ। একদল সচেতন নাগরিকের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার চেতনা থেকেই এর সৃষ্টি। এই উদ্যোগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গেও নেতৃত্বে ও অর্থায়নেই এর কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

আপনার অংশগ্রহণ জরুরি
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার যে শুভ সূচনা হয়েছিল, তা নির্বিঘ্নে এগুতে পারেনি। গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে আমাদের সামনে আর একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর। গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির চর্চা করা, নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরো স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করা, সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্বশাসিত ও কার্যকর করা, সমাজে সমতা ও ন্যয়পরায়ণতা নিশ্চিত করা, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সকল স্তরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ছিল আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলায় আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি।

একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ও আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ সৃষ্টির ক্ষেত্রে আপনার মত সচেতন নাগরিকদের সক্রিয়, সোচ্চার ও ইতিবাচক ভূমিকা পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ‘ফ্রিডমও ফ্রি’ নয়। এজন্য প্রয়োজন নাগরিকের চিরন্তন সতর্কদৃষ্টি, কার্যকর ভূমিকা ও আবেদন। ‘সুজন’-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে আপনি সেই ভূমিকা ও অবদান রাখতে পারেন।

আমাদের বিশ্বাস সকলের সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে সুখী, সমৃদ্ধ ও আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।