ড. বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ০৩-০৮-২০১২
সম্প্রতি বিবিসি টেলিভিশনের ‘হার্ডটক’ অনুষ্ঠানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে বিরোধী দলের সমন্বয়ে একটি ছোট মন্ত্রিসভা নিয়োগের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া অবশ্য প্রস্তাবটি তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করে দিয়েছেন। আগামী সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনের লক্ষ্যে এই প্রাথমিক উদ্যোগের জন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীকে সাধুবাদ জানাই, যদিও একই ধরনের প্রস্তাব অতীতে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। তবে প্রস্তাবটি বিবিসির অনুষ্ঠানে প্রকাশ না করে এ নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি সংলাপের সূত্রপাত করাই বেশি যুক্তিযুক্ত হতো বলে আমরা মনে করি।
প্রস্তাবটি সম্পর্কে একটি বিষয় প্রথমেই সুস্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন—এটি সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রথাগত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। সংসদীয় গণতন্ত্রে সংসদের মেয়াদ শেষে মন্ত্রিসভা পদত্যাগের পর রাষ্ট্রপতি বিদায়ী মন্ত্রিসভাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান। তাই প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংসদীয় গণতন্ত্রের রেওয়াজের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ, ফলে এটি একটি জগাখিচুড়ি ব্যবস্থার জন্ম দেবে, যা একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সহায়ক হবে কি না তা নিয়ে অনেকের মনে সন্দেহ রয়েছে।
২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের ফলে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের তিন মাসে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা [অনুচ্ছেদ ১২৩(৩)]। অর্থাৎ যখন দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তখন নবম সংসদের সদস্যরা, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবমতো, সংসদ অধিবেশনে না বসলেও স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। বর্তমানে আমাদের সাংসদেরা, বিশেষত সরকারি দলের সাংসদেরা, ‘নব্য জমিদারে’র ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে শুরু করে স্থানীয়ভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এমনকি থানায় মামলা নেওয়া এবং চার্জশিট দেওয়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্ভর করে স্থানীয় সাংসদ বা সরকারদলীয় নেতা-কর্মীদের সবুজ সংকেতের ওপর। তাই বর্তমান সাংসদদের সদস্যপদ বহাল থাকাকালীন নির্বাচন হলে, তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারবেন। এমনকি মামলা-হামলার মাধ্যমে বিরোধীদলীয় প্রার্থীদের এলাকাছাড়াও করতে পারেন বলে অনেকের আশঙ্কা। একটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন—প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী কে হবেন? শেখ হাসিনা, না খালেদা জিয়া? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ, আমাদের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব সৃষ্টির বীজ নিহিত আছে। বস্তুত, অতীতের সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচিত সব প্রধানমন্ত্রীই আমাদের দেশে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছেন।
উল্লেখ্য, স্যার নিনিয়ানের মধ্যস্থতায় ১৯৯৪ সালে উভয় দলের সমন্বয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একমত হলেও কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সে প্রশ্নে মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারায় সে সমঝোতা প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। সে সময় খালেদা জিয়া প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে রাজি হননি। শেখ হাসিনা কি এখন তা করতে রাজি হবেন? তবে তা করতে রাজি হলেও সমস্যার সমাধান হবে কি না, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান।
গত ১৮ বছরে নদীতে অনেক জল গড়িয়েছে এবং পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছে। ১৯৯৪ সালের অচলাবস্থা যত সহজে সমাধান করা যেত, এখন অত সহজে তা করা যাবে না। কারণ, তখন প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দলবাজি ছিল না বললেই চলে। অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানও, বিশেষত উচ্চ আদালত দলবাজির ঊর্ধ্বে ছিল। ফায়দাতন্ত্র ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেনি বলে সে সময় নাগরিক সমাজও—শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, পেশাজীবী প্রমুখ—ছিল অনেকটা ঐক্যবদ্ধ এবং সম্মিলিতভাবে তাঁদের পক্ষে প্রয়োজনে দলগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব ছিল। ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাটের ইজারা সৃষ্টির অপসংস্কৃতি তখনো সৃষ্টি হয়নি। প্রধান দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিহিংসাপরায়ণতাও সৃষ্টি হয়নি। এ ছাড়া তখন সংসদের মেয়াদ শেষেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার কথা। তাই কে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হবেন, সে বিষয়ে ১৯৯৪ সালে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো গেলে আমাদের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ভিন্ন রূপ নিত বলে আমাদের ধারণা।
আমাদের নষ্ট রাজনীতির দুষ্টু ছোবলে গত ১৮ বছরে সমাজে অনেক অবক্ষয় ঘটেছে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন দলতন্ত্রের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। শিক্ষক, আইনজীবী, ডাক্তার, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী তথা নাগরিক সমাজ এখন বহুলাংশে বিভক্ত ও দুই প্রধান দলের প্রতি অনুগত। জনকল্যাণের পরিবর্তে লুটপাটের ইজারাতন্ত্র কায়েম করাই এখন ছলে-বলে-কলে-কৌশলে ক্ষমতায় যাওয়ার অন্যতম আকর্ষণ। তাই এখন প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে মতৈক্যে পৌঁছানো গেলেও, এমনকি প্রধানমন্ত্রীসহ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মন্ত্রিসভার অর্ধেক পদ বিরোধী দলকে দিলেও, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হবে বলে মনে হয় না।
আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে একটি পর্বতপ্রমাণ বাধা হলো প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে চরম দলবাজি। চারদলীয় জোট সরকারের মতো বর্তমান সরকারও স্বাভাবিকভাবেই সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই ক্ষমতাসীন দলের প্রতি সবচেয়ে অনুগত ব্যক্তিদের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ও নির্বাচনের দৃষ্টিকোণ থেকে স্পর্শকাতর পদগুলোতে বসিয়ে যাবে। পক্ষপাতদুষ্ট ও ফায়দাতন্ত্রে লিপ্ত এসব ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থেই বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা যাতে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসে, তা নিশ্চিত করবেন—এ জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর চোখের ইশারাও লাগবে না। কারণ, বিরোধী দল ক্ষমতায় গেলে এসব ব্যক্তি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাঁদের প্রাপ্ত ফায়দার তো ইতি ঘটবেই, একই সঙ্গে ডিআইজি কোহিনূর মিয়ার মতো তাঁদের অনেকে চাকরিচ্যুতও হতে পারেন। অতীতের অপকর্মের জন্য অনেককে জেলেও যেতে হতে পারে। অর্থাৎ, বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা ক্ষমতাচ্যুত হলে দলতন্ত্রে লিপ্ত ব্যক্তিরা চরম ঝুঁকির সম্মুখীন হবেন, তাই বিরোধী দলকে হেনস্থা এবং নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা উঠেপড়ে লাগবেন।
পক্ষপাতদুষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নিম্ন আদালত যে কীভাবে সরকারবিরোধীদের হেনস্থা করতে পারে, তার কিছুটা আভাস পাওয়া যায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে গাড়ি পোড়ানোর প্রশ্নবিদ্ধ অভিযোগে ঘটনার মূল হোতাদের বাদ দিয়ে সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ বিরোধী দলের ৪৬ জনের বিরুদ্ধে রকেটের গতিতে তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান, চার্জ গঠন ও দ্রুত বিচার আইনে বিচার শুরু করা থেকে। এমনকি খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বে বিরোধী দলের সম-অংশগ্রহণে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও সেই মন্ত্রিসভা এ ধরনের বিতর্কিত কার্যক্রম বন্ধ করতে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে বলে মনে হয় না। বরং দলের প্রতি আনুগত্যের কারণে নির্বাচন-সম্পর্কিত সব স্পর্শকাতর বিষয়েই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হতে পারেন, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সম্পূর্ণরূপে অকার্যকর করে ফেলতে পারে। তাই দলান্ধ কর্মকর্তাদের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল তবিয়তে অবস্থানের কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলেও বিরোধী দলকে হয়রানি অব্যাহত থাকবে বলেই অনেকের আশঙ্কা।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ ধরনের দলবাজির সমস্যা সহজে সমাধান করা সম্ভব ছিল। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তোলা সাজানো বাগান ভেঙে দিয়ে অপেক্ষাকৃত দলনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সেসব পদে বসিয়েছে। একই সঙ্গে তারা একধরনের ‘সহায়ক পরিবেশ’ সৃষ্টি করেছে, যাতে সব কর্মকর্তা নির্বাচনকালে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। নিঃসন্দেহে এটি ছিল নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একটি বড় অবদান।
সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে আরেকটি বড় জটিলতা সৃষ্টি করছে আমাদের বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অনেক বিষয়ে বিভ্রান্তিমূলক অবস্থান। উদাহরণস্বরূপ, সরকার কমিশনকে আরও শক্তিশালী করার কথা বললেও কমিশন দাবি করছে, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য তারা যথেষ্ট শক্তিশালী এবং তাদের আর ক্ষমতায়নের প্রয়োজন নেই। নির্বাচনী বিধিবিধানে নতুন কোনো সংস্কারেরও প্রয়োজন নেই। একই সঙ্গে তারা জনস্বার্থ সমুন্নত রাখতে এ পর্যন্ত কোনোরূপ দৃঢ় অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই কমিশন এখনো জনগণের আস্থা অর্জনে সাফল্য প্রদর্শন করতে পারেনি, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াতে পারে।
পরিশেষে, এটি সুস্পষ্ট যে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা থেকে সৃষ্ট সমস্যার যথার্থ সমাধান নয়। এর মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তাও কাটবে না। কারণ, ফায়দাতন্ত্রপুষ্ট ও দলবাজিতে লিপ্ত প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই বর্তমানে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে একটি বড় বাধা। আরেকটি বড় বাধা হলো সংসদের মেয়াদ শেষের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। পুনর্গঠনের পর গত ছয় মাসে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে জনগণের আস্থা অর্জনে অসফলতাও এ ক্ষেত্রে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করেছে। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবকে ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা শুরুর একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যা থেকে একটি সমাধান বেরিয়ে আসবে বলে আমরা আশা করি। তাই আমরা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসার এবং সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে একগুঁয়েমির পরিবর্তে সদিচ্ছা প্রদর্শনের আহ্বান জানাই।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
সূত্র: প্রথম আলো, ৩ আগষ্ট, ২০১২