গত ৪ মার্চ ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিকে’র উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাব-এর ভিআইপি লাউঞ্জে “আসন্ন নির্বাচনে কেমন প্রার্থী চাই” শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে ‘সুজন’ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ-এর সঞ্চালনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ‘সুজন’ কেন্দ্রিয় কমিটির সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
আসন্ন নির্বাচনে আমরা কী ধরনের প্রার্থী চাই – তা নিয়ে এখন থেকেই ভাবা শুরু করতে হবে – এই আহবান রেখে মূল প্রবন্ধে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনটা যাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ হয় এবং ডিসেম্বরের মধ্যেই হয় এটা এখন জনদাবি। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা দৃঢ়ভাবে আশা করি যে, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী ২০০৮ সালের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় ও স্থানীয় সকল পর্যায়ে প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গঠিত হবে। তবে দুর্বৃত্তদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখার লক্ষ্যে প্রার্থীদের সম্পর্কে বিস্-ারিত তথ্য ভোটারদেরকে সময়মতো দিতে হবে, যাতে তারা জেনে-শুনে-বুঝে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীর পক্ষে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে। এছাড়াও সজ্জনদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নির্বাচনী ব্যয় হ্রাস করাসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো সংস্কারের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণার দাবি আজ গণদাবিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের আন্-র্জাতিক আদালত বা ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত হওয়ার মাধ্যমে কমিশনের প্রস্-াবিত বিধান এ মুহুর্তে কিংবা অদূর ভবিষ্যতে কার্যকর হওয়ার কোন সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। এ প্রসঙ্গে তিনি ভারতীয় নির্বাচন কমিশনের উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ভারতের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কলুষমুক্ত করার লক্ষ্যে কমিশন ২০০৪ সালে তাদের ২২-দফা সংস্কার প্রস্-াবে গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আদালত কর্তৃক চার্জশীটভুক্ত হলেই নির্বাচনে অংশগ্রহণে অযোগ্য ঘোষণার সুপারিশ করে। আইনভঙ্গকারীরা যাতে আইনপ্রণেতা না হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়াও গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিদেরকে বিচারের আগেই কিংবা বিচারকালীন সময়ে কারাগারে অন্-রীণ করা গেলে, তাদেরকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা যাবে না কেন? এই প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেন, এ ধরনের বিধান প্রস্-াবিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংযোজন করে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধীদের মতো চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদেরও নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, নির্বাচন গণতন্ত্রের শোধন প্রক্রিয়ার একটা অংশ। তিনি বলেন, অভিযুক্তদের মধ্যে কারা আবার নির্বাচিত হয়ে আসবেন এ ভীতি অনেকের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু এ ভীতি রেখে নির্বাচন করব না, এটা হতে পারে না। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক দলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী আছেন। কিন্তু তাদের নির্বাচিত হয়ে আসার জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ্য করে দাবি জানিয়ে বলেন, আমাদের গণতন্ত্রায়নের পথে মানুষের সামনে এমন প্রার্থী উপস্থাপন করুন যাদেরকে সমর্থক ও অসমর্থক উভয়েই পছন্দ করতে পারেন, একইসাথে যে প্রার্থীর জন্য মানুষ গর্বিত হতে পারেন। গণতন্ত্রের জন্য যত বেশি নির্বাচন হবে ততই ভালো উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন কেবল নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব নয়, এক্ষেত্রে অন্যন্যদের পাশাপাশি সচেতন নাগরিকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
জনাব এএসএম শাহাজাহান তার বক্তব্যে বলেন, ‘কেমন প্রার্থী চাই’ এর সাথে সাথে কে চায়, কারা চায় এই বিষয়টি অত্যন্- গুরুত্বপূর্ণ। তিনি অতীতের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে বলেন, আমরা দেখেছি দুর্নীতি, দুর্বর্ত্তায়ন এবং নির্বাচন পরবর্তী আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে একটি উর্বর পরিবেশ থাকলে নির্বাচনে অংশগ্রহণে প্রার্থীরা বেশি উৎসাহিত হয়। তিনি রাজনীতিবিদদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমাদেরকে এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সততা, ত্যাগ ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করতে হবে। জনাব এম হাফিজ উদ্দিন খান আরপিও’র কথা উল্লেখ করে বলেন, আরপিওতে অনেকগুলো বিধান ছিল কিন্তু গত ৩৬ বছরে সেটা বাস্-বায়ন করা হয় নি। নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে উল্লেখ করে ইমপ্লিমেন্টেশন মেকানিজ্যম-এর প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করে তিনি আরো বলেন, বর্তমানে যে সকল সংস্কার করা হচ্ছে তা যদি বাস্-বায়িত হয় তাহলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যাবার পথ সুগম হবে। জনাব শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, জনমনে একটা সংশয় সৃষ্টি হয়েছে আদৌ নির্বাচন হবে কি না। তাই নির্বাচন সম্পর্কে জনমনের এই দ্বিধা দূর করা আবশ্যক। ‘রাজনৈতিক দল বিধিমালার’ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আরপিও’র অধীনে এই বিধিমালা না করে ভারতের মত পলিটিক্যাল পার্টিজ এক্ট করা উচিত।
সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে প্রার্থীদের তথ্য দেবার বিষয়টি নিশ্চিত করা হলে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করার ব্যাপারে এটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে উল্লেখ করেন ড. আব্দুর রাজ্জাক। জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ, সৎ ও প্রকৃত রাজনীতিবিদদের স্বীকৃতি প্রদানের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করে বলেন, তথ্য আদায় করার ব্যাপারে জোর দেয়া হলে, জনমত সৃষ্টি হলে অনেক আগাছা বাদ পড়ে যাবে। জনাব আব্দুল আলী বলেন, আমাদেরকে এমন ইতিবাচক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে যাতে সৎ ও যোগ্য লোকরা এগিয়ে আসবে এটার নিশ্চয়তা বিধান করা যায়। জনাব মোফাজ্জল করিম বলেন, কে প্রার্থী হবে তা জনগণের ওপরই নির্ভর করে। আইনে কি আছে তা সাধারণ মানুষ জানবে না। তাই এ সকল ক্ষেত্রে ‘সুজন’-এর মত প্রতিষ্ঠানের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এ্যডভোকেট রহমত আলী বলেন, জরুরি আইন প্রত্যাহারের আগে নির্বাচনে প্রার্থী চাওয়া উচিত নয়। জরুরি আইন প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের শিক্ষায় শিক্ষিত কি না ঐ রকম লোক খুঁজতে হবে। তা না হলে দেশের উন্নয়ন হবে না।
গোলটেবিল আলোচনায় অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, জনাব জি এম কাদের, জনাব শওকত আলী, জনাব সুভাষ সিংহ রায়, জনাব রেহানা সিদ্দিকী, জনাব সেকেন্দার আলী মণ্ডল, জনাব শারমিন মুরশিদ, জনাব রফিকুল ইসলাম সরকার, জনাব হান্নান আরা বেগম, ড. মেহের-ই-খোদা, জনাব এবিএম আহসান উল্লাহ, জনাব এমএন ইসলাম তপন চৌধুরী, জনাব আবু তালেব, জনাব আব্দুল লতিফ মজুমদার, জনাব মোঃ নোমান প্রমুখ। এছাড়া গোলটেবিল আলোচনায় ‘সুজন’-এর পক্ষ থেকে উত্থাপিত বিষয়সমূহের প্রতি উপস্থিত সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেন।
“আসন্ন নির্বাচনে কেমন প্রার্থী চাই” শীর্ষক ‘সুজন’-এর গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত
Categories: