মন্তব্য প্রতিবেদন
ড. বদিউল আলম মজুমদার
১৯৮৫ ও ১৯৯০ সালের পর তৃতীয়বারের মতো আজ উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার ব্যাপারে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কারণ নির্বাচন না হলে স্থানীয় সরকার গঠিত হয় না এবং এর কার্যকারিতা প্রদর্শনের প্রশ্নই আসে না।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালীকরণে, বিশেষত উপজেলা গঠনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ অর্থাৎ সাংবিধানিক নির্দেশনা অনুযায়ী, ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পর্যায়ে নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ, জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত জেলা পরিষদ এবং নগর পর্যায়ে নির্বাচিত পৌরসভা/সিটি করপোরেশন থাকা বাধ্যতামূলক। আর সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম পরিচালনা, জনশৃঙ্খলা রক্ষা, সব সরকারি সেবা বিতরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন স্থানীয় সরকারের দায়্ত্বি-কর্তব্যের অন্তর্ভূক্ত। তাই উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমে একদিকে যেমন সাংবিধানিক নির্দেশনা পালিত হবে, অন্যদিকে এর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা (যেমন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা), নাগরিকের সেবা প্রদান ও উন্নয়ন কার্যক্রম জনগণের অংশগ্রহণে ও স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার সঙ্গে পরিচালিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। নবনির্বাচিত সরকারের দিনবদলের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের জন্য যা অপরিহার্য।
দিনবদলের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হওয়া আবশ্যক, একই সঙ্গে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানো এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠাও জরুরি। জনগণ প্রতিনিয়ত যে সকল সমস্যার সম্মুখীন- যেমন, নিম্নমানের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পয়ঃনিষ্কাশন, কর্মসংস্থান, যাতায়াত ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, অধিকারহীনতা ইত্যাদি বিষয় মূলত স্থানীয় এবং এগুলো সমাধানও করতে হবে স্থানীয়ভাবে আর তা সম্ভব স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে কার্যকর করার মাধ্যমেই। যেমন, উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনের হাল বর্তমানে অত্যন্ত নাজুক- ইউএনও ছাড়া অনেক কর্মকর্তা এখন উপজেলায় অবস্থানই করেন না। নির্বাচিত উপজেলা সৃষ্টির মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসনে প্রাণ ফিরিয়ে আনা এবং জনগণের প্রাপ্য সেবাগুলো আরো কার্যকরভাবে প্রদান করা সম্ভব হবে। এছাড়াও কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যয় করা অর্থে সামান্য অংশই তৃণমলের জনগণের কাছে পৌঁছায়। এ সমস্যার যথাযথভাবে বিহিত করা সম্ভব উপজেলার মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার মাধ্যমে। উপরন্তু, কেন্দ্রীয়ভাবে গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচির (যেমন এডিপি) বাস্তবায়ন উল্লেখযোগ্য হারে বাড়াতে হলে উপজেলা পরিষদসহ অন্যান্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাছে (একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে) সম্পদ হস্তান্তরের কোনো বিকল্প নেই।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও গভীরতা অর্জন করবে এবং এর ভিত আরো মজবুত হবে। বস্তুত, নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সংসদভিত্তিক গণতান্ত্রিক উপরিকাঠামোর খুঁটিস্বরূপ। আর সংসদসর্বস্ব খুঁটিহীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই মুখথুবড়ে পড়েছে গত ১১ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখে। আর সুশাসনের জন্য প্রয়োজন সরকার পরিচালনায় জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ এবং সব সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা অর্জন, যা নিশ্চিত করা সম্ভব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই।
উপজেলা পরিষদ গঠনের মাধ্যমে যে সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলো তা বাস্তবে রূপায়িত করতে হলে সরকারকে এখন দ্রুততার সঙ্গে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। প্রথমেই একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে সম্পদ, দায়-দায়্ত্বি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিতে হবে। একইসঙ্গে এগুলোকে আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ অপসারণের মাধ্যমে স্বশাসিত করতে হবে। সর্বোপরি, এগুলোকে মাননীয় সংসদ সদস্যদের খবরদার্ত্বিমুক্ত করতে হবে। আমাদের সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংসদ সদস্যদের দায়্ত্বি আইন প্রণয়ন। তাই স্থানীয় উন্নয়ন কাজে তাদের সম্পৃক্ত করলে একদিকে যেমন সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হবে তেমনিভাবে উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে এবং অতীতের মতো সংসদ সদস্যদের দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফলে বর্তমান সরকারের দিনবদলের স্বপ্নই অপর্ণই থেকে যাবে। আমরা আশা করি, সরকার সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে।
লেখক : সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
তথ্য সূত্র: সমকাল, ২২ জানুয়ারি ২০০৯
উন্মোচিত হলো বিরাট সম্ভাবনার দ্বার
Categories: