সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ড. বদিউল আলম মজুমদার,লেখালেখি উপজেলা পরিষদ: আত্মঘাতী উদ্যোগ থেকে বিরত থাকতে হবে

উপজেলা পরিষদ: আত্মঘাতী উদ্যোগ থেকে বিরত থাকতে হবে


বদিউল আলম মজুমদার
গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, উপজেলা পরিষদে আমাদের মাননীয় সাংসদেরা কর্তৃত্ব ফিরে পাচ্ছেন। স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৮ সালে পাস করা উপজেলা আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী, ?গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫-এর অধীন একক আঞ্চলিক এলাকা হইতে নির্বাচিত সংসদ-সদস্য পরিষদের উপদেষ্টা হইবেন এবং পরিষদ উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ করিবে।? উপজেলা পরিষদের ওপর সাংসদদের এ ধরনের কিংবা কোনো ধরনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবে অনাকাঙ্ক্ষিত, এমনকি আত্মঘাতী।
আমাদের সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সাংসদদের ?আইনপ্রণয়নের ক্ষমতা? প্রদান করা হয়েছে। নীতিনির্ধারণী বিষয়ে সংসদীয় বিতর্কে অংশগ্রহণ, আইনপ্রণয়ন ও সংশোধন এবং পার্লামেন্টারি স্ট্যান্ডিং কমিটির মাধ্যমে প্রশাসনের স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ (যা ?ওভারসাইট? ভূমিকা বলে পরিচিত) আইনপ্রণয়ন কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ্য, সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যে প্রতিষ্ঠানকে সাংবিধানিকভাবে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সে প্রতিষ্ঠানের শুধু সে দায়িত্বই পালন করার কথা।
সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ?আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।? প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্যক্রম পরিচালনা, জনশৃঙ্খলা রক্ষা, সব সরকারি সেবা বিতরণ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন স্থানীয় সরকারের দায়িত্ব-কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ আমাদের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালনা (যেমন জনশৃঙ্খলা রক্ষা), নাগরিকের সেবা প্রদান ও উন্নয়ন সম্পর্কিত প্রায় সব কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ার কথা। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এর ব্যত্যয় ঘটলে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। তাই স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে অকার্যকর করা হলে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর ওপরই আঘাত হানা হবে।
আধুনিক রাষ্ট্র তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত−নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা ও বিচার বিভাগ। রাষ্ট্রের এ তিনটি ?অর্গান? বা অঙ্গ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল হলেও এগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করে, যাতে ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ?চেকস অ্যান্ড ব্যালান্স? বা ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হয় এবং কোনো অঙ্গের বাড়াবাড়ির কারণে নাগরিকের অধিকার খর্ব না হয়। ?ক্ষমতা বিভাজনের এ নীতি? (principles of separation of power) অনুযায়ী, আইন সভার সদস্যরা ?এক্সিকিউটিভ? বা নির্বাহী কাজে অংশ নিতে পারেন না। কিনতু স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো নির্বাহী কাজে নিয়োজিত। তাই আমাদের মাননীয় সাংসদদের স্থানীয় উন্নয়নকাজে জড়িত হওয়ার ফলে ক্ষমতা বিভাজনের নীতি নগ্নভাবে লঙ্ঘিত হবে।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে দুর্বল না করে বরং গতিশীল ও শক্তিশালী করার পেছনে আরও অনেক অকাট্য যুক্তি রয়েছে। স্থানীয় সরকার গঠনের উদ্দেশ্য হলো, ?স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্থানীয় সমস্যার সমাধান।? [কুদরত-ই-এলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ (৪৪ডিএলআর(এডি)(১৯৯২)] মানুষ প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয়−যেমন, নিম্নমানের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, পয়োনিষ্কাশন, কর্মসংস্থান, যাতায়াতব্যবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন, অধিকারহীনতা ইত্যাদি−সেগুলো মূলত স্থানীয় এবং এগুলোর সমাধানও কার্যকর করতে হয় স্থানীয়ভাবেই। তাই স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে কার্যকর করা ব্যতীত জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভব নয়। স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাঁদের নেতৃত্ব কাজে লাগিয়ে যৌতুক, বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, পরিবেশ সংরক্ষণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন, জন্ননিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি দুরূহ সমস্যা সামাজিক আন্দোলন ও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার মাধ্যমে ক্ষেত্রবিশেষে বিনা খরচেই স্থানীয়ভাবে সমাধান করতে পারেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যয় করা অর্থের সামান্য অংশই তৃণমূলের সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছায়, যা সাধারণ মানুষের দারিদ্র্যের একটি বড় কারণ। আর সাধারণ মানুষের কাছে সেবা ও সম্পদ পৌঁছানোর সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হলো স্থানীয় সরকারব্যবস্থা। উপরনতু কেন্দ্রীয়ভাবে গৃহীত উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের (যেমন এডিপি) হার ত্বরান্বিত করতে হলে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সম্পদ হস্তান্তরের কোনো বিকল্প নেই।
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, একটি বলিষ্ঠ বিকেন্দ্রীকরণ কর্মসূচির অধীনে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে গতিশীল ও কার্যকর করা হলে আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের চেহারা বদলে যাবে এবং বর্তমান সরকারের দিন বদলের স্বপ্ন সত্যিকার অর্থেই বাস্তবে রূপায়িত হবে। এ দেশের সাধারণ মানুষ বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। এখন তাদের পক্ষে শ্রম ও গায়ের ঘাম দিয়ে নিজের ভাগ্য পরিবর্তন ও দেশের উন্নয়ন করাও সম্ভব। সাধারণ মানুষের প্রতি এমন বিশ্বাস আমাদের অভিজ্ঞতাপ্রসূত। এ জন্য অবশ্য প্রয়োজন হবে তাদের উজ্জীবিত, সংগঠিত ও ক্ষমতায়িত করা এবং একই সঙ্গে তাদের ন্যায্য অধিকার হিসেবে প্রাপ্য সুযোগ প্রদান করা।
স্থানীয় সরকারব্যবস্থা শক্তিশালী করার মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও গভীরতা অর্জন করবে এবং এর ভিত আরও মজবুত হবে। বস্তুত, নির্বাচিত স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলো সংসদভিত্তিক গণতান্ত্রিক উপরিকাঠামোর খুঁটিস্বরূপ। আর সংসদসর্বস্ব খুঁটিহীন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য, যার পরিণতিই গত ১১ জানুয়ারি, ২০০৭-এর পটপরিবর্তন।
সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যও কার্যকর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা অপরিহার্য। সুশাসনের জন্য প্রয়োজন, যেসব সিদ্ধান্ত জনগণের জীবন প্রভাবিত করে সেগুলো গ্রহণে তাদের কার্যকর অংশগ্রহণ এবং সব জনগুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ। জনগণের দোরগোড়ার সরকার হিসেবে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই তাদের যথার্থ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। আর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার চর্চাও কার্যকরভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব তৃণমূল পর্যায় থেকেই। তাই গণতন্ত্রকে সুসংহত এবং সুশাসন কায়েম করতে হলে একটি জন-অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দায়বদ্ধ স্থানীয় সরকারব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই।
মাননীয় সাংসদদের স্থানীয় উন্নয়নকাজে সম্পৃক্ত হওয়ার অতীত অভিজ্ঞতাও আমাদের জন্য সুখকর নয়। গত সরকারের আমলে এ ধরনের সম্পৃক্ততার ফলে সরকারদলীয় সাংসদেরা তাঁদের দলীয় ব্যক্তিদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে একধরনের ?এমপি সরকার? বা ?এমপি রাজ? গড়ে তোলেন। এ ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা শুধু ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানেই পরিণত করেনি, একই সঙ্গে বিরাজমান প্রশাসনিক কাঠামোকেও বহুলাংশে অকার্যকর করে ফেলে। বস্তুত, এর মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে মাননীয় সংসদ সদস্যদের একধরনের জমিদারিত্ব সৃষ্টি হয় এবং সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। গত জোট সরকারের প্রথম দিকে এ ব্যাপারে আমরা সোচ্চার ভূমিকা রাখলেও নীতিনির্ধারকেরা এ ব্যাপারে কর্ণপাত করেনি। স্থানীয় উন্নয়নকাজে জড়িত হওয়ার ফলে মাননীয় সাংসদেরা যে দুর্নামের ভাগিদার হন তার মাশুল দিতে হয়েছে তাদের সম্প্রতি সমাপ্ত সংসদ নির্বাচনে।
আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভবিষ্যতে আরও সুসংহত করতে হলে তৃণমূল থেকে আমাদের একদল যোগ্য ও নিষ্ঠাবান নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে হবে। আর তা সম্ভব একটি ক্রিয়াশীল স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে। গণতন্ত্রকে কার্যকর করতে হলে আরও প্রয়োজন হবে আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের গুণগত মানে পরিবর্তন। তাঁদের স্থানীয় উন্নয়ন ও স্থানীয়ভাবে প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের সুযোগের অবসান ঘটানোর মাধ্যমেই তা করা সম্ভব। তাহলেই যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা, যাঁরা শুধু আইনপ্রণয়নের দায়িত্ব পালনে আগ্রহী, ভবিষ্যতে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। এর মাধ্যমে যেকোনো মূল্যে এমপি হওয়ার আকর্ষণও দূর হবে। রাজনীতি ব্যবসায়ে পরিণত হবে না এবং সংসদ ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে।
আরেকটি বাস্তব কারণেও সাংসদদের স্থানীয় উন্নয়নকাজ থেকে দূরে রাখা আবশ্যক। সাংসদেরা তাঁদের এখতিয়ারবহির্ভূত কাজে জড়িত হলে উপজেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাঁদের দ্বন্দ্ব অনিবার্য। এমন দ্বন্দ্ব সরকার ও সরকারবিরোধীদের মধ্যেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকবে না, ক্ষমতাসীন দলেও অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে। ফলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হবে, যা দিন বদলের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। মুখের পরিবর্তে নাক দিয়ে খেলে যেমন খাবার নাকতালুতে উঠবে, তেমনি স্থানীয় উন্নয়নের কাজে সাংসদেরা জড়িত হলেও দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী।
স্থানীয় সরকার কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত না করে সাংসদদের স্থানীয় উন্নয়নকাজে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে একটি বিকল্প প্রস্তাবের কথা কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়। প্রস্তাবটি হলো প্রতি সাংসদকে এক-দুই কোটি টাকা স্থানীয় উন্নয়নকাজে ব্যয় করার জন্য বরাদ্দ প্রদান করা। ভারতে লোকসভার প্রত্যেক সদস্যকে বছরে দুই কোটি টাকা প্রদানের ?এমপিএলএডি? (Members of Parliament Local Area Development) বলে একটি স্কিম চালু আছে। দুর্ভাগ্যবশত, ভারতীয় এ স্কিমের কার্যকারিতা সম্পর্কে অনেক গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। যেমন, ভারতীয় লোকসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান এরা সেজ্যুইয়ানের মতে, ?অল্প করে বলতে গেলে, এ স্কিমের ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত বিশৃঙ্খল…ধারণাগত দিক থেকেই এতে মৌলিক গলদ রয়েছে। সাধারণভাবে সাংসদদের দায়িত্ব আইনপ্রণয়ন এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ… এমপিএলএডি স্কিম সাংসদদের ভূমিকাতেই পরিবর্তন ঘটিয়েছে… তাঁদের প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং প্রকল্প সম্পন্নকরণের কাজে জড়িত করেছে। এ প্রক্রিয়ায় সাংসদেরা জেনেশুনেই প্রশাসনিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছেন এবং তাঁরা লোকসভার সদস্য এবং সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসেবে এ স্কিমের অধীনে তাঁদের নিজেদের এবং সহকর্মীদের উদ্যোগে গৃহীত কার্যক্রম সম্পর্কিত ব্যয়ের সঠিকতা, প্রজ্ঞা ও কৃচ্ছ্রতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার যোগ্যতা ও নৈতিক অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন… স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে গত ৫০ বছরের সরকারের ব্যর্থতাকে সংখ্যা এবং বৈচিত্র্যের দিক থেকে ম্লান করে দিয়েছে এমপিএলএডি স্কিমের অধীনে সৃষ্ট মাত্র গত সাত বছরের অনিয়ম… এ স্কিম সম্পর্কে সরকারের দায়িত্ব এড়ানো এবং প্রশাসনে সাংসদদের সম্পৃক্ততা সংসদের কাছে নির্বাহী বিভাগের দায়বদ্ধতাকে খর্ব করেছে এবং এভাবে রাষ্ট্রে সংসদীয় ব্যবস্থার কার্যকারিতাকেই দুর্বল করে তুলেছে।? (ফ্রন্টলাইন, ১৫ মার্চ ২০০২) সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ভিপি সিংসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় এ স্কিমের প্রবল বিরোধিতা করেন।
অনেকের মতে, এ স্কিম ভারতীয় সংবিধানের ওপর একটি ?নগ্ন হামলা?। এটি ব্যবহার করা হয়েছে সাংসদদের স্থানীয় উন্নয়নকাজ থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে ?উৎকোচ? হিসেবে। এমনকি ভারতীয় সংবিধান পর্যালোচনা কমিটিও এটি বিলুপ্তির পক্ষে সুপারিশ করেছে। এ স্কিমের বিরুদ্ধে বর্তমানে ভারতে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
সাংসদদের স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত করার পক্ষে অবশ্য একটি যুক্তি হলো যে, তাঁরা স্থানীয় উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হয়ে এসেছেন এবং জনগণ তাঁদের কাছ থেকে রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রত্যাশা করে। নির্বাচনের মাধ্যমে সর্বস্তরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অঙ্গীকার প্রদানের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ভিত্তিতে কাজ করতে হবে। সাংসদদের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো যদি গুরুত্বপূর্ণ ও জনকল্যাণমূলক হয়, তাহলে সেগুলো পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত এবং বাস্তবায়িত হতে পারে। সাংসদ হিসেবে তাঁরা সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের জন্য বরাদ্দ বাড়িয়ে দিলেই এগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া সাংসদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, কোনো বিশেষ এলাকার জন্য বিশেষ বরাদ্দ প্রদান হবে ন্যায়পরায়ণতার নীতির পরিপন্থী। অন্যদিকে সংসদ যথাযথ নীতি নির্ধারণ করলে এবং সম্পদের জোগান দিলে সব এলাকায়ই সুষম উন্নয়ন সাধিত হবে। উপরনতু, সংসদ নির্বাচনের মূল ইস্যু দলীয় নির্বাচনী ইশতেহার, স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়ন নয়। স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত হয়েও যে নির্বাচনে জেতা যায় না, তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে সাম্প্রতিক জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। উল্লেখ্য, তাঁদের মেয়াদকালে স্থানীয় উন্নয়নে জড়িত হওয়া সত্ত্বেও অষ্টম সংসদের অধিকাংশ চারদলীয় জোটের সাংসদ নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।
প্রসংগত, স্থানীয় উন্নয়নে সাংসদদের যুক্ত করার পক্ষে যুক্তি হিসেবে আমেরিকার ?পোর্ক ব্যারেল? (pork-barrel) স্কিমের উদাহরণ দেওয়া হয়। এ স্কিমের মাধ্যমে সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের নির্বাচনী এলাকায় আইনগতভাবে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এগুলো আইনপ্রণেতার নামে বরাদ্দ হয় না এবং তাঁরা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে কোনোরূপ হস্তক্ষেপও করেন না।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, সাংসদদের স্থানীয় উন্নয়নকাজে জড়িত করা হবে আমাদের সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন এবং এর মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। আরও হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ও রাজনীতিতে নতুন সংস্কৃতি গড়ে তোলার বর্তমানের সর্বজনীন আকাঙ্ক্ষার এবং এ লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসামঞ্জস্যপূর্ণ। উপরনতু, এর মাধ্যমে এলাকায় এলাকায় একটি দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হবে এবং মাননীয় সাংসদদের অন্যায় ও অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। এ ধরনের উদ্যোগের ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সুসংহত ও শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করানোর প্রচেষ্টাও ব্যাহত হবে। সর্বোপরি, বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও স্বশাসিত করার মাধ্যমে আগামী পাঁচ বছরে তৃণমূল পর্যায়ের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার যে সম্ভাবনার দ্বার উন্নোচিত হয়েছে তাও রুদ্ধ হবে। ফলে নবনির্বাচিত সরকারের দিন বদলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দেবে, যা হবে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আশা করি, বর্তমান সরকার ও তাদের দল এ দেশের জনগণের স্বার্থে মাননীয় সাংসদদের স্থানীয় উন্নয়নের কাজে জড়িত করার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকবে। এ ধরনের সিদ্ধান্ত আপাতদৃষ্টিতে ?এক্সপেডিয়েন্ট? বা সুবিধাজনক হলেও, এটি হবে সংবিধান-পরিপন্থী, অনৈতিক, এমনকি আত্মঘাতী। আমরা আশা করি, আমাদের নীতিনির্ধারকেরা ক্ষুদ্র স্বার্থের পরিবর্তে সিদ্ধান্তের সঠিকতা ও নৈতিকতার প্রতি দৃষ্টি দেবেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন−সুশাসনের জন্য নাগরিক।
তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ২৪ জানুয়ারি ২০০৯

Related Post

মেয়র-কাউন্সিলর হওয়ার যোগ্যতামেয়র-কাউন্সিলর হওয়ার যোগ্যতা

ড. ব দি উ ল আ ল ম ম জু ম দা র নির্বাচন কমিশন ৪টি সিটি কর্পোরেশন ও ৯টি পৌরসভার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে। দুর্ভাগ্যবশত জাতীয় পর্যায়ের মতো আমাদের

দুর্নীতি প্রতিরোধে ‘হুইসেলব্লোয়ার’ আইনদুর্নীতি প্রতিরোধে ‘হুইসেলব্লোয়ার’ আইন

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ২৪-০৮-২০১২ ২০১১ সালের জুন মাসে ‘হুইসেলব্লোয়ার’ (whistleblower) বা জনস্বার্থ-সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ (সুরক্ষা প্রদান) আইন, ২০১১ জাতীয় সংসদে পাস হয়। আইনটির উদ্দেশ্য হলো, জনস্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে

উভয় সংকটে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাউভয় সংকটে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা

বদিউল আলম মজুমদার সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী সম্প্রতি ‘সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতা রক্ষা কমিটি’ নামে একটি সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। বেশ কয়েকজন সম্পাদক ও সাংবাদিক প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কমিটির উদ্দেশ্য হলো সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও