কলুষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে উত্তরণের উপায়
বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ০৫-০৫-২০১২
ব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময় অনেকের মনে স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল যে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন জাতির জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট সৃষ্টি করবে। ফলে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে একটি উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দেশে কায়েম হবে। রাজনীতি হয়ে উঠবে জনকল্যাণের অন্যতম বাহন। সমাজে ন্যায়বিচার ও সবার জন্য সমসুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশে সুশাসন কায়েম হবে।
কিন্তু অতীতের দিকে ফিরে তাকালে আজ মনে হয় যেন গত ২২ বছর জাতির জন্য ছিল দুঃস্বপ্ন। এ সময়ে গণতন্ত্রের নামে দেশে একধরনের নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র কায়েম হয়ে গিয়েছে। পরিবারতন্ত্র আমাদের ওপর জেঁকে বসেছে। রাজনীতি হয়ে পড়েছে কলুষিত এবং ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থসিদ্ধির শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন। সুশাসন হয়ে পড়েছে সুদূরপরাহত। বস্তুত, জনগণ আজ বিরাজমান অপরাজনীতির কাছে বহুলাংশে জিম্মি। নিঃসন্দেহে এ অবস্থা জাতির জন্য সৃষ্টি করেছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
‘রাজনীতি’ সম্পর্কে ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গিই আমাদের বিরাজমান নষ্ট রাজনীতির অন্যতম কারণ বলে আমরা মনে করি। রাজনীতি ও শঠতা যেন আমাদের দেশে আজ সমার্থক হয়ে পড়েছে। জনগণের চোখে ধুলা দেওয়া ও প্রতারণাই রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে। লক্ষণীয় যে বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজের ব্যাপারে বক্তব্য দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমরা অনেক বিষয়ে রাজনীতি করি, কিন্তু এ ব্যাপারে তা করার কোনো সুযোগ নেই।’ (সমকাল, ২৭ এপ্রিল ২০১২)।
তবে বাস্তবে ইলিয়াস আলীর রহস্যজনক নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজটিই চলছে লাগামহীনভাবে। বিষয়টি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, ইলিয়াস আলীকে বিরোধী দলের নেত্রীই লুকিয়ে রেখেছেন। অপরদিকে বিরোধী দলের নেত্রী এ জন্য সরকারকেই দায়ী করেছেন। একজন প্রতিমন্ত্রী এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ইলিয়াস আলীর স্ত্রী জানেন, কে তাঁর স্বামীকে ‘খুন’ করেছে—তিনিই প্রথম গুমের পরিবর্তে ইলিয়াস আলীর খুনের কথা বলেছেন। এ ধরনের দায়িত্বহীনতার কারণেই বহুলাংশে আমাদের রাজনীতি আজ কলুষিত হয়ে পড়েছে এবং দেশে রাজনীতির নামে অপরাজনীতির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে।
সত্যিকারার্থে রাজনীতি হলো নীতি-কাঠামো প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি, যা সরকার পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। রাজনীতির সঙ্গে ক্ষমতা ও সামাজিক সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমেই সর্বোৎকৃষ্ট নীতি-কাঠামো প্রণয়ন করা যায় এবং তা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়। তাই রাজনীতিকে অনেক সময় ‘আর্ট অব কম্প্রোমাইজ’ বা সমঝোতা সৃষ্টির কৌশল বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ কারণে রাজনীতিকে ‘আর্ট অব পসিবিলিটিজ’ বা সম্ভাবনা সৃষ্টির কৌশলও বলা হয়।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়ই সিদ্ধান্ত গৃহীত ও রাষ্ট্র পরিচালিত হয়। আর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ভিত্তিই হলো পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময় ও সমঝোতা; জেদাজেদি কিংবা সংঘাত নয়। আর এ জন্যই জাতীয় সংসদ, যেখানে নীতি-নির্ধারণী বিষয়ে বিতর্ক ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে—রাজপথে যা সম্ভব নয়। তাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে হলে সংসদকেন্দ্রিক নিয়মতান্ত্রিক ও দায়িত্বশীল রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই।
অন্যভাবে বলতে গেলে, যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কোনো ভূমিকা থাকে না, সে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গৃহীত হয় না। এ ধরনের চর্চা অপরাজনীতিরই সমতুল্য। এটিকে ‘বিরাজনৈতিকীকরণ’ প্রক্রিয়াও বলা যায়।
দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে বৈরিতা ও হানাহানির অপরাজনীতিই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির স্থান দখল করে নিয়েছে। এ কারণেই আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো হরতালের মতো ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির বাইরে আসতে পারে না। কারণ, নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের প্রতি ক্ষমতাসীনেরা কর্ণপাতই করেন না।
যদিও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক দল অপরিহার্য, কিন্তু আমাদের দেশে যথাযথ রাজনৈতিক দল নেই বললেই চলে। আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি ও পারিবারিক সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে মূলত ব্যবসায়িক ‘সিন্ডিকেটের’ মতোই কাজ করে। এসব প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের জন্য বিনিয়োগে আগ্রহী ব্যবসায়ী এবং পরিবার ও পরিবারের বাইরের ঘনিষ্ঠজনদের একত্র করে এবং নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাটতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়। এভাবে মূল রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিকে অপরাধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত করে ফেলেছে।
এ ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো জাতিকে বিভক্ত করে ফেলেছে, যদিও রাজনৈতিক দলগুলোর তাদের নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচির মাধ্যমে সাধারণত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা। কিন্তু আমাদের দলগুলো ‘পার্সোনালিটি কাল্ট’ তৈরি করে বিভিন্ন স্লোগান ও ‘সিম্বলিজম’ বা প্রতীকের মাধ্যমে দেশে এক ভয়াবহ সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রুতে পরিণত করে ফেলেছে। প্রসঙ্গত, স্বাধীনতা অর্জনকালে আমরা ছিলাম একটি একতাবদ্ধ জাতি, স্বার্থসংশ্লিষ্ট অপরাজনীতির কারণে যা আজ চরমভাবে বিভক্ত, যদিও আমাদের মধ্যে গুরুতর জাতিগত পার্থক্য ও বিভেদ নেই। বলা বাহুল্য, বিভক্ত জাতি বেশি দূর এগোতে পারে না এবং আমরাও ১৯৭১ সালে আমাদের মতো অবস্থানে থাকা দেশগুলোর (যেমন—দক্ষিণ কোরিয়া) মতো সামনে এগোতে পারিনি।
রাজনীতি সম্পর্কে এমন ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম কারণ হলো রাজনীতিতে মেধাশূন্যতা। আর গত কয়েক দশকের তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির নামে রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের ‘ব্যবহার করার’ অপসংস্কৃতির কারণেই বহুলাংশে রাজনীতিতে আজ মেধার বড় আকাল পড়েছে। অভিজ্ঞতা থেকেও তরুণ রাজনীতিবিদেরা সত্যিকারের রাজনীতি শিখতে পারেননি। কারণ, স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই আমাদের দেশে রাজনীতি বিকৃত রূপ নিয়েছে। তাই আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উদাহরণ আমাদের দেশে খুব কমই সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া আমাদের রাজনীতিতে ‘গ্রেসামস ল’ কাজ করছে—দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ ও কালোটাকার মালিকেরা সৎ ও সত্যিকারের রাজনীতিবিদদের মাঠছাড়া করছে। সংসদ সদস্য হিসেবে সোহেল তাজের সাম্প্রতিক পদত্যাগ যার এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এ ছাড়া অবাঞ্ছিতরা মেধাবীদের রাজনীতিতে প্রবেশে একধরনের ‘এন্ট্রি ব্যারিয়ার’ বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।
রাজনীতির এমন বেহাল অবস্থার কারণে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও বিকৃত রূপ ধারণ করেছে। আমরা এখন নির্বাচনসর্বস্ব একধরনের ‘এক দিনের গণতন্ত্র’ চর্চা করছি, যেখানে আইনের শাসন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহি তথা সুশাসন বহুলাংশে অনপুস্থিত। ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ ‘ইজারাতন্ত্রে’ রূপ নিয়েছে। আর পাঁচ বছর পর পর ইজারা লাভের আশায়ই ছলে-বলে-কলে-কৌশলে নির্বাচনে জেতার জন্য রাজনৈতিক দলের আপ্রাণ চেষ্টা। এ চেষ্টার পরিণতিই নির্বাচনে টাকার খেলা ও রাজনীতিকে ব্যবসায়ে পরিণত করা, যা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে তৈরি করেছে পর্বতপ্রমাণ বাধা।
যদিও গণতন্ত্রের জন্য সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক, আমাদের দেশে তা করা হয় না। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা উপেক্ষা করে আমাদের রাজনীতিবিদেরা এমপি-মন্ত্রী হওয়ার তথা সংসদ নির্বাচনকেই প্রাধান্য দেন এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে এড়িয়ে যান। এমন ব্যবস্থা শূন্যে ঝুলন্ত ফানুসতুল্য একধরনের ব্যবস্থা সৃষ্টি করে। এ ধরনের ‘খুঁটিহীন’ গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপও লাভ করে না।
রাজনীতিতে মেধাশূন্যতার কারণে গণতন্ত্র যে একটি ‘রুল বেইজড সিস্টেম’ বা নিয়মভিত্তিক পদ্ধতি, তা আমাদের রাজনীতিবিদদের অনেকের ধারণার মধ্যেই নেই। নিয়ম ছাড়া যেমন ফুটবল-ক্রিকেট খেলা হয় না, নিয়ম-নীতি ও বিধিবিধান ছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও কার্যকর হয় না। সংবিধান, আইন, আদালতের নির্দেশ ইত্যাদি গণতন্ত্রকে কার্যকর করার জন্য অপরিহার্য বিধিবিধান। এ ছাড়া গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চাও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য অতি প্রয়োজনীয়। আর গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা হলে দলতন্ত্র ও ফায়দাতন্ত্রেরও কোনো অবকাশ নেই।
এটি সুস্পষ্ট যে বিরাজমান রুগ্ণ রাজনীতির কারণে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজ বহুলাংশে অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তবু হাল ছাড়লে চলবে না। রাজনীতিকে কলুষমুক্ত এবং রাজনৈতিক দলকে স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও জনকল্যাণমুখী করার প্রচেষ্টায় আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। তাই হা-হুতাশের পরিবর্তে কলুষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে নাগরিকের সক্রিয়তাই আজ জরুরি।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
সূত্র: প্রথম আলো, ৫ মে ২০১২