সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ড. বদিউল আলম মজুমদার,সংবাদপত্রে সুজন গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ

গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ

jugantor_logo
বদিউল আলম মজুমদার
উপজেলা পরিষদ নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, আমি মনে করি তা অনাকাঙিক্ষত ও অপ্রয়োজনীয়। আমাদের সংবিধান সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে কার কী দায়িত্ব। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদে নির্ধারিত করা আছে সংসদ সদস্যদের কার্যপরিধি। তাদের ‘আইন প্রণয়নে’র ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। আইন প্রণয়ন মানে আইন পাস করা; পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধন করা, নীতিনির্ধারণী বিষয়ে বিতর্ক অনুষ্ঠান, সর্বোপরি সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মাধ্যমে মন্ত্রণালয় ও প্রশাসনে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।

পক্ষান্তরে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে ‘স্থানীয় শাসনে’র দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সংবিধান স্থানীয় শাসন বলতে যা বুঝিয়েছে তা হল, প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্যপরিচালনা, জনশৃংখলা রক্ষা, সব জনকল্যাণমূলক সেবা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। সংবিধান স্থানীয় বিষয়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিয়েছে স্থানীয় সরকারের ওপর। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। সংবিধানে যাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, জনগণের পক্ষে তারা শুধু সেই দায়িত্ব পালন করবেন। সংবিধান অনুযায়ী আইন প্রণয়নের ক্ষমতাপ্রাপ্ত সংসদ সদস্যরা যদি স্থানীয় বিষয়ে জড়িত হন, যে বিষয়গুলো স্থানীয় সরকারের এখতিয়ারভুক্ত, তাহলে তা হবে সংবিধানের লংঘন। এ ছাড়াও সার্বভৌম সংসদ সংবিধানকে উপেক্ষা করে আইন প্রণয়ন করতে পারে না। তাই উপজেলা পরিষদ আইনটিতে সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের ওপর কর্তৃত্ব দেয়ায় সংবিধান লংঘিত হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে এটা একটি ‘রঙিন আইন’ (কালারেব্‌ল লেজিসলেশন)। রঙিন আইন বলতে বোঝায়- যা প্রত্যক্ষভাবে করা যায় না, তা পরোক্ষভাবে করার জন্য আইনি বিধান করা। সংসদ সদস্যরা উপজেলা পরিচালনার ক্ষমতাপ্রাপ্ত নন। তাই আইন করে তাদের পরোক্ষভাবে উপজেলা পরিষদের কর্তৃত্ব দিলে সেটা রঙিন আইন না হয়ে পারে না।
আরেকটি কারণেও উপজেলা পরিষদ আইনটি সংবিধানের পরিপন্থী। আইনে বলা হয়েছে, একক নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের উপদেষ্টা করা হবে এবং পরিষদের জন্য উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ বাধ্যতামূলক নয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, শুধু ৩০০ জন সংসদ সদস্য উপজেলা পরিষদের ওপর কর্তৃত্ব পেয়েছেন। তাহলে সংরক্ষিত আসনের ৪৫ জন সংসদ সদস্যের ক্ষেত্রে কী হবে? এটা বৈষম্যমূলক এবং সংবিধানের সমঅধিকারের বিধানের পরিপন্থী।
মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা যে স্থানীয় বিষয়ে কোন হস্তক্ষেপ করতে পারেন না, তা আদালতের রায়েও ইতিমধ্যে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। ২০০৩ সালে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু জেলা মন্ত্রী করার বিধানকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি রিট করেন। ২০০৬ সালে সেই মামলার রায়ে বিচারপতি খায়রুল হক ও বিচারপতি ফজলে কবির সুস্পষ্টভাবে বলেন, মন্ত্রী কিংবা সংসদ সদস্যদের স্থানীয় বিষয়ে জড়িত হওয়ার কোন এখতিয়ার নেই। রায়ে আরও বলা হয়, সংসদ সদস্যদের সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত কার্যক্রমগুলোতে জড়িত হওয়ার কোন এখতিয়ার নেই। আদালত আরও বলেন, মামলার বাদী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু একজন সংসদ সদস্য। তার পিরোজপুর জেলায় কোন দায়দায়িত্ব নেই।
উপজেলা পরিষদ আইনে আরেকটি অনাকাঙিক্ষত জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান বা যে কোন সদস্যকে প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতা প্রদান করতে পারবে। কিন্তু নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানরা ইতিমধ্যেই প্রধান নির্বাহী হিসেবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। আইনে এ বিষয়ের মাধ্যমে অহেতুক একটা জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এ নিয়ে পরবর্তীতে বড় ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
উপজেলা পরিষদ আইনটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। গণতন্ত্রের মূল কথাই হল- কর্তৃত্ব যেখানে, দায়বদ্ধতাও সেখানে। আইনের মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের ওপর কর্তৃত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যক্রমের জন্য নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সদস্যরাই দায়বদ্ধ থাকবেন। এ বৈপরীত্য গণতন্ত্রের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আশা করি প্রধানমন্ত্রী, সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী এবং স্থানীয় সরকারবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিসহ সংশ্লিষ্ট সবাই আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির দ্রুত নিষপত্তি করবেন। কারণ স্থানীয় সরকার শক্তিশালী না হলে বিকেন্দ্রায়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত হবে। বাধাগ্রস্ত হবে আমাদের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি। তাছাড়া সংবিধান না মানলে আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠিত হবে না।
বদিউল আলম মজুমদার : মহাসচিব, সুজন

তথ্য সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৮ এপ্রিল ২০০৯

Related Post

শৃঙখলিত দুদক রেখে কী লাভ?শৃঙখলিত দুদক রেখে কী লাভ?

বদিউল আলম মজুমদার দিনবদলের সনদের অঙ্গীকারের ভিত্তিতে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে। দিনবদলের সনদে ২৩টি অঙ্গীকার অন্তর্ভূক্ত, যার মধ্যে পাঁচটি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে চিহিৃত করা হয়েছে। সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে

প্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণ, মন্ত্রণালয়ের সংকোচন ও পুনর্গঠনপ্রয়োজন বিকেন্দ্রীকরণ, মন্ত্রণালয়ের সংকোচন ও পুনর্গঠন

বদিউল আলম মজুমদার প্রয়োজন যোগাযোগ খাতসহ অনেক ক্ষেত্রে ব্যাপক বিকেন্দ্রীকরণ, উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত মন্ত্রণালয়গুলোর কার্যক্রম সংকোচন এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করে এসব কাজের দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকরণ। আর নির্বাচিত জেলা