সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ তথা সুষ্ঠু হয়নি। অসংগতি ও অনিয়মে ভরা এই নির্বাচন কখনই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই এখনই আমাদের সোচ্চার হতে হবে নির্বাচন পদ্ধতি ও নির্বাচন কমিশনের ব্যাপক সংস্কারে ব্যাপারে। আজ ২৫ মে ২০১৫ সকাল ১১.০০টায়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন: কেমন জনপ্রতিনিধি পেলাম’ শীর্ষক সুজনÑসুশাসনের জন্য নাগরিক-এর পক্ষ থেকে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সুজন নেৃতৃবৃন্দ এ আহ্বান জানান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সহ-সম্পাদক জনাব জাকির হোসেন ও সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে প্রার্থীদের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, “এই নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে প্রত্যাশা ছিল যে, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, অর্থবহ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বিরাজমান অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে একটি স্বস্তিময় পরিবেশে ফিরে আসতে আমরা সক্ষম হবো। বস্তুত সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সহিংসতাপূর্ণ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা মানুষকে আশাবাদী করেছিল। কিন্তু যেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো তা আশাবাদী মানুষগুলোকে হতাশ করার পাশাপাশি জন্ম দিলো অনেক বিতর্কের। সুজন অন্যান্য পর্যবেক্ষক সংস্থার মত নির্বাচনের দিন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে না। তাই নির্বাচন সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি সুজনের পক্ষ থেকে। তবে আমরা জানি যে, সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সংস্থা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশসহ বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য তুলে ধরেছে। প্রবন্ধে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্র“প, টিআইবি, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন, জাতিসংঘ, অধিকার, প্রথম আলো প্রভৃতি সংস্থার প্রতিবেদনের সার সংক্ষেপ তুলে ধরা হয়েছে।”
প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি বলেন, “ঢাকা উত্তরের নবনির্বাচিত মেয়রের শিক্ষাগত যোগ্যতা øাতকোত্তর। নবনির্বাচিত ৬৫.৭১% (২৩ জন) সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরই স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে)। নবনির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের ২৫% (৩জন) স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে) হলেও ৩৩.৩৩% (৪জন) øাতক বা øাতকোত্তর। ঢাকা দক্ষিণের নবনির্বাচিত মেয়রের শিক্ষাগত যোগ্যতা øাতক। নবনির্বাচিত সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৮.৬০% (২২ জন) স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে)। নবনির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের অধিকাংশই (৫৫.৫৬% বা ১০ জন) স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে)। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়রের শিক্ষাগত যোগ্যতা øাতক। নবনির্বাচিত সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৪.১৫% (১৪ জন) স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে)। নবনির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের ২৩.০৮% (৩ জন) স্বল্পশিক্ষিত (এসএসসির নীচে) হলেও ৩৫.৭১% (৫ জন) øাতক বা øাতকোত্তর।”
প্রার্থীদের পেশা সম্পর্কে তিনি বলেন, “ঢাকা উত্তর সিটি কপোরেশনের নব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৬৮.৭৫% ব্যবসায়ী। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কপোরেশনের নব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৮০.২৬% (৬১ জন) ব্যবসায়ী। চট্টগ্রাম সিটি কপোরেশনের নব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৭৫% (৪২ জন) ব্যবসায়ী। অর্থাৎ ৩টি সিটি কপোরেশনের নব নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৭৫.৫৫% (১৩৬%) ব্যবসায়ী। তিন জন মেয়রের সকলেই (১০০%) ব্যবসায়ী।”
প্রার্থীদের মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, “ঢাকা উত্তরের নবনির্বাচিত মেয়র এবং সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই এবং অতীতেও ছিল না। সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে বর্তমানে ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে এবং অতীতে ১১ জনের বিরুদ্ধে ছিল। ঢাকা দক্ষিণের নবনির্বাচিত মেয়রের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা থাকলেও বর্তমানে নেই। সংরক্ষিত আসনের শুধুমাত্র একজন কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে। সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে বর্তমানে ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে এবং অতীতে ১৩ জনের বিরুদ্ধে ছিল। চট্টগ্রামের নবনির্বাচিত মেয়রের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে এবং অতীতেও ছিল। এর মধ্যে ৩০২ ধারার মামলাও অতীতে ছিল। সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের মধ্যে ২ জনের বিরুদ্ধে বর্তমানে মামলা আছে, ৩ জনের বিরুদ্ধে অতীতে মামলা ছিল এবং ২ জনের বিরুদ্ধে বর্তমান ও অতীতে আছে ও ছিল। সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের মধ্যে বর্তমানে ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা আছে এবং অতীতে ২১ জনের বিরুদ্ধে ছিল। ”
দিলীপ কুমার সরকার প্রার্থীদের আয় সম্পর্কে বলেন, “ঢাকা উত্তরের নবনির্বাচিত ৪৮ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ১৯ জন (৩৯.৫৮%) বছরে ৫ লক্ষ টাকার নিচে আয় করেন, ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা আয় করেন ৩ জন (৬.২৫%) এবং ১ কোটি টাকার উপর আয় করেন ২ জন (৪.১৬%)। ঢাকা দক্ষিণের নবনির্বাচিত ৭৬ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ৩৭ জন (৪৮.৬৮%) বছরে ৫ লক্ষ টাকার নিচে আয় করেন, ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা আয় করেন ১ জন (১.৩১%) এবং ১ কোটি টাকার উপর আয় করেন ৩ জন (৩.৯৪%)। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত ৫৬ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ২৩ জন (৪১.০৭%) বছরে ৫ লক্ষ টাকার নিচে আয় করেন, ৫০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকা আয় করেন ২ জন (৩.৫৭%) এবং ১ কোটি টাকার উপর আয় করেন ১ জন (১.৭৮%)।”
প্রার্থীদের সম্পদ সম্পর্কে তিনি বলেন, “ঢাকা উত্তরের ৪৮ জন নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৫৬.২৫% (২৭ জন) সম্পদ ২৫ লক্ষ টাকার নিচে এবং ১৬.৬৬% (৮ জন) কোটিপতি। ঢাকা উত্তরের ৭৬ জন নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৬৪.৪৭% (৪৯ জন) সম্পদ ২৫ লক্ষ টাকার নিচে এবং ১০.৫২% (৮ জন) কোটিপতি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৫৬ জন নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৭৩.২১% (৪১ জন) সম্পদ ২৫ লক্ষ টাকার নিচে এবং ৭.১৪% (৪ জন) কোটিপতি।”
প্রার্থীদের ঋণ সম্পর্কে তিনি বলেন, “ঢাকা উত্তরের ৪৮ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ঋণ গ্রহীতা মাত্র ১০.৪১% (৫ জন)। ঢাকা দক্ষিণের ৭৬ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ঋণ গ্রহীতা মাত্র ১৩.১৫% (১০ জন)। চট্টগ্রামের ৫৬ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ঋণ গ্রহীতা মাত্র ৮.৯২% (৫ জন)।”
প্রার্থীদের কর প্রদান সম্পর্কে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, “ঢাকা উত্তরের নবনির্বাচিত ৪৮ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৩৬ জন কর প্রদান করেন। ঢাকা দক্ষিণের নবনির্বাচিত ৭৬ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৫০ জন কর প্রদান করেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত ৫৬ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৫১ জন কর প্রদান করেন। অর্থাৎ তিনটি সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত ১৮০ জন জনপ্রতিনিধির মধ্যে ৭৬.১১% (১৩৭ জন) কর প্রদান করেন।”
প্রবন্ধে আরো বলা হয়, “সুজন মনে করে, বিধ্বস্ত একটি নির্বাচন ব্যবস্থাকে পরিশুদ্ধ করে সঠিক পথে আনা, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা এবং নির্বাচনী আইনের সংস্কার ছিল জাতিগতভাবে আমাদের বড় অর্জন। নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা, নিরপেক্ষতার অভাব এবং নির্বাচনী আইন ও বিধি-বিধান প্রয়োগে নমনীয়তা এবং কোথাও কোথাও পক্ষপাতদুষ্টতা সেই অর্জনকে আমরা বিসর্জন দিতে বসেছি; যা আমাদের কাম্য ছিল না। এখনই যদি আমরা যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ না করি, তবে আমাদের নির্বাচন পদ্ধতি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।”
তাই অনতিবিলম্বে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিুবর্ণিত পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করা জরুরি:
ক্স সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের কমিশনারদের নিয়োগের জন্য আইন প্রণয়ন।
ক্স আইনে সার্চ কমিটি গঠনের বিধান রাখা এবং আইনানুযায়ী স্বচ্ছতার সঙ্গে সৎ, দক্ষ ও সাহসী ব্যক্তিদের নির্বাচন কমিশনে নিয়োগদান।
ক্স সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনী আইনকে আরও শক্তিশালী করা।
ক্স প্রার্থী প্রদত্ত তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া চালু করা এবং অসত্য তথ্য প্রদানকারীদের মনোনয়ন বাতিলের বিধান কঠোরভাবে প্রয়োগ করা এবং তাদের ফৌজদারি আইনের বিধান অনুযায়ী শাস্তি প্রদান করা।
ক্স ভবিষ্যতে আইনী বিধি-বিধানসমূহ কঠোরতার সাথে প্রয়োগ করা।
ক্স ওয়েবসাইটে সঠিকভাবে তথ্য সন্নিবেশনে সতর্কতা অবলম্বন করা এবং এই নির্বাচনের মত দ্রুততার সাথে ওয়েবসাইটে তথ্য সন্নিবেশনের ধারাটি অব্যাহত রাখা।
ক্স হলফনামা ফরমে কিছু পরিবর্তন এনে সময়োপযোগী করা।
ক্স চলমান পদ্ধতির পাশাপাশি মনোনয়নপত্র দাখিলে ইলেকট্রনিক পদ্ধতি প্রবর্তন করা।
ক্স প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগে পোস্টার ও প্রার্থীদের তথ্যচিত্র প্রকাশসহ প্রার্থীদের নিয়ে প্রজেকশন মিটিং-এর আয়োজন করা।
ক্স ভোট গ্রহণে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমাদের আজকের এই সংবাদ সম্মেলন অতীতের কাজেরই ধারাবাহিকতা। আমরা সকল নির্বাচনেই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও বিজয়ীগণের তথ্যে বিশ্লেষণ গণমাধ্যমের সহযোগিতায় তুলে ধরেছি। তিনি আরো বলেন, প্রার্থী কর্তৃক প্রদত্ত হলফনামা নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কলুষমুক্ত করার জন্য একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। হলফ করে মিথ্যা তথ্য প্রদান করা দণ্ডণীয় অপরাধ। নির্বাচন কমিশন যদি হরফনামা যাচাই-বাছাই করে তবে অনেক বসন্তের কোকিল নির্বাচন অঙ্গণ থেকে বিতাড়িত হবে। দুনীতিবাজদেরকেও নির্বাচন থেকে দূরে রাখা সম্ভব। একই সাথে হলফনামায় সঠিক তথ্য প্রদান করাটা যদি নিশ্চিত করা যায় তাহলে আমাদের নির্বাচনী অঙ্গনকে পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব।”
জনাব জাকির হোসেন বলেন, আমরা দেখেছি যে, এ নির্বাচনে নির্বাচনী প্রচারণা, ব্যয়সীমা প্রভৃতি ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম হয়েছে। নির্বাচনী আইন ও বিধি-বিধান কার্যকরা করা গেলে এসকল অনিয়ম দূর করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী আইন কার্যকরে উদ্যোগী হতে হবে। তিনি গণমাধ্যমকে অন্যান্য যে কোন নির্বাচনের চেয়ে এ নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, আমাদের নাগরিকদেরও এসকল অনিয়ম প্রতিরোধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করতে হবে।
‘ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন: কেমন জনপ্রতিনিধি পেলাম’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

Categories: