বদিউল আলম মজুমদার
একজন ব্যতিক্রমী মানুষের সঙ্গে কথা হলো সেদিন। প্রবীর দেবনাথ। শুনলাম তিনি এক কাজে ঢাকায় এসেছেন। তাঁর কথা আগেও শুনেছি। তিনি জীবিকার জন্য ছোটখাটো ব্যবসা করেন, আর সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করেন। এ বিষয়ে জানার আগ্রহ ছিল আমার অনেক দিনের। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি ২ অক্টোবর, ২০১৩। কথা বলি অনেকক্ষণ। বুঝতে পারি, প্রবীর দেবনাথের মতো এত বড় মাপের মানুষ দেশে খুব কমই আছে। দক্ষ, যোগ্য ও জনদরদি মানুষ নির্বাচিত করার জন্য তিনি সবাইকে সচেতন করার কাজ করেন। দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত বা ঋণখেলাপিদের কেউ যেন ভোট না দেয়, সে কথা তিনি প্রচার করে চলেছেন। নিজের লেখা প্রচারপত্র বিলি করছেন। যে দেশে ভোট মানে টাকার খেলা, সেখানে এমন উঁচুমানের দায়িত্বশীল ব্যক্তি কজন আছেন আমাদের সমাজে?
আমেরিকার রাষ্ট্রপতিদের একজন টমাস জেফারসন, প্রায় আড়াই শ বছর আগে বলেছিলেন, দ্য প্রাইস অব ফ্রিডম ইজ এটারনাল ভিজিল্যান্স, অর্থাৎ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সদা সতর্ক থাকতে হয়—নাগরিকের সার্বক্ষণিক পাহারাদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। অন্যভাবে বলতে গেলে, ইভেন ফ্রিডম ইজ নট ফ্রি বা বিনা ত্যাগে স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না। বস্তুত, যে জাতি অতন্দ্রপ্রহরীর ভূমিকা পালনে যত বেশি উদ্গ্রীব, নিষ্ঠাবান ও সক্রিয়, স্বাধীনতা তাদের জন্য তত বেশি অর্থবহ, তত বেশি তারা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, স্বাধীনতার মূল্য দিতে হয় সাধারণত দুবার। একবার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য, অনেক ক্ষেত্রে চরম আত্মত্যাগের বিনিময়ে। আরেকবার মূল্য দিতে হয় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য, নাগরিকের অতন্দ্রপ্রহরী তথা সর্বদা সতর্ক ভূমিকা পালনের মাধ্যমে।
স্বাধীনতা অর্জন ও এর সত্যিকারের সুফল ভোগ করতে হলে উভয় ধরনের মূল্যই দিতে হয়। কারণ, ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলেই নাগরিকদের কাছে আপনাআপনি তার সুফল পৌঁছায় না। এর জন্য তাদের সজাগ ভূমিকা অপরিহার্য। বস্তুত, যে সমাজে যত বেশি মানুষ, সর্বস্তরের মানুষ এমন ভূমিকা পালন করে, সে সমাজ তত বেশি উন্নত, সমৃদ্ধ তথা বাসযোগ্য।
প্রতি সমাজেই সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি দেখা যায়, যাঁরা সমাজ উন্নয়নের ব্রত নিয়ে সময়-শ্রম দেন, এমনকি অর্থও বিনিয়োগ করেন। আমাদের সিলেটেরপ্রবীর দেবনাথ এমনই এক ব্যক্তি, যিনি সারা জীবন নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়েছেন। এলাকার মানুষের
উন্নয়নের জন্য নিজেকে নিবেদিত করেছেন। আমাদের ঘুণে ধরা সমাজের পঙ্কিলতা দূরীকরণের লক্ষ্যে অতন্দ্রপ্রহরীর ভূমিকা পালন করে আসছেন। নিজের ব্যক্তিগত সুখ-সমৃদ্ধি উপেক্ষা করেই শিল্পীপ্রতিভা কাজে লাগিয়ে তা করছেন।
পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সিলেটের দক্ষিণ সুরমা এলাকার লালাবাজারের দক্ষিণে খোরসনা খালপাড় গ্রামের এক অসচ্ছল পরিবারে প্রবীর দেবনাথের জন্ম। তিন ভাই ও বাবা-মা নিয়ে ছিল তাঁদের পরিবার। কিন্তু শৈশবেই মাকে হারান তিনি। বাবা ছিলেন অসুস্থ ও গৃহাবদ্ধ। যতটুকু বিষয়-সম্পত্তি ছিল, বাবার চিকিৎসা এবং পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তখন বিক্রি করে দিতে হয়। এ অবস্থায় পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে প্রবীর দেবনাথকে সংসারের হাল ধরতে হয়। তিনি তাঁর দুই ভাইকে নিয়ে অন্যের বাড়িতে কাজকর্ম করে এবং তাদের গরু-ছাগল রেখে সংসার চালান। তাই লেখাপড়ার দিক থেকে প্রাইমারি স্কুলের সীমানা তাঁর পক্ষে ডিঙানো সম্ভবপর হয়নি।
লেখাপড়ার সুযোগ না পেলেও প্রবীর দেবনাথ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে পরিবারে সচ্ছলতা আনেন। তিনি রাজমিস্ত্রির জোগানদারের ও কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন। ইলেকট্রিক সামগ্রী মেরামতের কাজ শেখেন। বর্তমানে তিনি সিলেটের শাহ পরান এলাকায় বসবাস করেন এবং নিজ ছেলেদের নিয়ে একটি ভ্যারাইটিজ স্টোর চালান। কিন্তু বাস্তবে দোকান চালানোয় তাঁর মন নেই, মন তাঁর গান, ছড়া ও নাটক রচনায় এবং এগুলোর প্রচার-প্রচারণায়।
ছোটবেলা থেকেই প্রবীর দেবনাথ বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক গান ও ছড়া লেখা শুরু করেন। তিনি লেখেন বৃক্ষ রোপণ, পরিবেশ, বন্য প্রাণী সংরক্ষণ, বই পড়া, মাদকাসক্তি প্রভৃতি বিষয় নিয়ে। তিনি ছড়া লিখে বিতরণ করে আসছেন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। এ পর্যন্ত তিনি এক হাজারেরও বেশি গান লিখেছেন। লিখেছেন অসংখ্য ছড়া ও ডজন খানেক নাটক। তিনি শুধু গান লেখেনই না, তিনি সুরকার এবং গায়কও। বিভিন্ন ব্যক্তির অনুরোধে তিনি বিভিন্ন সময়ে অনেক গান ও ছড়া রচনা করেছেন, যেগুলোর অনুলিপিও তাঁর কাছে নেই।
অতীতে আর্থসামাজিক বিষয়ে গান-ছড়া লিখলেও, সাম্প্রতিক কালে প্রবীর দেবনাথ ভোটার সচেতনতা সৃষ্টির কাজে নিজের প্রতিভা ব্যবহার করছেন। গত কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থীদের ভোট দিতে তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে নাগরিকদের আহ্বান জানান। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি ভোটারদের সচেতন করার লক্ষ্যে কালোটাকা, পেশিশক্তির মালিক ও ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। কলম ধরেন সৎ ও যোগ্য লোকের পক্ষে:
‘আবার দেশে আইল নির্বাচন।।
দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায়
ভুল করিসনে জনগণ।।
…………………..
ভালমন্দ যাচাই করে
নির্বাচিত করব যারে
মন থাকে যার দেশের তরে
সে আমাদের আপনজন।।
…………………….
ঋণ খেলাপি আছে যারা
সন্ত্রাস যার কর্ম ধারা
দেশের ক্ষতি করে তারা
করব তাদের বর্জন।।
………………………
আমরা সবাই থাকব সুখে
পাইলে দেশটা ভাল লোকে
ভোট দেব সেই লোক দেখে
এই আমাদের অঙ্গীকার।।’
গত জাতীয় নির্বাচনের আগে তিনি শুধু লেখালেখির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি, তিনি তাঁর লেখা গান নিজের অর্থে ছেপে ভোটারদের মধ্যে বিতরণ করেন। সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচিত করে আনার এই অনন্য উদ্যোগ স্থানীয়ভাবে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এমনকি জাতীয়ভাবেও তিনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি চারণ কবি বলে খ্যাতি অর্জন করেছেন। টেলিভিশনের পর্দায়ও তাঁর কীর্তিকাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। গত নির্বাচনের আগে তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য প্রথম আলো (২০ ডিসেম্বর ২০০৮) তাঁকে ‘সুশাসনের ফেরিওয়ালা’ বলে সম্মানিত করেছে।
প্রবীর দেবনাথ নিজের কাজকর্ম বাদ দিয়ে কেন মানুষকে সচেতন করে বেড়াচ্ছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মানুষ মানুষের জন্য, আর মানুষকে সহায়তা করাই শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তিনি মানুষকে অর্থকড়ি দিয়ে সহায়তা করতে পারবেন না, কারণ, তাঁর তেমন অর্থবিত্ত নেই। কিন্তু তাঁর যা কিছু আছে, তা দিয়েই তিনি মানুষকে সহায়তা করতে চান। তাঁর আছে গান-কবিতা লেখার হাত এবং মানুষকে উজ্জীবিত করার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। তিনি আরও বিশ্বাস করেন যে মানুষকে সচেতন করার এবং তাদের মানসিকতা পরিবর্তনের বড় হাতিয়ার হলো গান ও নাটক।
আরেকটি কারণেও প্রবীর দেবনাথ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টিকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। অর্থবিত্তের দিক থেকে সমাজের অতি পিছিয়ে পড়া অংশ থেকে উঠে এলেও তিনি সমাজ পরিবর্তনে সামান্য হলেও অবদান রেখে যেতে চান। তিনি আরও মনে করেন, তাঁর পক্ষে তা করাও সম্ভব। এমন আত্মবিশ্বাসই গত কয়েক দশকের তাঁর এই অদম্য প্রচেষ্টাকে অব্যাহত রাখতে সহায়তা করেছে। কিছু কিছু বাধা ও নিরুৎসাহিতার মুখেও তাঁকে সামনে এগোতে উৎসাহিত করেছে।
মাঝেমধ্যে তিনি সত্যিই বাধার সম্মুখীনও হয়েছেন। কারও কারও দ্বারা তিরস্কৃত হয়েছেন। কিন্তু এগুলো তাঁকে অবদমিত করতে পারেনি। তিনি পথচ্যুত হননি।
পরিবারের কাছ থেকে প্রবীর দেবনাথ কখনো নিরুৎসাহিত হননি। বাইরের কেউ কেউ তাঁকে বিভিন্নভাবে হেয় করার চেষ্টা করলেও পরিবারের সদস্যরা এতে দমে যাননি। তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে তিনি সহায়তাই পেয়েছেন। তাঁর পাঁচ সন্তানও তাঁকে কোনো দিন বাধা দেয়নি। তিনি অনুধাবন করেন, পরিবারের আপত্তি থাকলে তাঁর পক্ষে এত বছর ধরে মানুষকে সচেতন করার এ কাজটি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হতো না।
প্রবীর দেবনাথ তাঁর কাজ নিয়ে অত্যন্ত তৃপ্ত। এর দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল নিয়েও তিনি দারুণ আশাবাদী। প্রথম দিকে তাঁর কাজকে কিছু মানুষ পাগলামি বলে মনে করলেও, এখন তাঁকে সবাই প্রশংসাই করে। কেউ কেউ তাঁকে সহায়তাও করে। তিনি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশের সামনে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আর সেই সম্ভাবনাই তাঁকে প্রতিনিয়ত প্রেরণা জোগায়।
প্রবীর দেবনাথ মনে করেন যে কিছু রাজনীতিবিদই অমিত সম্ভাবনার বাংলাদেশের দ্বার উন্মোচনে বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। রাজনীতি মহান পেশা হলেও কিছু রাজনীতিবিদ অপরাজনীতিতে লিপ্ত। তাঁরা তাঁদের আখের গোছাতে ব্যস্ত। তাঁরা রাজনীতির নামে দুর্নীতি করছেন। মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছেন। আর এসব দুষ্ট লোককে প্রতিহত করতেই মানুষকে জাগ্রত করতে হবে। এটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ কাজেই তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।
প্রবীর দেবনাথের মতে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মূলত বিদেশিরা ছিল আমাদের শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র ধরতে হয়েছে। তাদের পরাজিত করতে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেককে এ জন্য প্রাণ দিতে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের নায়ক। তাঁরা সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমাদের জন্য স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। এখন এ স্বাধীনতা আমাদের রক্ষা করতে হবে। এর সুফল সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে।
কিন্তু স্বাধীনতার সুফল ভোগের পথে, তাঁর মতে, আজ বড় প্রতিবন্ধকতা আমাদেরই আশপাশের কিছু মানুষ। তাদের চিহ্নিত করা অনেক সময় দুরূহ। কারণ, তাদের অনেকে আমাদেরই আত্মীয়স্বজন। তাই তাদের পরাজিত করা আরও দুরূহ। কিন্তু এই দুরূহ কাজটিই আমাদের আজ করতে হবে। এ কাজ অবশ্য স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের সমালোচনার তীক্ষ বাণে জর্জরিত হতে পারে। তাই বলে তো বসে থাকলে চলবে না। এ জন্য নাগরিকদের জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদের সোচ্চার করতে হবে। করতে হবে তাদের প্রতিবাদী। স্বার্থান্বেষীদের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করতে হবে। সামাজিকভাবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই প্রহরীর কাজই আজ আমাদের করতে হবে।
প্রবীর দেবনাথের সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই বিখ্যাত ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতার কয়েকটি চরণ মনে পড়ে:
‘ … এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা ; এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা ; ডাকিয়া বলিতে হবে—
‘মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে;
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা-চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি তখনি সে পলাইবে ধেয়ে।
যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে
পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে।’
এটাই অতন্দ্রপ্রহরীর কাজ এবং এ কাজটিই প্রবীর দেবনাথের। এ মেধাবী মানুষটি তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ব্যবহার করে বহুদিন ধরে করে আসছেন। নাগরিকদের পক্ষ থেকে তাঁকে জানাই লাখো সালাম।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক
সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক
প্রকাশিত: প্রথম আলো, ৭ নভেম্বর, ২০১৩
তাঁর মতো মানুষ চাই প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায়
Categories: