বদিউল আলম মজুমদার
বিচারপতি এম এম রুহুল আমিনকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন। আমাদের জানামতে, তিনি একজন সজ্জন এবং আমরা তাঁকে স্বাগত জানাই। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ আজ যে সংকটের সম্মুখীন, তা থেকে উত্তরণের জন্য একজন সৎ ও সাহসী প্রধান বিচারপতির এখন সর্বাধিক প্রয়োজন। আমাদের প্রত্যাশা, বিচারপতি রুহুল আমিনের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বর্তমান সংকটের নিরসন ঘটবে।
সাধারণ নাগরিকদের দৃষ্টিতে বিচার বিভাগের সংকট প্রধানত আস্থার সংকট। আর এর জন্য দায়ী মূলত বার ও বেঞ্চ, যদিও তাদের নিজেদের সম্মান ও স্বার্থ বিচারালয়ের আস্থাশীলতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠাই প্রধান বিচারপতির সামনে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। বস্তুত তাঁর জন্য এটি একটি অগ্নিপরীক্ষা।
গত দেড়-দুই বছরে উচ্চ আদালত চত্বরে অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, যা গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। এসব শিরোনাম বিচারালয় সম্পর্কে নাগরিকদের শ্রদ্ধাশীলতা দারুণভাবে ক্ষুণ্ন করেছে। বিচার বিভাগ নাগরিকের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান−এটি রাষ্ট্রের তিনটি অপরিহার্য স্তম্ভের একটি। বস্তুত উচ্চ আদালত নাগরিকের শেষ ভরসাস্থল। তাই বিচার বিভাগের বর্তমান অস্থাহীনতার সংকট নিয়ে আজ অনেকেই উৎকণ্ঠিত।
বেঞ্চ বা আদালতের, বিশেষত উচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক ভূমিকার কথায় আসা যাক। ৩০ নভেম্বর, ২০০৬ তারিখে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি একটি হাইকোর্ট বেঞ্চের বিচার কার্যক্রম স্থগিত করেন সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিচারপতিদ্বয় রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিরুদ্ধে রুল জারি করার ঠিক পূর্বক্ষণে। এটি ছিল একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা। অভিজ্ঞদের মতে, একটি নজিরবিহীন হস্তক্ষেপ, যা বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার ইমেজ দারুণভাবে ভূলুণ্ঠিত করেছে। এর ফলে বিচারালয়ে সহিংস ঘটনা ঘটেছে।
আরেকটি অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপের ঘটনা ঘটে ১৯ ডিসেম্বর, ২০০৬ তারিখে। ওই দিন আপিল বিভাগের তৎকালীন কনিষ্ঠতম ও অবসরকালীন বেঞ্চের বিচারপতি মো. জয়নাল আবেদীন সম্পূর্ণ একতরফা শুনানির ভিত্তিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের আট ধরনের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টিমূলক হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী রায়ের (আব্দুল মোমেন চৌধুরী ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ ও অন্যান্য, রিট পিটিশন নং ২৫৬১/২০০৫) ওপর স্থগিতাদেশ প্রদান করেন। তাৎপর্যপূর্ণ এ ঘটনাটি ঘটে ২২ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখের নির্ধারিত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিলের মাত্র দুই দিন আগে। মাননীয় বিচারপতি এককভাবে এ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটি নেন, যদিও প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের তিন সদস্যের একটি বেঞ্চ এ রায়ের বিরুদ্ধে লিভ-টু-আপিল গ্রহণকালে কোনো স্থগিতাদেশ দেননি।
বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন প্রদত্ত স্থগিতাদেশটি ছিল অত্যন্ত রহস্যজনক। কারণ, ‘কেভিয়েট’ দেওয়া থাকলেও শুনানিকালে আদালত প্রতিপক্ষের উপস্থিতি নিশ্চিত করেননি। (‘কেভিয়েট’ দেওয়া থাকলে আইনসম্মত পদ্ধতি হলো, আদালতে সংশ্লিষ্ট পক্ষের উপস্থিতি নিশ্চিত করে তাদের বক্তব্য শোনা।) এ ছাড়া স্থগিতাদেশটি অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে একই দিনে নির্বাচন কমিশনে প্রেরণ করা হয়, যা কমিশন কালক্ষেপণ না করেই বাস্তবায়ন করে। উপরন্তু, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে অজ্ঞাত ও সন্দেহভাজন আপিলকারী আবু সাফা শুধু তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রকাশের ক্ষেত্রে আপত্তি তুললেও, বিচারপতি মো. জয়নাল আবেদীন পুরো রায়ের ওপরই স্থগিতাদেশ দেন এবং এটি জনাব সাফার ক্ষেত্রে সীমিত না করে সব প্রার্থীর জন্য প্রযোজ্য করেন (মো. আবু সাফা বনাম আব্দুল মোমেন চৌধুরী ও অন্যান্য, সিভিল আপিল নং ৫৭/২০০৬)। উল্লেখ্য, ২১ আগস্ট, ২০০৪ তারিখে আওয়ামী লীগের সমাবেশ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবনের ওপর হামলার ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তও বিচারপতি জয়নুল আবেদীন পরিচালনা করেন এবং একটি অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন দেন।
সাম্প্রতিককালের দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রাজনীতিবিদদের পক্ষে দেওয়া হাইকোর্টের বেশ কিছু রায়ের ওপর আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ প্রদানের ফলেও জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উচ্চ আদালতের নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেকেই আজ সন্দিহান। আরও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আদালতে ‘অ্যামিকাস কিউরি’ নিয়োগ নিয়ে। সাধারণত সিনিয়র ও প্রজ্ঞাবান আইনজীবীদের নিয়ে গঠিত ‘অ্যামিকাস কিউরি’ আদালতের ‘বন্ধু’ হিসেবে কাজ করেন এবং জটিল বিষয়ে আদালতকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অভিযুক্তদের সঙ্গে দলীয় কর্মকাণ্ডে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ব্যক্তিদের নিয়ে ‘অ্যামিকাস কিউরি’ গঠন করার ফলে আদালতের মূল রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।
বিচারিক কার্যক্রমের প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে বার বা আইনজীবীদের ভূমিকাও কম নয়। আব্দুল মোমেন চৌধুরী বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ের বিরুদ্ধে জনাব আবু সাফার আপিলের কথায় আবারও আসা যাক। আবু সাফা নামের মুখোশধারী ব্যক্তিটি একজন প্রতারক এবং আপিলটি দায়ের করা হয়েছে সম্পূর্ণ বানোয়াট তথ্যের ভিত্তিতে। বস্তুত আবু সাফার আপিলটি নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি গুরুতর কেলেঙ্কারি ঘটে গেছে। আর এ জন্য মূলত দায়ী একদল আইনজীবী।
আবু সাফার আপিলটি খারিজ করে ১১ ডিসেম্বর, ২০০৭ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণ বেঞ্চের রায়ে এমনই অভিমত ব্যক্ত করা হয়−‘…we are of the view that the appeal…was filed by non-genuine person upon using imaginary name of a person and that upon using fabricated papers. Such manner of filing a case is highly deprecable one and as such strongly dis-approved by the Court. The advocate-on-record is cautioned as well as warned from repeating such kind of thing in the future. Since the appeal has been filed by fabricating papers which is highly condemnable in law and consequently there being no appeal in the eye of law, we are not entering into the merit of the appeal.? (আমাদের মতে, কাল্পনিক নাম এবং জাল কাগজপত্র ব্যবহার করে ভুয়া ব্যক্তি আপিলটি দায়ের করে। এ ধরনের মামলা দায়ের অত্যন্ত গর্হিত কাজ এবং আদালতের কাছে চরমভাবে অগ্রহণযোগ্য। অ্যাডভোকেট-অন-রেকর্ডকে এ ব্যাপারে হুঁশিয়ার এবং এ ধরনের কাজ ভবিষ্যতে না করার জন্য সাবধান করে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু আপিলটি জাল কাগজপত্র দিয়ে দাখিল করা হয়েছে, যা আইনানুয়ায়ী অত্যন্ত নিন্দনীয়, তাই আমরা আপিলের যৌক্তিকতা বিচার করিনি। কারণ, এটি আইনের চোখে কোনো আপিল ছিল না।)
নিঃসন্দেহে আবু সাফার আপিলটি নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে একটি চরম জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। আর আবু সাফাকে নিয়ে সাফাইয়ের কাহিনীর মূল নায়ক কয়েকজন আইনজীবী হলেও, বিচারপতিদের কেউ কেউ এর দায়ভার পুরোপুরি এড়াতে পারেন না বলে অনেকের ধারণা। বস্তুত, এ ব্যাপারে জনমনে ব্যাপক সন্দেহ বিরাজ করছে, যার কালো ছায়া পুরো বিচার বিভাগের ওপর পড়েছে।
যেহেতু বিচারালয়ের দায়িত্ব শুধু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাই নয়, ন্যায়বিচার করা হয়েছে, সে ধারণাও প্রতিষ্ঠা করা। তাই আবু সাফার আপিলের ক্ষেত্রে কোনো অশুভ যোগসাজশ ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। আমরা প্রধান বিচারপতিকে ঘটনাটির একটি যথাযথ তদন্ত অনুষ্ঠানের বিনীত অনুরোধ জানাই। তবে তদন্তে বার ও বেঞ্চের যাঁরাই দোষী সাব্যস্ত হোন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে আরও জরুরি। উচ্চ আদালতকে কালিমামুক্ত করে এর প্রতি আস্থাশীলতা প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই প্রধান বিচারপতির এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া আবশ্যক। কারণ, অন্যায় করে পার পেয়ে গেলে ভবিষ্যতে অন্যায় কর্মই উৎসাহিত হবে। আরেকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বিচার বিভাগের আস্থাশীলতার সঙ্গে বর্তমান জরুরি বিধিমালার অধীনে বিশেষ আদালতের কার্যক্রম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এসব বিচারালয়ের কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে অনেক গুরুতর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে বিচারকার্যের নিরপেক্ষতা নিয়ে। এ প্রসঙ্গে আদালতের অভিযুক্ত ও তাদের আইনজীবীদের ভূমিকা নিয়েও কথা উঠেছে। আমাদের নেতা-নেত্রীরা অতীতে ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন আইন অমান্য করে এবং নিয়মনীতি ভেঙে। বিশেষ আদালতেও বিচারালয়ের রীতি-নীতি ও বিচারকের নির্দেশ উপেক্ষা করে তাঁরা তা-ই করছেন। আইনজীবীরা ‘অফিসার্স অব দ্য কোর্ট’−তাঁরা বিচারালয়ের অংশ। কিন্তু তাঁদের বিশৃঙ্খল আচরণ, বিশেষত আদালত চত্বরে বিশেষ নেতা-নেত্রীর পক্ষে স্লোগান দেওয়া, বিচারালয়কে নাট্যশালায় পরিণত করেছে। এমন আচরণ কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয় এবং এগুলো বন্ধ হওয়া জরুরি।
বিচার বিভাগের প্রতি আস্থাহীনতার নেপথ্যে অবশ্য রয়েছে দলীয় বিবেচনায় উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ। গত দুই সরকারের আমলে অযোগ্য, অদক্ষ এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের উচ্চ আদালতের বিচারক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে ক্ষমতাসীনেরা যে ‘পাপ’ করেছেন, জাতিকে আজ তারই মাশুল গুনতে হচ্ছে। এসব নিয়োগকে সাবেক প্রধান বিচারপতি ‘প্রলয়’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন এবং তিনি বিচার বিভাগের ‘ঘর গোছানো’র আবশ্যকীয়তার কথা বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে বীজ বপন করা হয়েছে, তার থেকে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি এ ব্যাপারে কিছু করেননি বা করার সুযোগ পাননি।
আমাদের প্রত্যাশা, নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি এসব ক্ষেত্রে একটি কার্যকর উদ্যোগ নেবেন। এ কথা সত্য যে বিচারকেরা সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত এবং সংগত কারণেই তাঁদের অপসারণের বিরুদ্ধে সাংবিধানিক বাধা রয়েছে। তবে অভিজ্ঞদের মতে, অযোগ্য বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ‘ডিউ ডিলিজেন্স’ বা যথাযথ সতর্কতা, যত্ন ও দায়িত্বশীলতা প্রদর্শন করা হয়নি। সহজে অপসারণ করা যায় না বলে সাধারণ নিয়োগের তুলনায় বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ যত্নবান হওয়া আবশ্যক। তাই এসব নিয়োগ ছিল ত্রুটিপূর্ণ এবং এ কারণে তাঁদের আইনানুগভাবে অপসারণ করা দুরূহ হওয়ার কথা নয়। তবে সম্পূর্ণ সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় অপসারণের কাজটি করতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে কোনো খারাপ দৃষ্টান্ত যাতে সৃষ্টি না হয়। একইসঙ্গে পরিপূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে একদল যোগ্য বিচারপতি নিয়োগ দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি, প্রধান বিচারপতি এসব বিষয়ে দ্রুততার সঙ্গে সাহসী পদক্ষেপ নেবেন। তাঁর কাছে এ-ই আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ৭ জুন ২০০৮
নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতির কাছে প্রত্যাশা
Categories: