বদিউল আলম মজুমদার
সম্প্রতি বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের অংশ নেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ বাতিল করেছেন। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচন আচরণ বিধিমালার ধারা ৩ অনুযায়ী, ‘পৌরসভা নির্বাচন রাজনৈতিক দলভিত্তিক হইবে না এবং নির্বাচনী প্রচারণায় কোন রাজনৈতিক দলের নাম, প্রতীক অথবা কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নাম বা ছবি ব্যবহার করা যাইবে না।’ গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে আদালত আচরণবিধির এ ধারাটি অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এমন বিধান মূল আইনে নেই বলে আদালত এ সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এ সিদ্ধান্তের ফলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে হওয়ার ওপর আর কোনো নিষেধাজ্ঞা রইল না। আদালতের এ রায় কি যৌক্তিক? এ থেকে কি ইতিবাচক ফলাফল আশা করা যায়? না কি এর ফলে আরও জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে?
বহুদিন থেকেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যদিও কেউ কেউ বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে এই ধারাটি আচরণবিধিতে যুক্ত করার জন্য দায়ী করেছেন, বাস্তবে তা সঠিক নয়। আগের আচরণবিধিতেও একই ধারা অন্তর্ভুক্ত ছিল। অর্থাৎ অতীতেও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেউ সরাসরি দলীয় মনোনয়ন নিয়ে কিংবা দলীয় প্রতীক ব্যবহার করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি, যদিও প্রার্থীদের দলীয় পরিচিতি ভোটারদের অজানা থাকত না। তাই আদালতের রায় ভোটারদের পক্ষে প্রার্থীর দলীয় পরিচিতি জানার ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্যই সৃষ্টি করবে না। তবে ভবিষ্যতে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার এবং দলীয় প্রতীক ব্যবহার করার ওপরও আর কোনো বিধিনিষেধ থাকবে না।
এ প্রসঙ্গে একটি বিষয় সম্পর্কে অস্পষ্টতা দূর করা প্রয়োজন। অনেকে নির্দলীয় নির্বাচনকে অরাজনৈতিক বা রাজনীতি-বিবর্জিত প্রক্রিয়া বলে মনে করেন। ‘নির্দলীয়’ আর ‘অরাজনৈতিক’ শব্দ দুটি সমার্থক নয়। বস্তুত নির্বাচনই একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যা দলভিত্তিক হতে পারে, কিংবা নির্দলীয়ও হতে পারে। তাই নির্দলীয় নির্বাচন বিরাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়া−এ দাবি সঠিক নয়। এ ছাড়া দলীয় সদস্যদের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিষিদ্ধ নয়, যদিও নতুন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচনী বিধিমালায় এসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শপথ নেওয়ার আগে, রাজনৈতিক দলের কোনো কমিটির সদস্য হলে, সে পদ থেকে পদত্যাগ করার বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাৎ নির্বাচিত প্রতিনিধি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে থাকতে না পারলেও, দলের সদস্য থাকতে বাধা থাকবে না।
রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগের বিধানের কারণে বিরাজনৈতিকীকরণের অভিযোগ তুললেও বস্তুতপক্ষে আমাদের দেশে বিরাজনৈতিকীকরণ হয়েছে বহুলাংশে ‘মনোনয়ন বাণিজ্যে’র কারণে। অর্থ নিয়ে কিংবা অন্য কোনো সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে অতীতে আমাদের দেশে মনোনয়ন, বিশেষত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন ‘বিক্রি’ হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদেরা মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ফলে আমাদের সংসদ হয়ে পড়েছে অনেকটা ব্যবসায়ীদের প্রাইভেট ক্লাবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হওয়ার পক্ষে একাধিক শক্ত যুক্তি রয়েছে। প্রথমত, স্থানীয় পর্যায়ে অনেক সমাজসেবী আছেন, যাঁরা কোনো দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন বা যুক্ত হতে চান না, যদিও এ ধরনের ব্যক্তির সংখ্যা সমাজে দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও আছেন, যাঁরা অত্যন্ত সম্মানিত এবং স্থানীয় মানুষের আস্থাভাজন। নির্দলীয় নির্বাচন হলেই এসব ব্যক্তিকে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পক্ষে আরেকটি যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে দলবাজির সর্বনাশা প্রভাব তৃণমূলে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা সম্ভব। রাজনৈতিক দল গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু দলবাজি সম্পূর্ণই অনাকাঙ্ক্ষিত। বস্তুত রাজনৈতিক দল গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি এবং দল ছাড়া গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারে না। দুর্ভাগ্যবশত দলবাজি ইতিমধ্যে আমাদের গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ফলে নব্বইয়ের শুরুতে একতাবদ্ধ হলেও, আমরা আজ চরমভাবে একটি বিভক্ত জাতি। আর এই বিভক্তি এবং পারস্পরিক হানাহানি জাতি হিসেবে আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে। কারণ ইতিহাসের শিক্ষা হলো, যে জাতি যত ঐক্যবদ্ধ, তারা তত উন্নত ও সমৃদ্ধ।
দলভিত্তিক নির্বাচনের মাশুল সাধারণ নাগরিকদেরও গুনতে হয়। আমাদের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, যেসব এলাকায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন, সেসব এলাকায়ই বেশি সরকারি বরাদ্দ ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কোনো কোনো এলাকা এবং জেলার প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এটা অবশ্য দলবাজির সমস্যা, দলের নয়। তাই দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে যেসব এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে নেই, দলবাজির সংস্কৃতির কারণে সেসব এলাকা কেন্দ্রীয় সম্পদ থেকে বঞ্চিত হতে পারে।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে সুসংহত করার ক্ষেত্রেও নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নির্দলীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে দলীয় ভিত্তিতে একক প্রার্থী মনোনীত করা হয় না বলে, নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে তাদের পক্ষে ভালো প্রার্থী খুঁজে পাওয়ার সুযোগ বেশি সৃষ্টি হয়, যা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুণগত মানে পরিবর্তন সাধনে সহায়তা করে। আর সৎ, যোগ্য, দক্ষ ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হলেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। অপেক্ষাকৃত যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো আরও কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনার দ্বার উন্নোচিত হতে পারে।
নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচন রাজনৈতিক দলের পক্ষেও আশীর্বাদ হতে পারে। এ ব্যবস্থায় দলের মধ্যে মনোনয়ন নিয়ে দলাদলি এড়ানো যেতে পারে। আচরণবিধিতে নির্দলীয় নির্বাচনের কথা থাকলেও, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ফলে কোনো কোনো দল বা জোটের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে।
দলভিত্তিক স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে যুক্তি হলো, এর মাধ্যমে দলীয় নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নের পথ সুগম হয়। এটি অনেকটা খোঁড়া যুক্তি, কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দায়িত্ব সব নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করা, দলবিশেষের নয়। দলভিত্তিক নির্বাচনের পক্ষে আরেকটি যুক্তি হলো, এর ফলে স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও দলীয় শৃঙ্খলার অধীনে আসেন। ফলে তাঁদের পক্ষে অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাস্তবতা তার উল্টো। আমাদের সমাজে অধিকাংশ অন্যায় ও গর্হিত কাজই পরিচালিত হয় সরাসরি দলীয় ছত্রছায়ায় অথবা দলীয় সমর্থনে। বস্তুত দলের বিশেষত সরকারি দলের সমর্থন ছাড়া কেউ অপরাধ করে পার পায় না। এ ছাড়া আমাদের দেশে অপরাধীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক দলীয় অনুশাসনের প্রয়োগ অনুপস্থিত বললেই চলে।
দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রশ্ন উঠলে অনেক সময় প্রতিবেশী ভারতের, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ দেওয়া হয়। এ কথা সত্য যে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন দলভিত্তিক হয়ে থাকে। তবে সীমান্তের ওপারের রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ আর আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ এক রকমের নয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন ও পৌর নির্বাচনে যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে জেতার আকাঙ্ক্ষা থেকে, সম্পূর্ণ ন্যায়-নীতিবোধ বিসর্জন দিয়ে, ব্যাপক দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়ণের অভিযোগে অভিযুক্ত, এমনকি কারাগারে অন্তরিন ব্যক্তিদেরও রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন বা সমর্থন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট এমন ধরনের আচরণ করবে তা কল্পনাও করা যায় না। তাই সেখানে দলভিত্তিক নির্বাচন ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি করে না।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে আমাদের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন যৌক্তিক নয়। বস্তুত নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। কিন্তু আমরা এর সুফল থেকে বঞ্চিত হয়েছি, কারণ আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সে ধরনের আচরণ করেনি এবং এসব নির্বাচনকে নির্দলীয় রাখেনি। আচরণবিধিতে নির্দলীয় নির্বাচনের কথা থাকলেও তারা অনেক ক্ষেত্রে অন্তত পরোক্ষভাবে দলীয় মনোনয়ন অথবা সমর্থন দিয়েছে। আশা করি আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিষয়টি সম্পর্কে আবারও গভীরভাবে ভেবে দেখবেন। আর যদি দলীয়ভিত্তিতে নির্বাচন হতেই হয়, তাহলে গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ ও সত্যিকারের জনকল্যাণমুখী রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক দলের ব্যাপক সংস্কার। তা না হলে আমাদের বিদ্যমান সমস্যাগুলো, বিশেষত দলবাজি ও পক্ষপাতিত্বের সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন−সুশাসনের জন্য নাগরিক।
তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ১১ আগস্ট ২০০৮
নির্দলীয় স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ইতিবাচক দিক রয়েছে
Categories: