‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া থাকলেও, কমিশন যেন তা প্রয়োগে অনিচ্ছুক বা অপরাগ। বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে কমিশন কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। একইভাবে বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল সরকারি অর্থ ও সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে গেলেও কমিশন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’ নির্বাচন কমিশনের এ আচরণ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে একটি বিরাট বাধা বলে মন্তব্য করেন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক নেতৃবৃন্দ। আজ সকাল ১০.৩০টায়, জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে সুজন আয়োজিত ‘নির্বাচনী আইনের সংস্কার: আমরা কোথায়?’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলন তারা এ মন্তব্য করেন।
সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজমুদার। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সুজন নির্বাহী সদস্য ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ড. হামিদা হোসেন। আরও উপস্থিত ছিলেন নির্বাহী সদস্য ড. জালাল উদ্দীন সরকার ও সুজন কেন্দ্রীয় প্রধান সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।
মূল প্রবন্ধে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গত ২৮ অক্টোবর জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া আরপিও’তে যেসব বিধান রাখা হয়েছে তা হলো: (১) আন-র্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য ঘোষণা; (২) নির্বাচনী ব্যয়সীমা ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকায় এবং মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার জামানত বর্তমানে দশ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় বৃদ্ধি; (৩) বিদ্রোহী হওয়ার ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ; (৪) দেশের বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে দলীয় প্রধানের যে ব্যয় হবে তা নির্বাচনী ব্যয় হিসেবে গণ্য না করা; (৫) দেশের বিভিন্ন প্রশাসনিক স-রে নির্দিষ্ট সংখ্যক কমিটি ও দফতর না থাকলে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করা ইত্যাদি। এ বিধানগুলোর মধ্যে বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে যে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে – তাতে দলীয় মনোনয়ন প্রদানে দলীয় প্রধানদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে এবং তারা যে কোনো বসনন্তে কোকিলদের মনোনয়ন প্রদান করতে পারবেন। ফলে মনোনয়ন বাণিজ্য ও নির্বাচনে টাকার খেলার আরও বিস্তার ঘটবে।’
তিনি বলেন, ‘আরপিও’তে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা নির্বাচন কমিশন কিংবা আইন মন্ত্রণালয় কেউ প্রস্তাব করেনি। তা হলো – ২০০৯ সালে জাতীয় সংসদে অনুমোদিত আরপিও’তে নিবন্ধিত দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তিন বছরের জন্য দলের সদস্য থাকার বিধান ছিল। কিন’ সমপ্রতি সংসদে পাশ হওয়া বিলের মাধ্যমে আরপিও’র এ বিধান রহিত করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা জানি না, কি উদ্দেশ্যে কিংবা কাদের স্বার্থে এ জনবিরোধী বিধানটি রহিত করা হয়েছে। তবে এটি দল ভাঙ্গার হীণ উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা।’
সুজন সম্পাদক বলেন, ‘১৩ নভেম্বর চুড়ান- করা আচরণবিধিতে নির্বাচন কমিশন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে, ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’-এর সংজ্ঞা ও ‘প্রচারণার সময়কাল’-এর বিধান রহিতকরণ যার অন্যতম। বিদ্যমান আচরণবিধি অর্থাৎ গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রণীত আচরণবিধির সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ এর পরিমাণ ৯০ দিন। অথচ সর্বশেষ চুড়ান্ত করা আচরণবিধি অনুযায়ী, ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ বলতে ‘জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচন কিংবা কোনো আসনে উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে কমিশন কর্তৃক নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন হইতে সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখ পর্যন- সময়কাল’কে বোঝানো হয়েছে। এ সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ এর পরিমাণ আনুমানিক ৪৫ দিন। এটি সুস্পষ্ট যে, বিদ্যমান আচরণবিধির তুলনায় চুড়ান্ত করা আচরণবিধিতে ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ এর পরিমাণ অর্ধেকে কমিয়ে আনা হয়েছে। এটি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এ সময়ে ‘ইভেন প্লেয়িং ফিল্ড’ বা নির্বাচনী মাঠের সমতলতা নিশ্চিত করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কমিশনের। অর্থাৎ এ সময়ে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের পরিপূর্ণ এখতিয়ার কমিশনের।’ ‘নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রণীত এ আচরণবিধি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক’ বলেও মন-ব্য করেন তিনি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গত ২৭ অক্টোবর থেকে নির্বাচনকালীন সময়ের সূচনা হলেও, ক্ষমতাসীন দল বিনা দ্বিধায় নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারি ব্যয়ে ও অন্যান্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে দেশের বিভিন্ন স’ানে জনসভা করে নিজ দলের পক্ষে ভোট চাচ্ছেন। নিঃসন্দেহে এ সকল কর্মকাণ্ড আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলবে। কিন’ নির্বাচন কমিশন বলছে সরকার প্রধান ও সরকারি দলের এ ধরনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা তাদের নেই। এ প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে – কমিশন তাদের নিজের ক্ষমতাহীণতার বক্তব্যের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্যই কি আচরণবিধিতে নির্বাচন পূর্ব সময়ের সংজ্ঞায় পরিবর্তন এনেছে?’
সুজন সম্পাদক বলেন, ‘একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আমাদের সংবিধানে কমিশনকে অগাধ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাসেম মামলায় (ডিএল আর ৪৫) সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ রায় দেন যে, সুষ্ঠু ও নিরুেপক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে কমিশন আইনি বিধানের সঙ্গে সংযোজনও করতে পারে। তাই কমিশন ক্ষমতাহীণ এ দাবী সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং আমরা নাগিরক হিসেবে কমিশনের এ দাবীতে অসহায়ত্ব বোধ করি।’
ড. হামিদা হোসেন উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা নাগরিকরা ক্রমাগত নির্বাচন থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি। নির্বাচন যেন একটি লড়াই – প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে। নিকট অতীতে দেখা যায় যে, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে কোটি কোটি টাকা্ ব্যয় করছে। আবার এখন বর্তমান ক্ষমতাসীন দল সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যয় করে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে। আর এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনও নিরব ভূমিকা পালন করছে। এতে কশিনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।’