গত ২২ জুন ২০০৯ সকাল ১০টায় ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিকে’র উদ্যোগে ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে “নির্বাচনী ইশতেহার ও প্রস্তাবিত বাজেট” শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ‘সুজন’ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। এবারের বাজেটকে ধারাবাহিকতার বাজেট হিসেবে চিহ্নিত করে প্রবন্ধে ড. আহমদ বলেন, অর্থমন্ত্রী ম্যাক্রো ফ্রেমওয়ার্কের চাইতে খাতওয়ারী যে সমস্ত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে দেয়া হয়েছে সেদিকে অধিকতর দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ইক্যুইটি ও এফিসিয়েন্সির বিবেচনা একেবারেই অনুপস্থিত। তিনি বলেন, সরকারি বেসরকারি অংশিদারিত্বকে নতুন বলা হচ্ছে, আসলে এটা নতুন কিছু নয়, এর আগে বিষয়টি উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে ঢোকানো থাকতো। সরকারের রাজনৈতিক নীতিমালা বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াসকে বাজেটের নতুন দিক হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি আরো বলেন, এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যে জায়গা তৈরির প্রয়াস চালানো হয়েছে তা কার্যকর করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের ওনারশীপ নিশ্চিত করা না গেলে ভালো হয়। ইশতেহার বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অর্থমন্ত্রী নির্বাচনকালে দেয় প্রতিশ্রুতির প্রতি যে গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি ভবিষ্যতে বাজেট প্রণয়নে ও তার বিবেচনায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই আশা করি। বাজেট যত বড়ই হোক না কেন সেটা যথাযথ বাস্তবায়নে সরকার কতটা সফল হবে সেটা দেখতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে বাজেটের সমাজতত্ত্ব সাধারণত আলোচনায় আসে না। সরকারি উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন কর্মের মাধ্যমে সামাজিক বিভিন্ন স্তর নানাভাবে প্রভাবিত হয়। এই প্রভাবের ফলে সমাজের সুযোগ-সুবিধা অনেক সময়ই বিষমভাবে বঞ্চিত হয়, যার ফলে সমাজের সুষম পরিবর্তন বিঘ্নিত হয়ে থাকে।
কালোটাকা সাদা করা যত সহজ কালো অন্তত সহজ করা তত সহজ নয় উল্লেখ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা জনাব এ এসএম শাহাজাহান বলেন, কালোটাকাকে উৎসাহিত যেন না করা হয় সেদিকে সরকারের দৃষ্টি দেয়া উচিত হবে। নির্বাচনী ইশতেহারকে সামনে রেখেই বাজেট প্রণীত হয়েছে এজন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে সাবেক সেনাপ্রধান লেঃ জেঃ (অবঃ) হারুন অর রশিদ বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, এটা ইতিবাচক একটা দিক। তিনি বলেন, ইশতেহারে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলার অঙ্গীকার থাকলেও বাজেটে বৈদেশিক অনুদান বেড়েছে। এছাড়া তিনি প্রান্তিক পর্যায়ে উৎপাদকদের দিকে অধিক দৃষ্টি আরোপ, বিভিন্ন দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ, বাজেট বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের প্রস্তাব করেন। কালোটাকা সাদা করার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটা বর্জন করতে হবে এখনো সময় আছে, কোনো অবস্থাতেই কালোটাকার মালিক যেন সাদা হতে না পারে। সাবেক সেনাপ্রধান লেঃ জেঃ (অবঃ) মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘সুজন’ কর্তৃক উপস্থাপিত বাজেট বিশ্লেষণ বাজেট পাশ হওয়ার প্রক্রিয়ায় সুন্দর একটি দিক-নির্দেশনা হবে। তিনি খাদ্য নিরাপত্তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, এই বাজেট কৃষকবান্ধব হলে এতে অনেক বেশি সাবসিডির ব্যবস্থা করা হতো। এ প্রসঙ্গে তিনি স্থানীয় পর্যায়ে ফসল সংরক্ষণ করার জন্য একটা বড় উদ্যোগ সরকারের থাকা উচিত বলেও মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, আমাদের হিউজ ওয়েস্ট সম্পর্কে বাজেটে কোনো সতর্কবাণী নেই, যা থাকা উচিত ছিল। এছাড়া তিনি সমুদ্রসীমার গুরুত্বের কথা তুলে ধরে নেভিকে ত্রিমাত্রিকরণেরও প্রস্তাব দেন। মাননীয় সংসদ সদস্য রাশেদা বেগম বলেন, এই বাজেট ‘যদি’তে ভরা। এই সমস্ত ‘যদি’র ওপর নির্ভর করছে এই রূপকথার কাহিনী বাস্তবায়িত হবে কি হবে না। নির্বাচনী ইশতেহারভিত্তিক বাজেট প্রণয়নকে ইতিবাচক হিসেবে চিহ্নিত করে ‘সুজন’ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বাজেট কেন যেন বর্তমানে ব্যবসায়িদের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিঃসন্দেহে ব্যবসায়িদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা দরকার। কিন্তু এটা একটা সামাজিক ও রাজনৈতিক দলিল, তাই গরিব মানুষের স্বার্থ রক্ষার দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব ও দৃষ্টি প্রদান আবশ্যক। তিনি নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম অগ্রাধিকারগুলো উল্লেখ করে ‘সুজনে’র পক্ষ থেকে এগুলো মনিটর করার পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরেন। এছাড়া দুদক’কে স্বাধীন ও শক্তিশালী করা, সংসদকে কার্যকর করা, ও সংসদ সদস্যদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা জরুরি বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সংসদ সদস্যদের জন্য একটি কোড অব কনডাক্ট প্রণয়নের ওপরও তিনি জোর দেন। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার নিয়ে যা করা হচ্ছে তা অনৈতিক, অন্যায় ও সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। বাজেটে এ সকল দিক গভীরভাবে বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন বলেও তিনি মত দেন। এছাড়া জাতীয় সংসদ ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের সম্পদের হিসাব প্রকাশের কোনো উদ্যোগ লক্ষ্যণীয় নয় বলেও তিনি মন্তব্য করেন। অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ায় বাজেট প্রণয়ন ও সাধারণ মানুষের ফোরাম না থাকার কথা উল্লেখ করে পলিসি রিসার্চ ইন্সটিউটের চেয়ারম্যান জনাব জায়েদী সাত্তার বলেন, বাজেটে প্রোডিউসারের ইন্টারেস্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে, কিন্তু কনজিউমার ইন্টারেস্টটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
আওয়ামী লীগ নেতা জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সুজন’ প্রস্তাবিত বাজেটকে কেন্দ্র করে সুপারিশসমূহের অনেকগুলোই বিবেচনায় নেবার প্রয়োজন রয়েছে, এছাড়া অনেকস্থানে ফাইন টিউনিংও করা প্রয়োজন। কালোটাকা সাদা করার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবনাকে সাপোর্ট করার কোনো ভিত্তি নেই বলেও এ সময় তিনি মত দেন। তিনি বলেন, প্রশাসনকে বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনুগামি না করা হলে বাজেট কতটুকু বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কলামিস্ট ও গবেষক জনাব সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, লিখিত হোক আর অলিখিত হোক সেই ইশতেহার যেন সরকার বাস্তবায়ন করে এবং অর্থনীতি যেন স্থিতিশীল থাকে তাহলেই আমরা সরকারকে সাধুবাদ জানাবো। উইমেন ফর উইমেনের চেয়ারম্যান জনাব সালমা খান জেন্ডার রেসপনসিভ বাজেটিং এর কথা উল্লেখ করে বলেন, কৃষিতে নারীর যে ব্যাপক সম্পৃক্ততা রয়েছে তা বাজেটে প্রতিফলিত হয়নি। তিনি বলেন, শিশুশ্রম নিরসনে শিক্ষা ও পুনর্বাসন কর্মসূচির উল্লেখ থাকা প্রয়োজন ছিল। এছাড়া মূল প্রকল্পে নারী কীভাবে সুবিধা পাচ্ছে এটা দেখার জন্য অডিট ও তার জন্য বরাদ্দ প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন তিনি। সাবেক সচিব জনাব আবুল কালাম আজাদ বলেন, এত বড় অঙ্কের বাজেট বাস্তবায়ন হবে কি না এটা নিয়েই অনিশ্চয়তা রয়েছে। সাংবাদিক জগলুল আহমেদ চৌধুরী বলেন, স্থানীয় উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করা জরুরি এবং এজন্য স্থানীয় সরকার প্রশাসন নিয়ে যে বিতর্ক রয়েছে তার সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। সাবেক অতিরিক্ত সচিব জনাব বদরে আলম খান বলেন, পাবলিক প্রাইভেট পার্টিসিপেশন ও জেলা বাজেটসহ অনেকগুলো ক্ষেত্রেই অস্পষ্টতা বিরাজমান এগুলোর ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন ছিল। সেফ ওয়েতে মানুষ যাতে চলতে পারে সে বিষয়টি সবসময়ই বাজেটে উপেক্ষিত হয় উল্লেখ করে চিত্রনায়ক ইলিয়াছ কাঞ্চন বলেন, প্রতিটি কর্মক্ষম মানুষের নিরাপদে চলাফেরা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, এজন্য এসএসসি পাশ বেকার ছেলে-মেয়েদের জন্য সকল জেলায় ড্রাইভিং ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অতীতে বাজেট নিয়ে যে মন্তব্য হতো সেই সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে উল্লেখ করে জাতীয় পার্টির নেতা জনাব সাদেক সিদ্দিকী বলেন, বাজেটে অভাব হলো সুশাসনের। তিনি বলেন, বাজেট সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
মূল আলোচনায় ইশতেহারের আলোকে বাজেটের ইতিবাচক দিকসমূহ তুলে ধরা হয়। এছাড়া বাজেট বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ, মতামত ও সুপারিশসমূহও উপস্থাপন করা হয়। আলোচনায় নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার অনুসারে যে সকল দিকগুলো বাজেটকে সমৃদ্ধকরণে ও বাস্তবায়নে বিবেচনায় নেয়া জরুরি সেগুলো হলো: মজুদদারী ও মুনাফাখোরীর সিণ্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়া, কৃষি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রস্তাবনা, বীজ এবং অন্যান্য উপকরণের সমবায়ী মালিকানার প্রতি প্রাগ্রাধিকার প্রদান, এলজিইডির অনকূলে উন্নয়ন বরাদ্দের সাথে স্থানীয় সরকারের সম্পর্ক পরিচ্ছন্ন করা, দারিদ্র্য নিরসন কৌশলকে ঢেলে সাজানো, ন্যাশনাল ফুড পলিসির ক্যাপাসিটি স্ট্রেনথেনিং প্রোগ্রাম-এর ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর অংশিদারিত্ব প্রতিষ্ঠা, শিল্প প্রসারণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের জন্য লাগসই শ্রমঘন প্রযুক্তি নিজেরাই উদ্ভাবন করা, একটি সুষ্ঠু জ্বালানী উৎপাদন, সংরক্ষণ, আমদানী বিতরণ এবং বিভিন্ন খাতের ব্যবহার সম্পর্কিত পরিবেশ বান্ধব, গৃহস্থালীবান্ধব, ক্ষুদ্রশিল্পবান্ধব একটি নীতি প্রণয়ন, একটি সমন্বিত শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও শিক্ষার মৌলিক বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করা, সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে মানবসম্পদ অবকাঠামোতে গুরুত্ব প্রদান, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে ইউজার ফি বাতিল করা, জেন্ডার টার্গেটেড প্রকল্পের ব্যবস্থা রাখার পাশাপাশি জেন্ডার নিউট্রাল প্রকল্পগুলোতে জেন্ডার সংবেদনশীলতা বাড়ানো, শ্রমবাজারের সাংগঠনিক অব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি প্রদান, বনায়নের ক্ষেত্রে সমাজিক বনায়নকে প্রকৃতি প্রদত্ত বন এবং রিজার্ভ বনাঞ্চলকে আলাদা বিবেচনায় রাখা, চলন বিল, বিভিন্ন হাওর অঞ্চল, ভরাট হয়ে যাওয়া নদী ও ভরাট করা জলাশয় উদ্ধার সেদিকে গুরুত্বারোপ করা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে শক্তহাতে দমন করার কার্যক্রম গ্রহণ প্রভৃতি। এছাড়া জনাব এএসএম শাহাজাহানের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরো অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক লতিফা আকন্দ, জনাব আবদুল হাই মজুমদার, চৌদ্দগ্রাম উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদা আক্তার প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধ এবং স্লাইড ডাউনলোড করুন
“নির্বাচনী ইশতেহার ও প্রস্তাবিত বাজেট” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত
Categories: