নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের ইস্যুটি একটি সার্বজনীন বিষয় এবং এটি সকল নাগরিকের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাষ্ট্রপতিকে তাঁর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সংলাপ করার বিনীত অনুরাধ জানিয়েছেন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক নেতৃবৃন্দ। তাঁরা রাষ্ট্রপতির প্রতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ সংক্রান্ত একটি যুগোপযোগী আইন প্রণয়নের জন্য সরকারকে নির্দেশনা প্রদানেরও দাবি জানান। গত ১২ জানুয়ারি ২০১৭, সকাল ১০.০০টায়, জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে প্রস্তাবিত আইনের খসড়া ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকে সুজন নেতৃবৃন্দ এ দাবি জানান।
সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব ড. এ. টি. এম শামসুল হুদা, সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজন নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, রাজনীতিবিদ জনাব ইনাম আহমেদ চৌধুরী, জনাব হুমায়ূন কবীর হিরু ও জনাব রুহিন হোসেন প্রিন্স এবং অধ্যাপক আসিফ নজরুল প্রমুখ।
আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘আমাদের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের এখতিয়ার মহামান্য রাষ্ট্রপতির। তবে এই নিয়োগ হতে হবে ‘উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে’। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের সংবিধান রচনার ৪৬ বছর পরেও এমন একটি আইন কোনো সরকারই প্রণয়ন করেনি, যার ফলে আমাদের সংবিধান বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। তাই সংবিধান নির্দেশিত এ আইনটি প্রণয়ন করা আজ জরুরি হয়ে পড়েছে, কারণ আইন প্রণয়ন না করে আবারও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করা হলে বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়াতে এবং জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া, যেহেতু সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কারণে আগামী সাধারণ নির্বাচনও দলীয় সরকারের অধীনে হবে বলেই মনে হয়, তাই যথাযথ আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে একটি শক্তিশালী, নিরপেক্ষ ও মেরুদণ্ডসম্পন্ন নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করা আজ অতি আবশ্যক হয়ে পড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ড. এটিএম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার (নিয়োগ পদ্ধতি) আইন, ২০১১ শিরোনামে একটি আইনের খসড়া রেখে গিয়েছিল, যা নিয়ে বর্তমান রকিবউদ্দিন কমিশন কোনোরূপ পদক্ষেপই নেয়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কোনোরূপ উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আইনের অনুপস্থিতিতে আমাদের দেশে অতীতে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারদের সরাসরি নিয়োগে দিতেন। প্রসঙ্গত, আমাদের সাংবিধানের ৪৩(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির নিয়োগ ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করতে হয়। তাই আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশনসহ অন্যসব নিয়োগ কার্যত প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তেই হয়ে থাকে।’
প্রবন্ধের শেষভাগে ড. মজুমদার বলেন, ‘আমরা মনে করি প্রস্তাবিত আইনে মোটা দাগে চারটি বিধান থাকা আবশ্যক। প্রথম বিধানটি হওয়া উচিত নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কিত। কমিশনের ওপর অর্পিত দায়িত্ব হওয়া উচিত সততা, স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্যভাবে সকল নির্বাচন পরিচালনা করা। দ্বিতীয় বিধানটি হওয়া উচিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারণ। হুদা কমিশনের প্রস্তাবিত অযোগ্যতার মানদণ্ডও আরও শাণিত করা যেতে পারে। কমিশনে নিয়োগের ন্যূনতম বয়স ৪৫ করা যেতে পারে এবং বয়সের উর্ধ্বসীমা না রাখাই শ্রেয় হবে বলে মনে হয়। তৃতীয় বিধান হওয়া উচিত অনুসন্ধান কমিটি সম্পর্কিত। আমরা সংসদের কার্য নির্বাহী কমিটির পরিবর্তে প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের অনুসন্ধান কমিটিতে রাখার পক্ষে। সুস্পষ্টভাবে আমরা প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে অন্তত দুইবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন এমন দুটি দল থেকে দুজন প্রতিনিধি, নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমের একজন প্রতিনিধি সমন্নয়ে পাঁচজনের একটি অনুসন্ধান কমিটির প্রস্তাব করছি। তবে নিশ্চিত করতে হবে যে, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে দলীয় আনুগত্যের বিশ্বাসযোগ্য কোনো অভিযোগ যেন না থাকে। ’
তিনি আরো বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইনের আরেকটি বিধান হওয়া উচিত নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে, যাতে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়। আমরা অনুসন্ধান কমিটির পক্ষে নাগরিকদের কাছ থেকে কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যে নাম আহ্বানের প্রস্তাব করি। প্রাপ্ত নামগুলো থেকে আইনে নির্ধারিত যোগ্যতার আলোকে অনুসন্ধান কমিটি একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করবে, যা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে, সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের অনুমতি সাপেক্ষে, জনসাধারণের অবগতির জন্যপ্রকাশ করা হবে। সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকা ব্যক্তিদের সম্পর্কে অনুসন্ধান কমিটি গণশুনানির আয়োজন করবে, যার ভিত্তিতে কমিটি নির্ধারিত পদের বিপরীতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নাম প্রধানমন্ত্রীর দফতরে প্রেরণ করবে, যাদেরকে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি কমিশনে নিয়োগ প্রদান করবেন। অনুসন্ধান কমিটি তার সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা একটি প্রতিবেদনে লিপিবদ্ধ করে তা জনসাধারণের অবগতির জন্য প্রকাশ করবে।’
এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের বিষয়ে আইন প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না। রাষ্ট্রপতি যে ২২টি রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপ করেছেন, তাদের মধ্যে বিএনপি ছাড়া সকলেই আইন প্রণয়নের কথা বলেছেন। ড. হুদার নেতৃত্বে গঠিত কমিশন এ সংক্রান্ত একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, সেই আইনকে কাজে লাগানো হয়নি এবং আজ অবধি এ সংক্রান্ত কোনো আইন প্রণয়ন করা হয়নি।’
ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, ‘আমরা যে খসড়াটি প্রণয়ন করেছিলাম, ‘সে সময়ে যেসকল রাজনৈতিক দলের সাথে আমরা আলাপ করেছিলাম তারা সকলেই এব্যাপারে সম্মত হয়েছিলেন। আমরা চিন্তাও করিনি, পরবর্তীতে রাজনৈতিক বাস্তবতা যে এরকম হয়ে যাবে। দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল যে সংসদে থাকবে না তা আমরা ভাবিও নাই।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনার হিসেবে যাদের নিয়োগ দেয়া হবে তাদের পরিচয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা যদি কোনো রাজনৈতিক দলের লোক হয়ে থাকে বা রাজনৈতিক দল থেকে সংসদে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে থাকে তাহলে তাঁদের নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া উচিৎ হবে না। নির্বাচন কমিশনাররা যদি সৎ ও দক্ষ না হন তাহলে তারা নির্বাচন কমিশনকে কীভাবে সঠিক পথে পরিচালনা করবেন?’ রাষ্ট্রপতি যদি একটি ভালো নির্বাচন কমিশন উপহার দিতে পারেন তাহলে জাতি তাঁর নিকট কৃতজ্ঞ থাকবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।’
বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের স্টেক হোল্ডার সরকার এবং রাজনৈতিক দল। এছাড়াও নির্বাচনকালীন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনীয়তাও রয়েছে। নির্বাচনকালীন সময়ে নির্বাচন কমিশনই মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করে থাকে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিষয়ে একটি আইন প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। বিভিন্ন স্তরের জনগণকে নিয়ে সার্চ কমিটিটা বড় করা প্রয়োজন। বিদায়ী প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা অন্য কোনো কমিশনারকেও সার্চ কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা যেতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো হয় যদি তিনজন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়, তাহলে যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয়।’
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘আমরা সুজন-এর পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে আইন প্রণয়নের কথা বলে আসছি। আশার কথা যে, রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুতে আলাপ-আলোচনা করেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জাতির ভবিষ্যত নির্ভর করছে আগামী নির্বাচন কমিশন কেমন হবে তার ওপর। এই নির্বাচন কমিশন যদি গ্রহণযোগ্য ও দক্ষ না হয় তাহলে আগামী নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন থেকে যাবে এবং যা আমাদের জাতির জন্য বিপর্যয় বয়ে আনবে। ’
আগামী নির্বাচন জাতির জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন ইনাম আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা যতই সার্চ কমিটিকে নিরপেক্ষ করি না কেন, তারা যদি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে না পারে, তাহলে তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না। শুধু তাই নয়, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইস্যুসহ নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মাঝে সমঝোতা হওয়া অত্যন্ত জরুরি।’
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে যে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তিনি যে আলোচনা করলেন তা থেকে প্রধানমন্ত্রীকে কী পরামর্শ দিলেন তা নিজে থেকে যদি সকলকে জানাতেন তা হলে আমরা অত্যন্ত উপকৃত হতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে ইভিএম চালু করা ঠিক হবে না। কেননা ইভিএম অযোগ্য ও অদক্ষ লোকদের কাছে গেলে এর অপব্যবহার হতে পারে।’ তাই আরও ভেবে-চিন্তে এব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মূল প্রবন্ধ পড়তে ক্লিক করুন