সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ড. বদিউল আলম মজুমদার

ড. বদিউল আলম মজুমদার

গত ১৮ নভেম্বর ড. শাহদীন মালিক, আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, দিলীপ কুমার সরকার ও আমি ‘সুজন’ কর্তৃক প্রণীত ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন, ২০২১’-এর একটি খসড়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে হস্তান্তর করি। মন্ত্রী পরিপূর্ণ সৌজন্যবোধ প্রদর্শন করে আমাদের কাছ থেকে আইনের খসড়াটি গ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকালে সংবিধান নির্দেশিত ‘আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে’ নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং এ লক্ষ্যে আইন মন্ত্রণালয়ও কাজ করছে বলে আমাদের আশ্বস্ত করেন। তিনি স্বচ্ছতার ভিত্তিতে কমিশনে নিয়োগ দেওয়া সম্পর্কে আমাদের যুক্তির সঙ্গেও একমত হন। তবে সাংবাদিকদের সামনে তিনি আইনটি পাস করার জন্য পর্যাপ্ত সময় নেই বলে দাবি করেন, যা আমরা মনে করি একটি খোঁড়া যুক্তি এবং এর সম্ভাব্য পরিণতিও অশুভ।বিজ্ঞাপনবিজ্ঞাপন

সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকা সত্ত্বেও গত ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের লক্ষ্যে কোনো সরকারই একটি আইন প্রণয়ন করেনি, যার কারণ আইনের মাধ্যমে সৃষ্ট কিছু বাধ্যবাধকতা মেনে নিতে তাদের অনিচ্ছা। অর্থাৎ আইনের অনুপস্থিতিতে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে যে ‘স্বাধীনতা’ ভোগ করছিলেন, তা পরিহার করতে তারা অনাগ্রহী ছিল। সরকারের এমন অনাগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সুজনের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে একটি আইন প্রণয়নের দাবি বহুদিন থেকেই করে আসছি। ড. শামসুল হুদা কমিশনও তাঁদের বিদায়কালে এ–সম্পর্কিত একটি আইনের খসড়া রেখে যান। কিন্তু এ বিষয়ের প্রতি সরকার, রকিবউদ্দীন কমিশন, নূরুল হুদা কমিশন কেউই ভ্রুক্ষেপও করেনি। এ অবস্থায় অনেক নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ড. শামসুল হুদা কমিশনের রেখে যাওয়া খসড়াটি এবং আমাদের আশপাশের দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট আইন পর্যালোচনা করে আমরা আমাদের খসড়াটি তৈরি করেছি।বিজ্ঞাপন

স্বচ্ছতার সঙ্গে সঠিক ব্যক্তিদের যাতে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দেওয়া যায়, সে লক্ষ্যে প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় আমরা অনেকগুলো বিধান অন্তর্ভুক্ত করেছি। প্রথমত, আইনের খসড়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্য কমিশনারদের যোগ্যতা-অযোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণ করে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে তথ্য প্রদান ও প্রকাশের বিধান আমরা রেখেছি, যাতে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি কমিশনে নিয়োগ না পান। দ্বিতীয়ত, সঠিক ব্যক্তিদের বাছাইয়ের পদ্ধতি হিসেবে প্রস্তাবিত খসড়ায় সংসদ নেতা, বিরোধী দলের নেতা ও সংসদের তৃতীয় বৃহৎ দল মনোনীত তিনজন সাংসদ এবং চারজন দলনিরপেক্ষ ও সুনামসম্পন্ন ব্যক্তির সমন্বয়ে সাত সদস্যের একটি ‘অনুসন্ধান কমিটি’ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। তৃতীয়ত, অনুসন্ধান কমিটির কার্যপ্রণালি এবং পুরো নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা যাতে নিশ্চিত হয়, সে লক্ষ্যে গণশুনানি, প্রতিবেদন প্রকাশ, কমিটি সভার কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধকরণ ও প্রকাশ ইত্যাদি বিধান খসড়ায় সংযুক্ত করা হয়েছে। চতুর্থত, নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে ধারাবাহিকতা রক্ষার বিধানও আমরা খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করেছি।

শঙ্কার বিষয় হলো যে আইন প্রণয়ন না করা হলে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন নিয়োগ পাবে অতীতের মতো অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে, যে ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, সংসদকে পাস কাটিয়েই আবারও কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হবে

সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আইনমন্ত্রী দাবি করেছেন যে আইনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদিও গত ১২ বছরের ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ সরকার এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই নেয়নি, কিন্তু পরবর্তী নির্বাচন কমিশন নিয়োগের পূর্বে তা প্রণয়নের যথেষ্ট সময় নেই। মন্ত্রীর এ যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বক্তব্য ছিল যে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান কমিশনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবে এবং এখনো প্রায় তিন মাস সময় আছে এবং সরকারের সদিচ্ছা থাকলে এ সময়ের মধ্যে আমাদের খসড়া এবং সরকারের তৈরি খসড়া দুটি বিবেচনায় নিয়ে স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে একটি বিল তৈরি করে আগামী সংসদ অধিবেশনে তা পাস করা যাবে। কারণ, এটি তিন-চার পৃষ্ঠার একটি সহজ ও সংক্ষিপ্ত আইন। আর পরবর্তী সংসদ অধিবেশন পর্যন্ত অপেক্ষা না করে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমেও খসড়াটিকে দ্রুতই আইনে পরিণত করা যেতে পারে, যা করতে মন্ত্রী অসম্মত।

প্রসঙ্গত, আইনমন্ত্রী সম্ভবত ভুলে গেছেন যে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী, যাতে সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের মতো পরিবর্তন করে এর খোলনলচে পরিবর্তন করে ফেলা হয়, মাত্র নয় দিনের ব্যবধানে পাস করা হয়। সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটির সুপারিশসমূহ ২০১১ সালের ২০ জুন মন্ত্রিসভা অনুমোদন করে, যার চার দিন পর ২৫ জুন তা বিল আকারে সংসদে উত্থাপিত হয়। একই দিনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দুই সপ্তাহের সময় দিয়ে আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে এটি প্রেরণ করা হয়। কমিটি চারটি উপদফা যুক্ত করার সুপারিশসহ মোট ৫৫ দফাসংবলিত প্রতিবেদন দাখিল করে ২৯ জুন। পরদিন, অর্থাৎ সংসদে উত্থাপনের পাঁচ দিনের মাথায় চলমান বাজেট অধিবেশনেই এর জন্য সংসদের কোনো বিশেষ অধিবেশনও ডাকা হয়নি, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি পাস হয়। ইচ্ছা করলে সরকার যে কত দ্রুততার সঙ্গে আইন, এমনকি সংবিধানের অতি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনীও পাস করতে পারে, এ তারই প্রমাণ।বিজ্ঞাপন

অধ্যাদেশ জারি করে প্রস্তাবিত খসড়াটিকে আইনে পরিণত করার ব্যাপারে আইনমন্ত্রীর অসম্মতির কারণ হলো, এতে সংসদকে এড়িয়ে যাওয়া হবে, যা তিনি করতে চান না এবং যা আমরাও চাই না। তবে অধ্যাদেশ হিসেবে জারি করে খসড়াটিকে আইনে পরিণত করা হলেও এতে সংসদের সম্পৃক্ততা থাকবে। কারণ, বিধিমোতাবেক অধ্যাদেশটি পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে অনুমোদনের জন্য পেশ করতে হবে। আর অধ্যাদেশ জারির পরিবর্তে বিলটি সরাসরি সংসদে পাস করার জন্য সংসদের একটি বিশেষ অধিবেশনও ডাকা যেতে পারে।

শঙ্কার বিষয় হলো যে আইন প্রণয়ন না করা হলে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন নিয়োগ পাবে অতীতের মতো অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে, যে ঘোষণা সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, সংসদকে পাস কাটিয়েই আবারও কমিশনে নিয়োগ দেওয়া হবে।

অতীতে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে নিয়োগের ফলে আমরা রকিবউদ্দীন কমিশন ও নূরুল হুদা কমিশন পেয়েছি। এই দুই কমিশনের সদস্যদের চরম পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের ফলে আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়াই প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে গুরুতর অসদাচরণেরই নয়, নূরুল হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে

উল্লেখ্য, অতীতের দুটি অনুসন্ধান কমিটিতে একজনও সাংসদ ছিলেন না। পক্ষান্তরে আমাদের প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় সাতজন অনুসন্ধান কমিটির সদস্যের মধ্যে তিনজনই হবেন সাংসদ। তাই আমাদের প্রস্তাবিত খসড়াটি গৃহীত হলে পরবর্তী নির্বাচন কমিশন নিয়োগে সাংসদদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে এবং সংসদকে এড়িয়ে যাওয়া হবে না।

আর অতীতে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে অস্বচ্ছ পদ্ধতিতে নিয়োগের ফলে আমরা রকিবউদ্দীন কমিশন ও নূরুল হুদা কমিশন পেয়েছি। এই দুই কমিশনের সদস্যদের চরম পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের ফলে আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়াই প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু জালিয়াতির নির্বাচনের মাধ্যমে গুরুতর অসদাচরণেরই নয়, নূরুল হুদা কমিশনের বিরুদ্ধে ভয়াবহ দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছে। বর্তমান সরকার কি এই দুই কমিশনের সব অপকর্মের দায় এড়াতে পারবে?বিজ্ঞাপন

এ ছাড়া বর্তমান নূরুল হুদা কমিশন আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে যে পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তা থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে আমরা মহাসংকটের দিকে ধাবিত হতে পারি। আর এ উত্তরণের জন্য প্রয়োজন যোগ্য, নিরপেক্ষ ও সাহসী ব্যক্তিদের একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে কমিশনে নিয়োগ দেওয়া। আর এ আইন এখনই প্রণয়ন করতে হবে, তা না হলে আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে সঠিক ব্যক্তিদের কমিশনে নিয়োগ দেওয়ার জন্য আরও পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে, যা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে আমাদের নির্বাচনব্যবস্থাও, যা ভবিষ্যতে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা বদলের পথ প্রশস্ত করবে। কারণ, নির্বাচনই সাংবিধানিক ও শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা বদলের একমাত্র পথ।

এ ছাড়া সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা অনুযায়ী, শুধু প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই রাষ্ট্রপতি কর্তৃক গঠিত অনুসন্ধান কমিটি প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়েই গঠিত হবে। সে অনুসন্ধান কমিটি এবং তার সুপারিশে গঠিত নির্বাচন কমিশন কতটুকু গ্রহণযোগ্য এবং জনস্বার্থ সংরক্ষণ করতে সক্ষম হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ও বিতর্ক থেকেই যাবে। এ কারণে নির্বাচন কমিশন নিয়ে যে চরম আস্থার সংকট বর্তমানে বিরাজ করছে, তা অব্যাহতই থাকবে, যা কারোর কাম্য হতে পারে না। তাই আমরা মনে করি, প্রেক্ষাপট ও গুরুত্বের বিবেচনায় জরুরি ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি এবং এর কোনো বিকল্প নেই।

এবারের ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আছে। চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকের এ নির্বাচনে বিএনপি সরাসরি অংশ নেয়নি। বিএনপির প্রার্থীরা ‘আংশিকভাবে স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন।

ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যাওয়ার ঘটনাও এ নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এবারে তিন ধাপে ক্ষমতাসীন দলের আড়াই শ জনেরও বেশি প্রার্থী বিনা ভোটেই চেয়ারম্যান হয়ে গেছেন, যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। মনোনয়ন বাণিজ্যও এবারের ইউপি নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অনেক অযোগ্য প্রার্থী অর্থসহ নানা প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন নেওয়ার চেষ্টা করছেন।

আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হানাহানি। এবারের নির্বাচনের এটি একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রাণহানি ঘটেছে অর্ধশতাধিক। সামনের নির্বাচনগুলোতেও প্রাণহানির আশঙ্কা দূর হচ্ছে না। কেবল প্রাণহানি নয়, সম্পদেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

এ নির্বাচনে অনকূল নানা সুবিধা থাকার পরও ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা হেরে যাচ্ছেন—এমন ঘটনাও ঘটছে। দ্বিতীয় ধাপে নৌকা প্রতীক হেরেছে ৪২ শতাংশ ইউপিতে। প্রথম ধাপে হেরেছে ২৬ শতাংশ ইউপিতে। নিজ দলের বিদ্রাহীদের কাছেই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের হেরে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। অনেক ইউপিতে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা জয়ী প্রার্থীদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিলেন না।

তবে এসব রোগ নয়, রোগের লক্ষণ। রোগ হচ্ছে ফায়দাভিত্তিক রাজনীতি। এই রাজনীতিতে দলীয় পদ-পদবি, স্থানীয় সরকারের পদ—এসব অত্যন্ত লোভনীয়। পদ পেলে অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। সে কারণে যেকোনোভাবে পদ-পদবি পেতে অনেকে মরিয়া হয়ে ওঠেন। রাজনীতিতে অন্যায় সুবিধা পাওয়ার সুযোগ বন্ধ না হলে, ফায়দাতন্ত্রের অবসান না হলে নির্বাচনে এই সহিংসতা, প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করা, বিনো ভোটে নির্বাচিত হওয়া, মনোনয়ন বাণিজ্য—এসব চলতেই থাকবে।

নির্বাচন কমিশনের নির্বিকার ভূমিকাও একটি বড় সমস্যা। মনে হচ্ছে, শুধু নির্বাচনকে নির্বাসনে নয়, তারা নিজেরাও নির্বাসনে চলে গেছে। যারা নির্বাচনে অন্যায় করছে, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা এ নির্বাচন কমিশন করছে না। ক্ষমতা থাকার পরও গুরুতর অনিয়মে নির্বাচন বাতিল করছে না। নির্বাচন কমিশনের এই নিষ্ক্রিয়তা নির্বাচনে অনিয়মকে আরো উৎসাহিত করছে।

এবারের ইউপি নির্বাচনের তিন ধাপেই এসব রোগ ও রোগের লক্ষণ লক্ষ করছি। এক ধাপের নির্বাচনের সঙ্গে অন্য ধাপের নির্বাচনের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। নির্বাচন কমিশন হয়তো নানা সমালোচনার মুখে এ ধাপের নির্বাচনের জন্য কিছুটা তৎপরতা দেখিয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সচেষ্ট ছিল। কিন্তু এসব হচ্ছে টাইফয়েড জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল খাওয়ার মতো। এতে রোগ সারবে না।

লেখক : সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক।

আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি যে, চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতা বেড়েই চলেছে। ১১ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় ৩৭১টি ইউপি নির্বাচনে পাঁচজন, ১১ নভেম্বর দ্বিতীয় ধাপের ৮৪৬টি ইউপি নির্বাচনে ২৪ জন নিহত হয়েছেন। দ্বিতীয় ধাপের ২৪ জনের মধ্যে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে গুলিতে। এই ২৪ জনের মধ্যে কেবল নরসিংদীতে মারা গেছেন নয়জন (একটি জাতীয় দৈনিক, ১৪ নভেম্বর ২০২১)। নির্বাচনের প্রচার চলাকালেই দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার দেখা গেছে।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত নয়বার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন চলছে দশমবারের নির্বাচন। আমাদের দেশে নির্বাচন সম্পর্কে জনমনে এমন একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, নির্বাচন একদিকে যেমন উৎসবের আবহ তৈরি করে, পাশাপাশি কখনো কখনো তা প্রার্থী, দল ও সমর্থকদের অসহিষ্ণুতার কারণে সহিংসতার উপলক্ষ হিসেবেও আবির্ভূত হয়। আর এই সহিংসতা অনেক মানুষের প্রাণহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অতীতের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনগুলোর প্রাণহানির তথ্য অনুসন্ধান করে দেখা যায় যে, ১৯৭৩, ১৯৭৭, ১৯৮৩ ও ১৯৯২-এ প্রাণহানির কোনো ঘটনা ঘটেনি। ১৯৮৮ সালে ৮০ জন, ১৯৯৭ সালে ৩১ জন, ২০০৩ সালে ২৩ জন এবং ২০১১ সালে ১০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে বলে জানা যায় (একটি জাতীয় দৈনিক, ৪ এপ্রিল ২০১৬)। সর্বশেষ ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে একটি জাতীয় দৈনিকের (৬ জুন ২০১৬) পরিসংখ্যান অনুযায়ী অন্তত ১০৯ জনের প্রাণহানি (সুজন সচিবালয়ের তথ্যানুযায়ী নিহত ১৪৩ জন) এবং পাঁচ সহস্রাধিক আহত হন। অর্থাৎ অতীতের নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল ২০১৬ সালে। আমাদের আশঙ্কা যে, সর্বশেষ দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে যে হারে সহিংসতা হয়েছে তা অব্যাহত থাকলে এবারের নির্বাচনে সহিংসতার পরিমাণ গতবারের চেয়ে বাড়তে পারে।

কিন্তু কেন এত সহিংসতা? প্রথমত, আমার মনে হয়, এর একটি প্রধান কারণ সুবিধাবাদের রাজনীতি। জনকল্যাণের জন্য কাজ করেন, দেশে এখন এমন রাজনীতিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এখন যারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তাদের প্রায় সবাই ব্যস্ত ব্যক্তিস্বার্থ, গোষ্ঠীস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ রক্ষায়। অনেকেই রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন কিছু পাওয়ার জন্য। অথচ আমরা জানি, রাজনীতি একটি মহান পেশা; এই পেশায় নিয়োজিতদের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনকল্যাণে আত্মনিয়োগ করা। গণতন্ত্র চর্চার শত শত বছরের অভিজ্ঞতা ও পøিতদের প্রজ্ঞা কাজে লাগানো সম্ভব না হলে সহিংসতার বৃত্ত থেকে বের হওয়া কঠিন।রাষ্ট্রীয়  ক্ষমতায় যারা থাকেন তারা এবং তাদের অনুসারীরা যাতে কোনো রকম অন্যায় করে পার পেতে না পারে এবং সুবিধাবাদের রাজনৈতিক চর্চা করতে না পারে তার জন্য দেশে সাংবিধানিক, বিধিবদ্ধ ও রাষ্ট্রবহির্ভূত (সিভিল সোসাইটি ও রাজনৈতিক দল) প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার মধ্য দিয়ে সুবিধাবাদের রাজনীতির অবসান ঘটাতে না পারলে উল্লেখিত রোগ দূরীভূত হবে না, রোগ নিরাময় হবে না এবং সহিংসতা দূর হবে না।

অনেকেই মনে করেন, ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদ পেলে সহজে নির্বাচিত হওয়া যাবে। এজন্য তারা মনোনয়ন পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে এবং তখনো সহিংসতার সৃষ্টি হয়।

আরেকটি বিষয় হলো আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোতে কোনো শৃঙ্খলা নেই। দলের ভেতরেও গণতন্ত্র-স্বচ্ছতা নেই। এমন একটা পরিস্থিতিতে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্তটিই ঠিক ছিল না। এর মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের একেবারে শেষ স্তরে একটা বিষবৃক্ষ স্থাপন করা হয়েছে। এ অবস্থায় মনোনয়ন বাণিজ্য হচ্ছে। পাশাপাশি মারামারি ও হানাহানিতে রক্ত ঝরছে, প্রাণহানি হচ্ছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভোটের সময় প্রতিপক্ষকে মাঠছাড়া করার মরিয়া চেষ্টা দেখা যায়। এ লক্ষ্যে অতীতে আমরা দেখেছি যে, নির্বাচনে সহিংসতা হতো আন্তঃদলীয় তথা প্রতিদ্বন্দ্বী দলের সমর্থকদের মধ্যে। কিন্তু এবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সহিংসতা হচ্ছে অন্তর্দলীয়। এর কারণ হলো এবারের ইউপি নির্বাচনে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নেই। ফলে তাদের মাঠছাড়া করার আর সেভাবে দরকার পড়ছে না। তাই আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীর বিরোধ হচ্ছে। উভয়েরই যেহেতু খুঁটির জোর আছে, তাই কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছে না। এর ফল প্রভাব বিস্তার, জবরদখল এবং রক্তপাত।

তবে যে কোনো নির্বাচনী অনিয়ম ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রতিকারে নির্বাচন কমিশন (ইসি) যদি কঠোর হতো তা হলে সহিংসতা কমত। কিন্তু ইসিকে তেমন ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। যেমন, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে প্রচার চলাকালে ব্যাপকভাবে অস্ত্রের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। তবু ভোটের আগে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের ধরতে বিশেষ কোনো অভিযান পরিচালনা করা হয়নি। যার ফলস্বরূপ ঘটে যায় ২৪ জনের প্রাণহানি। অন্যদিকে ব্যাপক প্রাণহানির ঘটনায় বিব্রত ভাব প্রকাশ করেই যেন দায়িত্ব শেষ করছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। ‘ঘরে ঘরে পাহারা দিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা থামানো যায় না’ বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি (একটি জাতীয় দৈনিক ১৪ নভেম্বর ২০২১)। এমনকি ‘নির্বাচনী সহিংসতার দায় ইসির নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার (একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ১১ নভেম্বর ২০২১)।

নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা দেখে মনে হচ্ছে তারা এবারের নির্বাচনকে নির্বাসনে নিয়ে গেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মূল অনুষঙ্গ রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং ইসি। রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী প্রতিপক্ষকে হটিয়ে দিতে চাইবে- এটা বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বাভাবিক। বাকি তিনটি পক্ষ নিরপেক্ষ ও শক্ত ভূমিকা পালন করলে সমস্যা হতো না।

প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহায়তা না করলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে একা সুষ্ঠু ভোট করা সম্ভব নয়। তবে নির্বাচন কমিশন একা চাইলে খারাপ নির্বাচন এড়াতে পারে। যেমন আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে ইসি। যে প্রার্থীর পক্ষে আচরণবিধি লঙ্ঘিত হচ্ছে, তার প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে। নির্বাচনের দিন ভোট বাতিল করতে পারে ইসি। এমনকি চাইলে ভোটের পর ফলাফলও বাতিল করার এখতিয়ার তাদের আছে। আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাশেম মামলার (ডিএলআর ৪৫, ১৯৯৩) রায়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ বলেছেন, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যা যা করা করণীয়, তার সবই করতে পারবে, এমনকি আইন ও বিধি-বিধানের সংযোজনও করতে পারবে।

ভোটের মাঠে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ইসির অধীনে। এ দুই জায়গায় থেকে পক্ষপাত হলে ইসি কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু তারা এর কোনোটাই করছে না। অর্থাৎ ইসি কাউকেই কোনো কড়া বার্তা দিতে পারেনি। প্রার্থী বা রাজনৈতিক দল বুঝে গেছে, যত অন্যায়ই করুক না কেন, নির্বাচন কমিশন কিছু করতে পারবে না। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা মনে করছেন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের পক্ষে। ফলে কেউ কোনো আইন বা রীতির তোয়াক্কা করছে না। যে কোনো মূল্যে জয় পেতে চাইছে।

এক ইউনিয়নের মনোনয়ন পেতে এক ব্যক্তি কোটি টাকা খরচ করেছেন বলে শোনা গেছে। অথচ অনেক ইউনিয়নে কোটি টাকার কাজই হয় না। এটা থেকে বোঝা যায়, রাজনীতিক, ব্যবসায়ীদের হাতে প্রচুর অবৈধ টাকা এসেছে। এ টাকা বিনিয়োগ করে চেয়ারম্যান হতে পারলে তা অন্য ফায়দা নেওয়ার ক্ষেত্রে কাজে লাগবে। রাজনীতি বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এখন একটা ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বিষয়টি এমন দাঁড়িয়েছে যে সাংসদ হওয়ার অর্থ হচ্ছে সোনার হরিণ হাতে পাওয়া। পৌরসভা, উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কিংবা মেয়র পদও অনেক লোভনীয় হয়ে উঠেছে। এখানে জনস্বার্থ বা জনসেবার চেয়ে ফায়দা হাসিল করাই মুখ্য উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে। এ প্রতিযোগিতায় কেউ পিছিয়ে থাকতে চায় না। তাই যে কোনো মূল্যে নির্বাচনে জয় পেতে সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছেন প্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকরা।

আজ আমাদের উপলব্ধিতে আনা দরকার যে, নির্বাচনে যদি সহিংসতা বন্ধ না হয় তা হলে দল-মত নির্বিশেষে আমাদের সবাইকেই এর পরিণতি নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। আমি মনে করি, সহিংসতা ছাড়া পরবর্তী ধাপের নির্বাচনগুলো সম্পন্ন করতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে আলাপ-আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও সুবিধাবাদের রাজনীতি দূর করা, নির্দলীয়ভাবে স্থানীয় নির্বাচন আয়োজন করা, সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনকে তার দক্ষতা ও কার্যকারিতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণ করা দরকার। একই সঙ্গে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দেওয়া এবং ব্যাপক দলীয়করণের বলয় থেকে সরকারকে বের হয়ে আসতে হবে। এ ছাড়াও এই ঘৃণ্য সহিংসতা বন্ধে সচেতন নাগরিকদের পক্ষ থেকেও জোর আওয়াজ তোলার দরকার বলে আমি মনে করি। তা হলেই দেশের সব নির্বাচন সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে এবং ভোটার তথা দেশবাসীর প্রত্যাশাও পূরণ হবে।

 ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুজন (সুশাসনের জন্য নাগরিক)