গত ২২ মে, ২০০৭ সকাল ৯.৩০টায় ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাব-এর ভিআইপি লাউঞ্জে একটি গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। “প্রধান রাজনৈতিক দলুগগুলোর গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা” শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন’-এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা জনাব এম হাফিজ উদ্দিন খান-এর সঞ্চালনায় এ আলোচনায় আরো উপস্থিত ছিলেন, ‘সুজন’-এর সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ, জনাব আ.স.ম আব্দুর রব, জনাব শেখ শহিদুল ইসলাম, জনাব এ.জি মাহমুদ, এ, জেড, এম আবদুল আলী, শাহ আব্দুল হান্নান, জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ, জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জনাব মুহম্মদ জাহাঙ্গীর, জনাব সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, জনাব মোস্তাফিজুর রহমান, জনাব ইলিয়াছ কাঞ্চন, জনাব আসিফ নজরুল, জনাব আব্দুল মালেক রতন, জনাব রুহিন হোসেন প্রিন্স, জনাব রফিকুল ইসলাম সরকার, জনাব মেহের-ই-খোদা প্রমুখ।
অধ্যাপক মোজাফফ্র আহমদ বলেন, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদ তথা রাজনেতিক দলের, অন্য কারো নয়। রাজনৈতিক দল হলো গণতন্ত্রের চালিকা শক্তি। গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও জনকল্যাণে নিবেদিত রাজনৈতিক দল ছাড়া যেমন গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারে না, তেমনি সুশাসনও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তিনি আরো বলেন, পার্টি একদিনের জন্য নয়। রাজনৈতিক ধারায় সদস্যের অধিকার যেন ভালোভাবে গঠনতন্ত্রে থাকে। যারা সদস্য হবেন সজ্ঞানে হবেন, আবেগের বশে হবেন না। তাদের অধিকার তারা যেন প্রয়োগ করতে পারেন। তাহলেই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি সৃষ্টি হবে। তিনি বলেন, সমালোচনা, আত্মসমালোচনার ভেতর দিয়েই শুরু হোক, সমালোচনা যত দৃশ্যমান হবে সেই রাজনৈতিক দলের গ্রহণযোগ্যতা তত বাড়বে। জনাব হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র নিশ্চিত করা না গেলে, নেতৃত্ব থেকে দুর্নীতিবাজদের দূরে রাখা না গেলে, ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ বন্ধ করা না হলে, দলে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব হ্রাস করা না গেলে, দেশে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না।
ড. বদিউল আলম মজুমদার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করতে গিয়ে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রের একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, প্রধান প্রধান দলের গঠনতন্ত্রে গণতন্ত্র চর্চার কোন সুযোগই নেই। গঠনতন্ত্র বিএনপি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়েই এককভাবে সিদ্ধান্- নেয়ার ক্ষমতা দিয়েছে। যেমন, এ দু’টি দলের চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলে যে কোন কমিটি বাতিল, বিলোপ, যে কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ, অপসারণ এবং সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। এ দু’টো দলের গঠনতন্ত্র কি দেশে সুশাসন ও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য সহায়ক? তুলনামূলকভাবে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনেকটা গণতান্ত্রিক। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে সভাপতির বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মতো এককভাবে সিদ্ধান্- গ্রহণের ক্ষমতা না থাকলেও বাস্তবে সভাপতির ইচ্ছা অনিচ্ছাতেই দলীয় সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। তাছাড়া প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকেন তার উৎস সম্পর্কে জনমনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। গত ২২ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মনোনয়ন বাণিজ্যের যে চিত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তা ভয়াবহ। দলের আর্থিক স্বচ্ছতা যদি নিশ্চিত করা না যায় এবং অর্থের জোরে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা যদি দলের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ প্রতিনিধি হয়ে আসে তাহলে আমরা বার বার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হতেই থাকব। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া জরুরি। রাজনৈতিক দল তথা রাজনীতিবিদদের প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, দেশপ্রেম ও সততার ওপরই নির্ভর করে দেশের সুশাসন ও উন্নয়ন। তাই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে আসুক সেই রাজনীতিবিদরা, যারা রাজনীতিকে শোষিত, বঞ্চিত মানুষের কল্যাণের জন্য ব্রত হিসাবে নিয়েছেন, বাণিজ্য হিসাবে নয়। এ লক্ষ্যে চলমান রাজনৈতিক ধারা ও দলে আমূল সংস্কার প্রয়োজন। প্রয়োজন দলে গণতান্ত্রিক চর্চা, সৎ ও ত্যাগী নেতাদের যথার্থ মূল্যায়নের পরিবেশ সৃষ্টি। এ সংস্কার রাজনৈতিক দলসমূহের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এতে করে যে সংস্কার আসবে তার ফলাফল অনেক বেশি কার্যকর ও টেকসই হবে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে সংস্কারে উদ্যোগী না হয়, তাহলে আইন করেই সংস্কার করতে হবে, যাতে করে জনগণের আশা আকাঙক্ষার ভিত্তিতে দেশপ্রেমিক, সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিগণ দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দিতে পারেন। তবে শুধু সংস্কার করলেই হবে না, সংস্কারের সুফল পাওয়ার লক্ষ্যে জনগণকে সংগঠিত, সচেতন ও সোচ্চার করে তুলতে হবে। আর এ দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সকলকে।
জনাব আ.স.ম আব্দুর রব বলেন, আসল সমস্যা দলে নয়, রাষ্ট্রে, প্রশাসন ব্যবস্থার মধ্যে এবং জনগণের ক্ষমতায়নের মধ্যে। আর এজন্য তিনি রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনার ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, নতুন পদ্ধতি-নতুন ব্যবস্থা-নতুন সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। তিনি সংবিধানের প্রসঙ্গ টেনে বলেন এক ব্যক্তি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী – এর পরিবর্তন হওয়া উচিত। জনাব মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, এ বিষয়গুলিকে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আলোচনায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ব্যক্তি পূজা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এছাড়া তিনি জরুরি অবস্থা তুলে নিয়ে গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য সহায়ক পরিবেশ অচিরেই সৃষ্টি করা প্রয়োজন বলে মন্-ব্য করেন।
জনাব জাফরুল্লাহ চৌধুরী প্রশ্ন রেখে বলেন, বর্তমান সময়ের বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে উল্লেখিত চাঁদার পরিমাণ ১টাকা-৫টাকা কি করে হয়? তিনি চাঁদা ব্যবস্থার পরিবর্তন করে দান গ্রহণের অধিকার থাকা উচিত বলে তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকলে কিংবা না থাকলেও একটি বাৎসরিক কর্মসূচি থাকা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন। জনাব মুহম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, আমাদের যে দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে তার পেছনে শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাব একটি অন্যতম কারণ। তিনি বলেন, কমিটিতে ও সংসদে স্থান পেতে হলে নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা এবং এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচনায় নিয়ে আসা উচিত। এছাড়া তিনি নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহবান রেখে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধনের ক্ষেত্রে একটি মডেল গঠনতন্ত্র সাজেস্ট করা উচিত। আওয়ামী লীগ-এর ওয়েব সাইটে তিন নেতার ছবির মধ্যে একটি সজীব ওয়াজেদ জয়-এর ছবি, বিএনপি’তে তারেক রহমান কীভাবে যুগ্ম মহাসচিব হলেন? এ ধরনের অনেকগুলো প্রশ্ন এবং সমালোচনা উপস্থাপন করে জনাব আসিফ নজরুল বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায়, প্রথাগতভাবে দু’টি প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার সুযোগ থাকলেও এই সুযোগকে রাজনৈতিক দলগুলো কাজে লাগাতে পারছেন না। আদর্শ ও কর্মসূচিভিত্তিক চর্চা না থাকলে গঠনতন্ত্র দিলেও তা কার্যকর হবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন। এছাড়া তিনি গঠনতন্ত্রকে আরো কার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন অত্যন্- জরুরি বলে মন্তব্য করেন।
এছাড়া গোলটেবিল আলোচনায় উত্থাপিত ‘সুজন’-এর প্রস্তাবিত বিষয়সমূহের সাথে উপস্থিত সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেন।
“প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা
Categories: