সমকালীন প্রসঙ্গ

গত ১২ আগস্ট ২০০৯ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্য ১৫ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক নাগরিক পদক ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করেন। প্রফেসর ইউনূসকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। তার এ অপূর্ব স্বীকৃতিতে আমরা গর্বিত। প্রফেসর ইউনূস অতীতেও দেশি-বিদেশি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। সবচেয়ে সেরা ছিল ২০০৬ সালে প্রাপ্ত নোবেল শান্তি পুরস্কার। নোবেল পুরস্কারের মাধ্যমে তিনি এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেন। একইসঙ্গে সেটি ছিল আমাদের গোটা জাতির জন্য একটি বিরল সম্মান। তবে এবারের মার্কিন পদক অন্যদিক থেকে অনন্য। পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রফেসর ইউনূসের সঙ্গী হিসেবে আরও এমন কয়েকজন ছিলেন, যারা এ সময় সারাবিশ্বে সর্বাধিক আলোচিত ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তাদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমানকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এবং মানবতার বিবেক বলে পরিচিত ডেসমন্ড টুটু_ তারা নিজেরাও স্ব-স্ব অঙ্গনে অসাধারণ অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত।
দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশকে নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেকের মনেই বহু নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, দুর্নীতি আর দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ। দারিদ্র্য ও বঞ্চনার দেশ বাংলাদেশ। রাজনৈতিক হানাহানি ও সহিংসতার দেশ বাংলাদেশ। জঙ্গিদের অবাধ চারণভূমি বাংলাদেশ ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব অপবাদের মুখে প্রফেসর ইউনূসের স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে। বাংলাদেশেরও সফলতা আছে এবং আমরাও ‘পারি’_ এমন ধারণা দেশে-বিদেশের অনেকের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। নৈরাশ্যবাদের পরিবর্তে অনেকের মনে বাংলাদেশ সম্পর্কে আশাবাদের সঞ্চার হয়েছে।
কেন প্রফেসর ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেলেন? কেন তাকে আমেরিকার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানে ভূষিত করা হলো? নিঃসন্দেহে এসব স্বীকৃতি তার বাগাড়ম্বরের জন্য নয়। তার বিশ্বব্যাপী পরিচিতির জন্যও নয়। এগুলো তার কাজের স্বীকৃতি। তার অসামান্য অবদানেরই প্রতিদান।
১২ আগস্টের পদক প্রদান অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রফেসর ইউনূসকে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ বা পরিবর্তনের রূপকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি আরও বলেন, প্রফেসর ইউনূস একটি গ্রামের মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে গিয়ে সারা পৃথিবীতে পরিবর্তন এনেছেন। মানুষের ওপর আস্থা রেখে তিনি দারিদ্র্য দূরীকরণের নতুন পথ দেখিয়েছেন। তিনি পৃথিবীর লাখো কোটি জনগণকে এক নতুন ধারণায় উদ্বুদ্ধ করেছেন।
নরওয়ের নোবেল কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী, দারিদ্র্য নামক এক পরাক্রমশালী ভয়াবহ শত্রুর বিরুদ্ধে নিরলস লড়াইয়ের জন্যই তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দারিদ্র্য একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। এটি একটি দুরূহ সমস্যাও এবং নিঃসন্দেহে মানবতার নগ্নতম কলঙ্ক। এ সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধানের জন্য সারাবিশ্বে বহু ব্যক্তি, সংগঠন ও রাষ্ট্র অনেক সময়, শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এর জন্য বহু তত্ত্বকথা গবেষণাগ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও মানবজাতি দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়নি। প্রফেসর ইউনূস এ দানবের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ের ধারণার বাইরে এসে, প্রধানত তৃণমূলের নারীদের সংগঠিত ও ক্ষমতায়িত করার মাধ্যমে_ তাদের ক্ষুদ্রঋণ ও অন্যান্য আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচির আওতায় এনে। তিনি দরিদ্রদের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে কথার ফুলঝুরি ছড়াননি কিংবা তত্ত্বকথার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি ক্ষুদ্রঋণের মতো একটি সৃজনশীল আইডিয়া সামনে নিয়ে এসে তা প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন।
ক্ষুদ্রঋণের কার্যকারিতা নিয়ে আজ অবশ্য অনেকে প্রশ্ন তোলেন। প্রশ্ন তোলেন এর উচ্চ সুদের হার নিয়ে। চর্চার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে এবং তা দূর করাও আবশ্যক। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক ঋণের সুদের হারের মতো, সামষ্টিক মালিকানাধীন ক্ষুদ্রঋণের সুদের হারও যাতে কমতে পারে, সে উদ্যোগ নেওয়াও অত্যাবশ্যক। তবে এটি অনস্বীকার্য যে, দরিদ্ররা রাষ্ট্রীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত এবং দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তাদের জন্য সম্পদের জোগান দেওয়া অতি জরুরি। তাই ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। বস্তুত ক্ষুদ্রঋণ এখন গোটা বিশ্বে একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
আমি নিজে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত নই_ এ ব্যাপারে আমার কিছু ভিন্নমতও আছে। তবে ক্ষুদ্রঋণের সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন কোনোভাবেই প্রফেসর ইউনূসের অসামান্য অবদানকে খাটো করে না। এছাড়াও ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে খাস জলাশয়ে সমবায়ের ভিত্তিতে মাছ চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক উদ্যোগে তার অবদান অনস্বীকার্য।
বহির্বিশ্বে প্রফেসর ইউনূস এক নামে পরিচিত এবং বহুলাংশে তার সুবাদে বাংলাদেশও পরিচিত। এমন বিখ্যাত ব্যক্তির কাছ থেকে আমরা কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি? তার থেকে কী অনুকরণ করতে পারি? তার কাছ থেকে অনুকরণীয় কিছু পেতে হলে, আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে : তার কী আছে, যা আমাদের নেই?
প্রফেসর ইউনূসের অনেক চারিত্রিক গুণ আছে, তার কর্মপদ্ধতির অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা থেকে আমরা শিখতে পারি। তার আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা, অনমনীয়তা ও কর্তব্যনিষ্ঠা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। তিনি একজন কর্মবীর। তিনি লেগে থাকার মানুষ, কয়েক দশক থেকে তিনি লেগে আছেন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে নিরলস লড়াইয়ে, আমাদের বাঙালিদের মধ্যে যা সচরাচর দেখা যায় না। তিনি দারিদ্র্যকে মিউজিয়ামের বস্তুতে পরিণত করার দুঃসাহসিক প্রত্যাশা লালন করেন এবং সে প্রত্যাশা ফেরি করে বেড়ান। সে প্রত্যাশার উদ্দীপনা ও প্রত্যাশা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতির শক্তিই তাকে শত বাধা-বিপত্তির মুখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়।
প্রফেসর ইউনূস শুধু অধ্যবসায়ীই নন, তিনি তার প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে আত্মত্যাগও করেছেন। তিনি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার লোভনীয় কাজ ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন এবং নিজেকে দরিদ্র মানুষের নিত্যসঙ্গীতে পরিণত করেছেন। দরিদ্র মানুষদের তিনি আপন করে নিয়েছেন, তার নিজের অতি সাদামাটা জীবনযাপন এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তার কাজের সঙ্গে দ্বিমত করলেও একথা স্বীকার করতেই হবে যে, তিনি তার নিজের ভবিষ্যৎকে নিবেদিত করেছেন এদেশের দরিদ্রদের জন্য একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ সৃষ্টির কাজে।
নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের শক্তি-সাহস ও সৃজনশীলতার ওপর প্রফেসর ইউনূসের অগাধ বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করেন যে, সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষটিও নিজ ভাগ্য গড়ার কারিগর হতে পারে। সুযোগ ও সহায়ক পরিবেশ পেলে সাধারণ মানুষও অসাধারণ হতে পারে। এ বিশ্বাসই তাকে বিখ্যাত করেছে। সাধারণ মানুষের, বিশেষত দরিদ্র নারীদের শক্তির ওপর আস্থা এবং তাদের কর্মোদ্যোগকে উজ্জীবিত করার ক্ষমতাই তাকে করেছে অতুলনীয়।
প্রফেসর ইউনূসের সফলতায় আমরা গর্বিত হলেও, আমরা হতাশ হয়েছি তার প্রতি আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের অবহেলা দেখে। মার্কিন সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা পদকে ভূষিত হওয়ার পর আমরা দেখিনি সরকারের কিংবা আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে তাকে অভিনন্দিত করতে, যদিও আমাদের রাজনীতিবিদদের অনেকেই যার যা প্রাপ্য, তাকে সে সম্মান প্রদানের পক্ষে। সরকারের পক্ষ থেকে তার জন্য কোনো সংবর্ধনারও আয়োজন করা হয়নি। তারা প্রফেসর ইউনূসের অনন্য স্বীকৃতিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছেন, যদিও আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে পরিচালিত না হওয়ার শপথ নিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত একজন ব্যক্তি কটূক্তিও করেছেন, যা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। একজন বিশাল ব্যক্তিকে ছোট করতে গিয়ে জাতি হিসেবে আমরাও যেন খাটো হয়ে গেলাম!
সাম্প্রতিক সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে আমরা জেনেছি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য নিরসন দিবস উপলক্ষে জাতীয় সংসদের উদ্যোগে আগামী ১৭ অক্টোবর ঢাকায় দারিদ্র্যবিরোধী সর্বদলীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। আমরা আরও জেনেছি যে, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, অমর্ত্য সেনসহ অন্যান্য বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিকে এতে আমন্ত্রণ জানানো হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও এতে উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু আমরা হতাশ হয়েছি দেখে যে, খবরের কাগজে প্রকাশিত আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রফেসর ইউনূসের নাম নেই। বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা ওই সমাবেশে উপস্থিত হলে এতে প্রফেসর ইউনূসের অনুপস্থিতি শুধু সরকারের জন্যই নয়, পুরো জাতির জন্যও বিব্রতকর হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এছাড়াও দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো বিশাল কাজ ক্ষুদ্রত্ব দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়।
শুনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো এত বড়মাপের একজন দার্শনিক-কবিও অনেক অবজ্ঞা, সমালোচনা ও আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরই নাকি এর অবসান ঘটতে থাকে। বাঙালির এমন হীনম্মন্যতাবোধ নিয়ে বনফুল আক্ষেপ করে কবিতা লিখেছিলেন, বাংলাদেশে মরাই ভালো, পারত ভাই পটল তোল… বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমবি্ল’তে প্রদত্ত (৪ নভেম্বর, ১৯৭২) তার সমাপনী ভাষণে অত্যন্ত জোরালোভাবে বলেছিলেন : “বাংলার মানুষ আমরা বুঝতে পারি না, হুজুগে মেতে পরের ছেলেকে বড় করে দেখি… দুনিয়ার কোনো দেশে ‘পরশ্রীকাতরতা’ বলে কোনো শব্দ পাই না বাংলাদেশ ছাড়া। বাঙালি জাতি আমরা পরশ্রীকাতর এত বেশি। ইংরেজি ভাষায়, রুশ ভাষায়, ফরাসি ভাষায়, চীনা ভাষায় ‘পরশ্রীকাতরতা’ বলে কোনো শব্দ নেই_ একমাত্র বাংলাভাষা ছাড়া।”
ড. মুহম্মদ শহীদুলল্গাহ বলেছেন, ‘যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।’ নিঃসন্দেহে এটি একটি অতি প্রজ্ঞাবান উক্তি। যে সমাজে মেধাবী ও প্রতিভাবানদের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, সে সমাজে মেধা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটে না, প্রতিভাবানরা হারিয়ে যায় কিংবা তারা সে সমাজে টিকে থাকতে পারে না। এজন্যই আমাদের মানসিক দীনতার কারণেই আমাদের দেশ থেকে এত ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বা মেধার বহির্গমন, যা জাতি হিসেবে আমাদের পিছে টেনে রাখছে। তাই আজ আমাদের হীনম্মন্যতার ঊধর্ে্ব উঠতে হবে, কারণ ছিদ্রান্বেষণ আর ক্ষুদ্রত্ব নিয়ে ব্যস্ত জাতি সামনে এগোতে পারে না।
দারিদ্র্য একটি মহাশক্তিশালী দানব। এ দানবকে বধ করতে হলে জাতিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। এ দানবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রফেসর ইউনূস একজন বিশ্বস্বীকৃত ও পরীক্ষিত সিপাহসালার। তাই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের বিজয়ী হতে হলে তার কর্মোদ্যম অতি আবশ্যক। বস্তুত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তার নেতৃত্বেই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি সর্বব্যাপী ও সর্বাত্মক মহাযুদ্ধ শুরু হতে পারে। এটি হতে পারে আমাদের জন্য দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ_ অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ মহাযুদ্ধে সফলতার ফসল রাজনীতিবিদদেরই, বিশেষত ক্ষমতাসীনদের ঘরেই উঠবে।
পরিশেষে, দারিদ্র্যকে যদি সত্যিকার অর্থেই মিউজিয়ামের বস্তুতে পরিণত করতে হয়, তাহলে দরিদ্রদের শক্তি-সাহস ও সৃজনশীলতার ওপরই আমাদের ভরসা করতে হবে। তাদের আত্মসম্মানবোধকে সম্মান করতে হবে। তাদের উজ্জীবিত, সংগঠিত, ক্ষমতায়িত ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে নিজের ভাগ্য গড়ার কারিগরে পরিণত করতে হবে, যা আমি নিজে আমার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে করার চেষ্টা করছি। সর্বোপরি দারিদ্র্য দূরীকরণকে একটি গণআন্দোলনে পরিণত করতে হবে। দিতে হবে দরিদ্রদের তাদের প্রাপ্য সম্পদের ন্যায্য হিস্যা। তৈরি করতে হবে তাদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ। আর এই সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই আমাদের বর্তমান বঞ্চনার রাজনীতির অবসান ঘটানো দরকার। দরকার নীতিনির্ধারণে আমূল পরিবর্তন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার
সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
তথ্য সূত্র: দৈনিক সমকাল, ২৬ আগষ্ট ২০০৯
দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশকে নিয়ে দেশে-বিদেশে অনেকের মনেই বহু নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, দুর্নীতি আর দুর্যোগের দেশ বাংলাদেশ। দারিদ্র্য ও বঞ্চনার দেশ বাংলাদেশ। রাজনৈতিক হানাহানি ও সহিংসতার দেশ বাংলাদেশ। জঙ্গিদের অবাধ চারণভূমি বাংলাদেশ ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব অপবাদের মুখে প্রফেসর ইউনূসের স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছে। বাংলাদেশেরও সফলতা আছে এবং আমরাও ‘পারি’_ এমন ধারণা দেশে-বিদেশের অনেকের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। নৈরাশ্যবাদের পরিবর্তে অনেকের মনে বাংলাদেশ সম্পর্কে আশাবাদের সঞ্চার হয়েছে।
কেন প্রফেসর ইউনূস নোবেল পুরস্কার পেলেন? কেন তাকে আমেরিকার সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মানে ভূষিত করা হলো? নিঃসন্দেহে এসব স্বীকৃতি তার বাগাড়ম্বরের জন্য নয়। তার বিশ্বব্যাপী পরিচিতির জন্যও নয়। এগুলো তার কাজের স্বীকৃতি। তার অসামান্য অবদানেরই প্রতিদান।
১২ আগস্টের পদক প্রদান অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রফেসর ইউনূসকে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ বা পরিবর্তনের রূপকার হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি আরও বলেন, প্রফেসর ইউনূস একটি গ্রামের মানুষের জীবনে পরিবর্তন আনতে গিয়ে সারা পৃথিবীতে পরিবর্তন এনেছেন। মানুষের ওপর আস্থা রেখে তিনি দারিদ্র্য দূরীকরণের নতুন পথ দেখিয়েছেন। তিনি পৃথিবীর লাখো কোটি জনগণকে এক নতুন ধারণায় উদ্বুদ্ধ করেছেন।
নরওয়ের নোবেল কমিটির ঘোষণা অনুযায়ী, দারিদ্র্য নামক এক পরাক্রমশালী ভয়াবহ শত্রুর বিরুদ্ধে নিরলস লড়াইয়ের জন্যই তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দারিদ্র্য একটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। এটি একটি দুরূহ সমস্যাও এবং নিঃসন্দেহে মানবতার নগ্নতম কলঙ্ক। এ সমস্যার স্থায়ী ও টেকসই সমাধানের জন্য সারাবিশ্বে বহু ব্যক্তি, সংগঠন ও রাষ্ট্র অনেক সময়, শ্রম ও অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এর জন্য বহু তত্ত্বকথা গবেষণাগ্রন্থে সংযোজিত হয়েছে। তা সত্ত্বেও মানবজাতি দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পায়নি। প্রফেসর ইউনূস এ দানবের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন অর্থনীতির পাঠ্যবইয়ের ধারণার বাইরে এসে, প্রধানত তৃণমূলের নারীদের সংগঠিত ও ক্ষমতায়িত করার মাধ্যমে_ তাদের ক্ষুদ্রঋণ ও অন্যান্য আয়বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচির আওতায় এনে। তিনি দরিদ্রদের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে কথার ফুলঝুরি ছড়াননি কিংবা তত্ত্বকথার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি ক্ষুদ্রঋণের মতো একটি সৃজনশীল আইডিয়া সামনে নিয়ে এসে তা প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন।
ক্ষুদ্রঋণের কার্যকারিতা নিয়ে আজ অবশ্য অনেকে প্রশ্ন তোলেন। প্রশ্ন তোলেন এর উচ্চ সুদের হার নিয়ে। চর্চার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে এবং তা দূর করাও আবশ্যক। ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক ঋণের সুদের হারের মতো, সামষ্টিক মালিকানাধীন ক্ষুদ্রঋণের সুদের হারও যাতে কমতে পারে, সে উদ্যোগ নেওয়াও অত্যাবশ্যক। তবে এটি অনস্বীকার্য যে, দরিদ্ররা রাষ্ট্রীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত এবং দারিদ্র্যের বেড়াজাল থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তাদের জন্য সম্পদের জোগান দেওয়া অতি জরুরি। তাই ক্ষুদ্রঋণ দারিদ্র্য দূরীকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। বস্তুত ক্ষুদ্রঋণ এখন গোটা বিশ্বে একটি আন্দোলনে পরিণত হয়েছে।
আমি নিজে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত নই_ এ ব্যাপারে আমার কিছু ভিন্নমতও আছে। তবে ক্ষুদ্রঋণের সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন কোনোভাবেই প্রফেসর ইউনূসের অসামান্য অবদানকে খাটো করে না। এছাড়াও ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে খাস জলাশয়ে সমবায়ের ভিত্তিতে মাছ চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক উদ্যোগে তার অবদান অনস্বীকার্য।
বহির্বিশ্বে প্রফেসর ইউনূস এক নামে পরিচিত এবং বহুলাংশে তার সুবাদে বাংলাদেশও পরিচিত। এমন বিখ্যাত ব্যক্তির কাছ থেকে আমরা কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি? তার থেকে কী অনুকরণ করতে পারি? তার কাছ থেকে অনুকরণীয় কিছু পেতে হলে, আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে : তার কী আছে, যা আমাদের নেই?
প্রফেসর ইউনূসের অনেক চারিত্রিক গুণ আছে, তার কর্মপদ্ধতির অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা থেকে আমরা শিখতে পারি। তার আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা, অনমনীয়তা ও কর্তব্যনিষ্ঠা নিঃসন্দেহে অতুলনীয়। তিনি একজন কর্মবীর। তিনি লেগে থাকার মানুষ, কয়েক দশক থেকে তিনি লেগে আছেন দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে নিরলস লড়াইয়ে, আমাদের বাঙালিদের মধ্যে যা সচরাচর দেখা যায় না। তিনি দারিদ্র্যকে মিউজিয়ামের বস্তুতে পরিণত করার দুঃসাহসিক প্রত্যাশা লালন করেন এবং সে প্রত্যাশা ফেরি করে বেড়ান। সে প্রত্যাশার উদ্দীপনা ও প্রত্যাশা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতির শক্তিই তাকে শত বাধা-বিপত্তির মুখে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়।
প্রফেসর ইউনূস শুধু অধ্যবসায়ীই নন, তিনি তার প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে আত্মত্যাগও করেছেন। তিনি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার লোভনীয় কাজ ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন এবং নিজেকে দরিদ্র মানুষের নিত্যসঙ্গীতে পরিণত করেছেন। দরিদ্র মানুষদের তিনি আপন করে নিয়েছেন, তার নিজের অতি সাদামাটা জীবনযাপন এতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তার কাজের সঙ্গে দ্বিমত করলেও একথা স্বীকার করতেই হবে যে, তিনি তার নিজের ভবিষ্যৎকে নিবেদিত করেছেন এদেশের দরিদ্রদের জন্য একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ সৃষ্টির কাজে।
নিঃসন্দেহে সাধারণ মানুষের শক্তি-সাহস ও সৃজনশীলতার ওপর প্রফেসর ইউনূসের অগাধ বিশ্বাস। তিনি বিশ্বাস করেন যে, সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষটিও নিজ ভাগ্য গড়ার কারিগর হতে পারে। সুযোগ ও সহায়ক পরিবেশ পেলে সাধারণ মানুষও অসাধারণ হতে পারে। এ বিশ্বাসই তাকে বিখ্যাত করেছে। সাধারণ মানুষের, বিশেষত দরিদ্র নারীদের শক্তির ওপর আস্থা এবং তাদের কর্মোদ্যোগকে উজ্জীবিত করার ক্ষমতাই তাকে করেছে অতুলনীয়।
প্রফেসর ইউনূসের সফলতায় আমরা গর্বিত হলেও, আমরা হতাশ হয়েছি তার প্রতি আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দের অবহেলা দেখে। মার্কিন সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা পদকে ভূষিত হওয়ার পর আমরা দেখিনি সরকারের কিংবা আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে তাকে অভিনন্দিত করতে, যদিও আমাদের রাজনীতিবিদদের অনেকেই যার যা প্রাপ্য, তাকে সে সম্মান প্রদানের পক্ষে। সরকারের পক্ষ থেকে তার জন্য কোনো সংবর্ধনারও আয়োজন করা হয়নি। তারা প্রফেসর ইউনূসের অনন্য স্বীকৃতিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছেন, যদিও আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে পরিচালিত না হওয়ার শপথ নিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত একজন ব্যক্তি কটূক্তিও করেছেন, যা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। একজন বিশাল ব্যক্তিকে ছোট করতে গিয়ে জাতি হিসেবে আমরাও যেন খাটো হয়ে গেলাম!
সাম্প্রতিক সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে আমরা জেনেছি, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য নিরসন দিবস উপলক্ষে জাতীয় সংসদের উদ্যোগে আগামী ১৭ অক্টোবর ঢাকায় দারিদ্র্যবিরোধী সর্বদলীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। আমরা আরও জেনেছি যে, জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন, অমর্ত্য সেনসহ অন্যান্য বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিকে এতে আমন্ত্রণ জানানো হবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও এতে উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু আমরা হতাশ হয়েছি দেখে যে, খবরের কাগজে প্রকাশিত আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রফেসর ইউনূসের নাম নেই। বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা ওই সমাবেশে উপস্থিত হলে এতে প্রফেসর ইউনূসের অনুপস্থিতি শুধু সরকারের জন্যই নয়, পুরো জাতির জন্যও বিব্রতকর হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এছাড়াও দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো বিশাল কাজ ক্ষুদ্রত্ব দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয়।
শুনেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো এত বড়মাপের একজন দার্শনিক-কবিও অনেক অবজ্ঞা, সমালোচনা ও আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছিলেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরই নাকি এর অবসান ঘটতে থাকে। বাঙালির এমন হীনম্মন্যতাবোধ নিয়ে বনফুল আক্ষেপ করে কবিতা লিখেছিলেন, বাংলাদেশে মরাই ভালো, পারত ভাই পটল তোল… বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও ‘কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেমবি্ল’তে প্রদত্ত (৪ নভেম্বর, ১৯৭২) তার সমাপনী ভাষণে অত্যন্ত জোরালোভাবে বলেছিলেন : “বাংলার মানুষ আমরা বুঝতে পারি না, হুজুগে মেতে পরের ছেলেকে বড় করে দেখি… দুনিয়ার কোনো দেশে ‘পরশ্রীকাতরতা’ বলে কোনো শব্দ পাই না বাংলাদেশ ছাড়া। বাঙালি জাতি আমরা পরশ্রীকাতর এত বেশি। ইংরেজি ভাষায়, রুশ ভাষায়, ফরাসি ভাষায়, চীনা ভাষায় ‘পরশ্রীকাতরতা’ বলে কোনো শব্দ নেই_ একমাত্র বাংলাভাষা ছাড়া।”
ড. মুহম্মদ শহীদুলল্গাহ বলেছেন, ‘যে দেশে গুণের সমাদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মাতে পারে না।’ নিঃসন্দেহে এটি একটি অতি প্রজ্ঞাবান উক্তি। যে সমাজে মেধাবী ও প্রতিভাবানদের স্বীকৃতি দেওয়া হয় না, সে সমাজে মেধা ও প্রতিভার বিকাশ ঘটে না, প্রতিভাবানরা হারিয়ে যায় কিংবা তারা সে সমাজে টিকে থাকতে পারে না। এজন্যই আমাদের মানসিক দীনতার কারণেই আমাদের দেশ থেকে এত ‘ব্রেইন ড্রেইন’ বা মেধার বহির্গমন, যা জাতি হিসেবে আমাদের পিছে টেনে রাখছে। তাই আজ আমাদের হীনম্মন্যতার ঊধর্ে্ব উঠতে হবে, কারণ ছিদ্রান্বেষণ আর ক্ষুদ্রত্ব নিয়ে ব্যস্ত জাতি সামনে এগোতে পারে না।
দারিদ্র্য একটি মহাশক্তিশালী দানব। এ দানবকে বধ করতে হলে জাতিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। এ দানবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রফেসর ইউনূস একজন বিশ্বস্বীকৃত ও পরীক্ষিত সিপাহসালার। তাই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের বিজয়ী হতে হলে তার কর্মোদ্যম অতি আবশ্যক। বস্তুত সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় তার নেতৃত্বেই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে একটি সর্বব্যাপী ও সর্বাত্মক মহাযুদ্ধ শুরু হতে পারে। এটি হতে পারে আমাদের জন্য দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ_ অর্থনৈতিক মুক্তির যুদ্ধ। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এ মহাযুদ্ধে সফলতার ফসল রাজনীতিবিদদেরই, বিশেষত ক্ষমতাসীনদের ঘরেই উঠবে।
পরিশেষে, দারিদ্র্যকে যদি সত্যিকার অর্থেই মিউজিয়ামের বস্তুতে পরিণত করতে হয়, তাহলে দরিদ্রদের শক্তি-সাহস ও সৃজনশীলতার ওপরই আমাদের ভরসা করতে হবে। তাদের আত্মসম্মানবোধকে সম্মান করতে হবে। তাদের উজ্জীবিত, সংগঠিত, ক্ষমতায়িত ও আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে নিজের ভাগ্য গড়ার কারিগরে পরিণত করতে হবে, যা আমি নিজে আমার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে করার চেষ্টা করছি। সর্বোপরি দারিদ্র্য দূরীকরণকে একটি গণআন্দোলনে পরিণত করতে হবে। দিতে হবে দরিদ্রদের তাদের প্রাপ্য সম্পদের ন্যায্য হিস্যা। তৈরি করতে হবে তাদের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ। আর এই সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই আমাদের বর্তমান বঞ্চনার রাজনীতির অবসান ঘটানো দরকার। দরকার নীতিনির্ধারণে আমূল পরিবর্তন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার
সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
তথ্য সূত্র: দৈনিক সমকাল, ২৬ আগষ্ট ২০০৯