সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক বিবৃতি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহর ও সুজন সম্পাদকের বাড়িতে হামলা: ঘটনার বিবরণ

মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গাড়িবহর ও সুজন সম্পাদকের বাড়িতে হামলা: ঘটনার বিবরণ


গত ৪ আগস্ট ২০১৮, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট আমার মোহাম্মদপুরস্থ ১২/২, ইকবাল রোডের বাসায় একটি নৈশভোজ শেষে ফেরার পথে বাসার সামনে একদল সশস্ত্র দুর্বৃত্ত কর্তৃক আক্রমণের শিকার হন। একই সময়ে দুর্বৃত্তরা আমার বাড়িতেও হামলা চালায়। এই হামলার ঘটনাটি নিয়ে স্বার্থান্মেষী মহল নানাভাবে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের গল্প ফাঁদছে এবং বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে। ঘটনাটিকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার এ অপচেষ্টার প্রেক্ষিতে আমি এর বিবরণ নিম্নে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরলাম।

ঘটনার প্রেক্ষাপট:
বাংলাদেশে নিযুক্ত বিদায়ী মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটকে আমি এবং আমার স্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে বহুদিন থেকেই চিনি। গত ৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস পালন উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আমি তাঁকে তাঁর বিদায়ের প্রাক্কালে আমার পরিবারের সঙ্গে একটি নৈশভোজে অংশ নেওয়ার আমন্ত্রণ জানাই। রাষ্ট্রদূত তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং তারিখ নির্ধারণের লক্ষে তাঁর প্রটোকল কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের অনুরোধ করেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে ৯ জুলাই আমি তাঁর প্রটোকল কর্মকর্তাকে একটি ইমেইল পাঠাই। একই দিনে আরেকটি ইমেইলের মাধ্যমে তিনি আমাকে ০৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৭:৩০ টায় নৈশভোজটি আয়োজনের সময় দেন। দূতাবাসের প্রটোকল অনুযায়ী নৈশভোজের স্থান, সময় ও অংশগ্রহণকারীদের তালিকা সবই ইমেইলের মাধ্যমে তাদেরকে পাঠানো হয়। নৈশভোজের সময়, উদ্দেশ্য ও উপস্থিত অতিথিদের তালিকা নিয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচার যে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও সর্বৈব মিথ্যা তা এই ইমেইলগুলো দেখলেই যে কেউই বুঝতে পারবেন।

০৪ আগস্ট ২০১৮: যা ঘটেছিল:
০৪ আগস্ট ২০১৮, সন্ধায় আমার বাসায় নৈশভোজে যোগ দেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট, ড. কামাল হোসেন ও তার স্ত্রী ড. হামিদা হোসেন এবং জনাব এম হাফিজউদ্দিন খান। এই দুই দম্পতির সঙ্গে পারিবারিকভাবে আমরা বহুদিন থেকেই ঘনিষ্ঠ। অসুস্থতার কারণে জনাব খানের স্ত্রী উক্ত নৈশভোজে যোগ দিতে পারেননি। উপরোক্ত চারজন ছাড়া আমি, আমার স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ ও দুই কন্যা-সহ মোট দশজন নিয়ে ছিল এই নৈশভোজের আয়োজন।

রাত আনুমানিক ১১টার সময় রাষ্ট্রদূত যখন আমার বাসা থেকে চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলেন, তখন একদল দুর্বৃত্ত-যাদের সংখ্যা আনুমানিক ৩০-৪০ জন-তাঁর গাড়িতে হামলা করে। তারা তাঁর গাড়ী এবং আমার ছেলে, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের কোচ, ড. মাহবুব মজুমদারের ওপর আক্রমণ করে। দুর্বৃত্তরা জনাব বার্নিকাটের গাড়ির পেছন পেছন ধাওয়া করে এবং ইট-পাটকেল ছুঁড়ে মারে। তারা পিস্তল ও লাঠিসোটা বহন করছিল এবং জনাব রাষ্ট্রদূতের গাড়িতে আগুন দেওয়ারও উস্কানি দিচ্ছিল।

রাষ্ট্রদূতের গাড়ি দ্রুততার সাথে স্থান ত্যাগ করার পর দুর্বৃত্তরা দোতলায় অবস্থিত আমার বাসায় হামলা চালায়। তারা আমার বাসায় ইট-পাটকেল ছুঁড়ে জানালার কাঁচ ভাঙচুর করে এবং গেট ভেঙ্গে বাসায় ঢোকারও চেষ্টা করে। যদি তারা আমাদের বাসায় ঢুকতে সক্ষম হত, তাহলে আরও গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। আমরা সাথে সাথে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি সার্ভিস ‘৯৯৯’ নাম্বারে কল করি। দুর্বৃত্তরা প্রায় আধা ঘণ্টা আমাদের বাসার সামনে অবস্থান করে ও তাণ্ডব চালায় এবং আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করতে থাকে। তারা দিনের বেলায় আমাদেরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিতে থাকে।

আমাদের ‘৯৯৯’ নাম্বারে কল করার প্রেক্ষিতে হামলা শেষ হবার পর পুলিশ আসলেও আমাদের সঙ্গে কথা না বলে এবং আমাদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা না করেই চলে যায়, যদিও আমরা তখন চরমভাবে আতঙ্কগ্রস্ত ছিলাম।

০৫ আগস্ট ২০১৮: অভিযোগ দাখিল:
০৪ আগস্ট ২০১৮, সকালে আমি আমার তিনজন সহকর্মীসহ উপরোক্ত ঘটনাটির বিবরণ তুলে ধরে মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করি। আমি তাঁকে জানাই যে, দুর্বৃত্তদের হামলার কারণে আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এছাড়া চিঠিতে ঘটনাটি সম্পর্কে একটি মামলা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাই এবং একইসঙ্গে আমি এবং আমার পরিবারকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রদানেরও অনুরোধ করি। থানার পক্ষ থেকে জানানো হয়, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে তারা জানাবেন যে এ বিষয়ে মামলা হবে, না-কি এটি জিডি হিসেবে গ্রহণ করা হবে। কিন্তু পরবর্তীতে থানা থেকে আমাদেরকে কিছু জানানো হয়নি। যদিও আমরা গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পারি যে, আমার অভিযোগটিকে জিডি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।

ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হাজির করার অপচেষ্টা:
যদিও নৈশভোজের বিষয়টি ছিল নিতান্তই একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান এবং এর তারিখ নির্ধারণ করা হয় নিরাপদ সড়কের দাবিতে কিশোর বিক্ষোভ শুরুর ২০ দিন আগে, তথাপিও মহলবিশেষ এটিকে নিয়ে একটি ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হাজির করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছে। এটিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যে গণমাধ্যমগুলোকে তারা ব্যবহার করছে এবং নৈশভোজটিকে ‘ষড়যন্ত্র সভা’, ‘গোপন বৈঠক’ বলে অভিহিত করছে। একইসঙ্গে সেই নৈশভোজের সাথে কোনো ধরণের সংস্রবহীন আরও কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের নাম তারা এতে জড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, পুলিশের বরাত দিয়ে বিডিনিউজ২৪.কম (৬ আগস্ট ২০১৮) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আমার বাসার নৈশভোজে ‘ড. কামাল হেসেন, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, এম হাফিজউদ্দিন খান, বিচারপতি আব্দুর রউফসহ বেশ কয়েকজন উপস্থিত’ থাকার কথা বলা হয়। এটি একটি সর্বৈব অপপ্রচার, কারণ এই পরিবারিক অনুষ্ঠানে ড. হোসেন ও খান দম্পতি ব্যতীত বাইরের অন্য কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি এবং কেউ উপস্থিতও ছিলেন না।

প্রসঙ্গত, আমার জানামতে রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখাশোনার দায়িত্ব ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশের (ডিএমপির) ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি ডিভিশনের। রাষ্ট্রদূত আমার বাসায় যখন আসেন তখন তাঁর সাথে সিকিউরিটি প্রটেকশনের দুটি সরকারি গাড়ী ছিল এবং তাদের তৎপরতার ফলেই তিনি ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত প্রস্থান করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

রাষ্ট্রদূতের ওপর হামলা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্যে যেমন ক্ষতিকর, তেমনি এটিকে নিয়ে মহলবিশেষের অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বের আশ্রয় নেয়াও অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আমি এই ন্যাক্কারজনক হামলা ও অপপ্রচারের তীব্র প্রতিবাদ এবং সকল মহলকে দায়িত্বশীল আচরণ করার আহবান জানাই। একইসঙ্গে আমি এঘটনার দ্রুত বিচার চাই এবং আমার ও আমার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাই।

পিডিএফ ডাউনলোড

Related Post

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের ওপর হামলার ঘটনায় সুজন-এর উদ্বেগনারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের ওপর হামলার ঘটনায় সুজন-এর উদ্বেগ

১৭ জানুয়ারি ২০১৮ আমরা সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছি যে, গতকাল ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, নারায়ণগঞ্জ শহরে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের

প্রকাশক হত্যাসহ ব্লগারদের ওপর আক্রমণকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবিপ্রকাশক হত্যাসহ ব্লগারদের ওপর আক্রমণকারীদের অবিলম্বে গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি

আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, বেশ কিছুদিন ধরে মুক্তমনা লেখক ও ব্লগারদের একের পর এক হত্যা করা হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল ৩১ অক্টোবর হত্যার উদ্দেশ্যে নৃশংস জোড়া হামলা