অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
অর্থমন্ত্রী শিল্পক্ষেত্রের ব্যাপক প্রসার চেয়েছেন। তিনি জিডিপিতে শিল্পের অংশ বর্তমান ১৫ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে প্রস্তাব করেছেন। আমাদের জনসংখ্যা, বেকারত্ব এবং নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। স্মরণীয় যে, আমাদের দেশে প্রযুক্তি বিদেশ থেকে আনা হয়। বিদেশে এখন পুঁজিঘন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে এবং প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করে। সুতরাং আমাদের এখানে শিল্প প্রসারণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের জন্য লাগসই শ্রমঘন প্রযুক্তি আমাদেরকেই উদ্ভাবন করতে হবে। সেজন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে যথাযথ বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ খাতে এজন্য যথার্থ মানবসম্পদ সৃষ্টি প্রয়োজন এবং গবেষণার জন্য যথার্থ সুযোগ সৃষ্টিসহ শিল্প ও শিক্ষার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী মূলত ব্যক্তি খাতের প্রসারণের মধ্যদিয়ে শিল্পখাতে উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ সংক্রান্ত আইন-কানুন পর্যাপ্ত সরবরাহ ও ঋণপ্রবাহকে গুরুত্ব দিয়েছেন। শিল্পখাতের জন্য ইশতেহারে পাটশিল্পের পূনরুজ্জীবনের কথা বলা হলেও এ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেখা যায় না। আইটি, পোশাক, টেক্সটাইল, জাহাজ নির্মাণ, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, ঔষধ, চামড়া ইত্যাদি খাতকে অগ্রাধিকার দেয়ার যে বিষয়টি ইশতেহারে আছে সেটি সম্ভবত শিল্পনীতিতে আলোচিত হবে কিন্তু আইটি খাত ছাড়া অন্য খাতে বাজেট প্রস্তাবনায় বিশেষ উল্লেখ লক্ষ্য করা যায় না। ইশতেহারে পুঁজি বাজারের বিকাশ সম্পর্কে যে আলোচনা আছে তারই আলোকে অর্থমন্ত্রী পুঁজিবাজারের গভীরতা বাড়াতে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানীর শেয়ার অফলোডি, মিউচ্যুয়াল ফান্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন মার্চেন্ট ব্যাংকের নিবন্ধন, মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের প্রশিক্ষণসহ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রস্তাবনা করেছেন। আশা করেছেন দেশী ও বিনিয়োগকারিগণ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত বোধ করবে এবং পুঁজিবাজার দীর্ঘমেয়াদী অর্থসংগ্রহের উৎস হিসেবে যথার্থ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। এই সমস্ত প্রস্তাবনায় প্রশাসনিক জটিলতা দূরীকরণ এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতামুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির বিষয়টি জেনেও উপেক্ষিত হয়েছে। উল্লেখ করা যায়, পুঁজিবাজারে ছোট ও মাঝারি শিল্পের অংশগ্রহণ থাকে না। এসব শিল্প তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে এদের ক্রমান্বয়িত উত্তরণের জন্য পুঁজিবাজারের ভিন্নতর সাংগঠনিক বিবর্তন প্রয়োজন। এদেশের যেহেতু ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের সংখ্যা অনেক বেশি, এক্ষেত্রে শ্রমিকের ও সমবায়ীদের মালিকানা নিশ্চিতকরণের জন্য যথাযথ প্রস্তাবনার প্রয়োজন রয়েছে, তা না হলে পুঁজিঘন শিল্প বিকাশের মাধ্যমে আয় বৈষম্য ও ধন বৈষম্যের সাথে সামাজিক বৈষম্য ও রাজনৈতিক ক্ষমতার বৈষম্য বৃদ্ধি পাবে। ৭২-এর সংবিধানের মালিকানা সম্পর্কিত ধারণা এ প্রস্তাবনায় গুরুত্ব পায়নি।
শিল্প বিকাশের জন্য প্রয়োজন হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিকাশ এবং এক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি নৈরাশ্যজনক। সার্কভুক্ত দেশের তুলনায় আমাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহার অতি নগণ্য। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে, বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য অতিরিক্ত লাইন স্থাপনের প্রস্তাবনা করা হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎসহ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সম্ভাব্য সকল উৎস ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাবও করা হয়েছে। আমাদের প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু জ্বালানি উৎপাদন, সংরক্ষণ, আমদানি বিতরণ এবং বিভিন্ন খাতের ব্যবহার সম্পর্কিত পরিবেশবান্ধব, গৃহস্থালীবান্ধব, ক্ষুদ্রশিল্পবান্ধব একটি নীতি। ইশতেহারে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে এবং তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান ও পশ্চিমাঞ্চলে এলপিজি সরবরাহের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। বাজেট প্রস্তাবনায় ২০১৩ সাল নাগাদ ৫০০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের প্রস্তাবনা রয়েছে। বাপেক্সের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও বিদ্যুৎ সংক্ষরণের প্রস্তাবনায় সাশ্রয়ী বাল্ব ব্যবহারের দিকেও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। বাজেট প্রস্তাবনা থেকে অনুমান হয় সরকারি খাতের চাইতে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরতা বাড়বে। পুঁজির চাহিদার কারণে এটা স্বাভাবিক মনে হলেও উন্নয়নের একটি অতি প্রয়োজনীয় উপকরণে যেন যথাযথ নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং কোনো গোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্য বা সিন্ডিকেশনের সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
বাজেট প্রস্তাবনায় মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য এবং এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বার্থে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চতর, কারিগরি, পেশাগত শিক্ষা সব বিষয়েই সুযোগ সম্প্রসারণের প্রস্তাবনা রয়েছে। আমাদের শিক্ষাকে জীবনঘনিষ্ঠ, বিজ্ঞানমুখি, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক সক্ষমতা অর্জনের দিকে সবিশেষ দৃষ্টির প্রয়োজন আছে। আমরা এখনো সবার জন্য শিক্ষাকে নিশ্চিত করতে পারিনি। কমিউনিটি বিদ্যালয় এবং অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয় শিক্ষার যথাযথ উপকরণ ও শিক্ষকের অভাবে মানহীন শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটেনি। উচ্চশিক্ষার জনগণের অংশগ্রহণও সীমিত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় অংশগ্রহণ বাণিজ্য ও সাধারণ শিক্ষার চাইতে তুলনামূলকভাবে কম। বিজ্ঞান শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত। বিভিন্ন শিক্ষাক্ষেত্রে যথাযথ প্রশিক্ষিত শিক্ষকের দারুণ অভাব। কার্যকর পাঠ্যক্রম এবং সৃজনশীল ক্ষমতাসৃষ্টিকারী শিক্ষাক্রম এখন পর্যন্ত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলেও ছাত্র-শিক্ষকের নিকট পৌঁছেনি। দারিদ্র্য এখনো শিক্ষায়অংশগ্রহণকে সীমিত করে রেখেছে। এ সমস্ত সমস্যা উত্তরণের জন্য সমন্বিত শিক্ষা নীতির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এছাড়াও প্রতিবন্ধী ও আধিবাসীদের জন্য যথার্থ শিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। ইশতেহারে মানবসম্পদ উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেইসাথে শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষাঙ্গনকে দলীয়করণমুক্ত, শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতনকাঠামো, স্বতন্ত্র কর্মকমিশন এবং পর্যায়ক্রমে স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। যে দেশে ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা বর্তমান এবং তিন ধরনের শিক্ষার মাধ্যম উপস্থিত এবং যেখানে শিক্ষাকে পণ্য করে বিনিয়োগের একটি বেসরকারি প্রচেষ্টা তীব্র হয়ে উঠছে সেখানে অবৈতনিক সেবা, স্বতন্ত্র কর্মকমিশন, উচ্চতর বেতন কাঠামো, শিক্ষার মানোন্নয়ন ইত্যাদির সমন্বয় সমস্যাসঙ্কুল। বর্তমানের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষার সম্প্রসারণ, বেসরকারি খাতে শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি, বিনামূল্যে বই বিতরণ, বিদ্যালয় পুনর্নির্মাণ, উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিং ছাড়া মৌলিক বিষয়ের দিকে তেমন কোনো দৃষ্টিপাত করা হয়নি। আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে যে বিশাল বিনিয়োগ ও পুনঃচলমান খরচ মেটানোর অর্থসংস্থান প্রয়োজন সে বিষয়ে কোনো আলোচনাই ইশতেহারে বা বাজেট প্রস্তাবনায় লক্ষ্য করা যায় না।
বাজেট প্রস্তাবনায় নারী কীভাবে বাজেটের মাধ্যমে উপকৃত হয় তার একটি আলোচনা সংযুক্ত হয়েছে। এটাকে জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটের উদাহরণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। জেন্ডার টার্গেটেড বরাদ্দ ছাড়াও জেন্ডার নিউট্রাল প্রকল্প থেকে নারীরা উপকৃত হন। কারণ সে প্রকল্পগুলো সকল মানুষের জন্য। অবশ্য কতটুকু উপকৃত হন সেটা নির্ভর করে অংশগ্রহণের ওপরে। সে কারণে যেমন জেন্ডার টার্গেটেড প্রকল্পের ব্যবস্থা থাকতে হবে, তেমনি জেন্ডার নিউট্রাল প্রকল্পগুলোতে জেন্ডার সংবেদনশীলতা বাড়াতে হবে। প্রকল্প প্রণয়নে এ কারণে কেবল টেকনিক্যাল সম্ভাবনা ও প্রস্তাবনা ছাড়াও পরিবেশবান্ধব বিবেচনার মতোই জেন্ডার সংবেদনশীলতা সামাজিক অভিঘাত বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এজন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা ও প্রকল্প প্রণয়ন কৌশলে অনেক কৌশলগত পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত না করে কেবলমাত্র বরাদ্দ দেখিয়ে জেন্ডার সংবেদনশীলতা স্বপ্রমাণ করা যায় না। আমাদের বাজেট প্রস্তাবনায় নারীর অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত করা, নারীদের পদায়নে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া, নারীর ক্ষমতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেয়া এবং নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধের সদিচ্ছা প্রকাশ করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্ষমতায়নের জন্য শিশুর অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত করতে প্রস্ফুটিত প্রস্তাবনার প্রয়োজন রয়েছে, যেটি বাজেট প্রস্তাবনায় লক্ষ্যণীয় নয়। ইশতেহারে নারীর সম-অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষে ‘নারী উন্নয়ন নীতি’ পুনর্বহাল এবং নারী নির্যাতন বন্ধে কঠোরতম আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং সকল বৈষম্যমূলক আইন সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেট প্রস্তাবনায় এ সকল বিষয়ে কোনো পদক্ষেপের উল্লেখ নেই। সম্ভবত এটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী কার্যক্রমের মধ্যে আবৃত আছে।
পরিবেশ জলবায়ু সঙ্কটের কারণে এখন একটি বহুল আলোচিত বিষয়। ইশতেহারে নদী-খনন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী ভাঙন রোধ, পানি সংরক্ষণ, বনাঞ্চল রক্ষা এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা আছে। বাজেট প্রস্তাবনায় জলবায়ু পরিবর্তনের যে বিরূপ প্রভাব কৃষি, মৎস্য ও জীব বৈচিত্র্যের ওপর পড়েছে সে বিষয়ে কর্ম-পরিকল্পনা ও কৌশলের পর্যালোচনার কথা বলা হয়েছে। এ সাথে আসছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগ মোকাবিলায় নিজস্ব উদ্যোগ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সমুন্নয়নের কথা। বিপর্যয় মোকাবেলায় তহবিল গঠনের কথা উল্লেখ আছে। ২০১৫ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ ভূমি বনায়ন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বনায়নের ক্ষেত্রে সমাজিক বনায়নকে প্রকৃতি প্রদত্ত বন এবং রিজার্ভ বনাঞ্চলকে আলাদা বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। চা বাগানের সাথে যে বনাঞ্চল আছে সেটাও সুরক্ষার প্রয়োজন আছে। পাবর্ত্য অঞ্চলে নতুন অর্থকরী ফসলের নামে যে রাবার বাগান বা চা বাগান বা আনারস এবং তামাক চাষ হচ্ছে, তার ফলে যে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে – সে বিষয়টিও বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। সুন্দরবন এলাকায় প্রাকৃতিক ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন, যেটা আমাদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করবে। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলে বনায়ন সৃষ্টি প্রাগ্রাধিকার পাওয়া প্রয়োজন। বাজেটের উপস্থাপনায় সুন্দরবন ছাড়া অন্য বিষয়গুলো যথাযথ উল্লেখ পায়নি। বাজেট বক্তৃতায় নৌ-পথ উন্নয়ন, পানি সম্পদের সংরক্ষণ ও যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা, লবণাক্ততা প্রতিরোধ, জলাবদ্ধতা দূর এবং বন্যামুক্ত অঞ্চল সৃষ্টি, সেচ-সুবিধার সম্প্রসারণ, নদীভাঙন রোধ – এ সবেরই উল্লেখ আছে। কিন্তু চলনবিল, বিভিন্ন হাওর অঞ্চল, ভরাট হয়ে যাওয়া নদী ও ভরাট করা জলাশয় উদ্ধার এসব দিকে উল্লেখ যেমন কম বরাদ্দও তেমনই কম। পরিবেশ দুষণে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, ঘরের অভ্যন্তরের পরিবেশ দূষণ, হাসপাতালের বর্জ্য এবং গৃহস্থালীর বর্জ্য, শিল্প- বর্জ্য, বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির বিষয়ে আরো দৃষ্টি দিলে স্বাস্থ্যসম্মত, পরিবেশবান্ধব, পরিকল্পিত নগর সম্ভব হয়ে উঠবে। বাজেটে এদিকে যথাযথ দৃষ্টি নেই।
এবারের বাজেট ধারাবাহিকতার বাজেট। বাজেটের নতুন দিক হচ্ছে সরকারের রাজনৈতিক নীতিমালা বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারকে বাজেট আলোচনায় প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আর তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা বৈধ করার যে সুযোগ দেয়া হয়েছে তা নীতি ও নৈতিকতার দিক থেকে কতটা ঠিক হয়েছে সেটাও ভাবনার বিষয়। বাজেট যত বড়ই হোক না কেন সেটা যথাযথ বাস্তবায়নে সরকার কতটা সফল হবে সেটা দেখতে হবে। এবারের বাজেটে সরকারি-বেসরকারি অংশিদারিত্বকে নতুন বলা হচ্ছে, আসলে এটা নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিষয়টি আমাদের বাজেটগুলোতে ছিল। তবে তা উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে ঢোকানো থাকতো। এর অধীনে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হতো সেগুলো বিওপি, বিওটির আওতায় বাস্তবায়ন হতো। তবে একটি দিক থেকে এটিকে নতুন বলে দাবি করার চেষ্টা করা হয়ে থাকতে পারে। আর সেটা হচ্ছে, এবারই প্রথম এটাকে আলাদা খাত হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক গুরুত্বের বিবেচনায়ও এটি নতুন হতে পারে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি একটি কার্যকর দিক। এটি যে নতুন কিছু নয়, অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেও তার প্রমাণ মেলে। তিনি বলেছেন, এ ব্যবস্থা বিশ্বের অনেক দেশেও চালু আছে। এবারের বাজেটে তিনি মন্ত্রণালয় ধরে ধরে কথা বলেছেন। সেখানে আওয়ামী বা মহাজোট সরকারের জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি তার প্রেক্ষাপটে তিনি তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন। এর আগের বাজেটগুলোতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় দায়িত্বগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করে দেয়া হতো না। এর ফলে বাজেট বাস্তবায়নে কোন্ মন্ত্রণালয়ের দায় কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকতো না। এবারের বাজেটে কোন্ কোন্ মন্ত্রণালয়ের কি কি কাজ এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে সেই সঙ্গে কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে, সেইসব বিষয় চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যে জায়গা তৈরির প্রয়াস চালানো হয়েছে তা কার্যকর করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেলে ভালো হতো। তিনি বাজেট তৈরির সময় এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিশ্চয়ই আলোচনা করেছেন। তবে এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর সাথে আলোচনা করেছেন কি-না জানি না, আলোচনা করলে ভালো। কারণ মন্ত্রণালয়ের উনারশীপ নিশ্চিত করা না গেলে প্রকল্প বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়ে, ফলে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হয় না।
আমরা নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে বাজেটে প্রস্তাবিত বিভিন্ন পদক্ষেপের আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, অর্থমন্ত্রী ম্যাক্রো ফ্রেমওয়ার্কের চাইতে খাতওয়ারী যে সমস্ত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে দেয়া হয়েছে সেদিকে অধিকতর দৃষ্টি দিয়েছেন। একথা বলা যায় যে, ইশতেহারে অনেকক্ষেত্রেই কৌশলগত দিক-নির্দেশনা ছিল। একই উদ্দেশ্য অর্জনে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে নানা প্রস্তাবনা রেখেছেন। তিনি বিকল্পগুলো বিবেচনা করেছেন কি-না সেটা পরিচ্ছন্ন নয়। এই কারণে ইক্যুইটি ও এফিসিয়েন্সির বিবেচনা একেবারেই অনুপস্থিত। অন্যদিকে এটাও লক্ষ্যণীয়, বাজেট বিবেচনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইশতেহারের নানা প্রতিশ্রুতি অনেক বেশিই গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন: কৃষি খাত, শিল্প খাতের চাইতে সঙ্গত কারণেই অধিক বিবেচনার দাবিদার হয়েছে। একইভাবে ই-গর্ভান্সের ব্যাপারে বাজেট ব্যবস্থাপনায় অনেক উচ্চারণ লক্ষ্যণীয়। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিদ্যমান নানা কৌশলকে প্রসারিত করার বিষয়টি যত সহজে বলা যায়, তত সহজে জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়ে নির্দিষ্ট প্রস্তাবনা উপস্থাপিত করা অধিক কষ্টসাধ্য। দারিদ্র্য নিরসন সম্পর্কে বিদ্যমান নানা প্রকল্প ও কর্মকৌশল থাকায় সে বিষয়ে আলোচনা অনেক সহজ হয়েছে।
যোগাযোগ খাতে নানা প্রস্তাবনা এসেছে, যদিও এ বিষয়ে ইশতেহারে তেমন বিস্তৃত ধারণা দেয়া হয়নি। মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কে যত সহজে শিৰা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, একইভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে বিবেচনায় অনেক ঘাটতি লৰ্যণীয়। এ বিষয়ে আমাদের উপরে যে আলোচনা তা থেকে এই উপসংহার টানা সম্ভব যে, ইশতেহারে বর্ণিত লৰ্যসমূহের যেহেতু অগ্রাধিকারভিত্তিক কোনো নির্দেশনা ছিল না, সেহেতু বাজেটে অর্থব্যয় প্রাক্কলনে এ বিষয়টি ধারাবাহিকতার কারণে উপেৰিত থেকে গেল।
আমরা আশা করব, ভবিষ্যতের যে বাজেট নির্মাণ ও কাঠামোর ইঙ্গিত অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন তার ফলে ইশতেহারে বর্ণিত নানা ইচ্ছার সাথে প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্য দূরীকরণ নিশ্চিত করার জন্য যে চলমান ম্যাক্রো কাঠামো নির্মাণ করা হবে, তার মাধ্যমে একটি সুসমন্বিত বাজেট প্রণয়ন সম্ভব হবে – যেখানে ইউনিয়ন থেকে সকল স্থানীয় সরকারের পর্যায়ে নির্দিষ্ট ও প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ব্যয় ও সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং তারই মাধ্যমে উন্নীত একটি আর্থসামাজিক বিবর্তনসহ ভৌত ও সামাজিক পুঁজির বিকাশের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক বৈষম্য, আন্তঃসামাজিক বৈষম্য দূর করে সবার জন্য সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করা যাবে। বর্তমান বাজেটে এই সমন্বয়টির অভাব লৰ্য করা যায়। তবে অর্থমন্ত্রী নির্বাচনকালে দেয় প্রতিশ্রম্নতির প্রতি যে গুরম্নত্ব দিয়েছেন সেটি ভবিষ্যতে বাজেট প্রণয়নে ও তার বিবেচনায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই আশা করি। (সমাপ্ত)
[লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সভাপতি, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক]
তথ্য সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২৭ জুন ২০০৯
মুহিতের মোহিতকরণ বাজেট
Categories: