অ ধ্যা প ক মো জা ফ্ ফ র আ হ ম দ
গতকালের পর
দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বর্তমান সরকার আগের মতোই টিআর, ভিজিএফ, কাবিখা ছাড়াও বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, নিম্ন আয়ের কর্মজীবী মায়ের ভাতা বৃদ্ধি ও ক্ষেত্র প্রসারণের প্রস্তাব করেছে। এছাড়াও পিতৃ-মাতৃহীন শিশুর কল্যাণ, পথশিশুদের কল্যাণ, দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলা, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান, প্রতিবন্ধী সেবা, দরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান, সৃজনমূলক প্রশিক্ষণ, মেটার্নাল হেলথ ভাউচার ইত্যাদির মাধ্যমে দারিদ্র্যের অভিঘাত সীমিত করার প্রচেষ্টা ও কর্মপ্রস্তাবনা বাজেটে লক্ষ্য করা যায়। এ সমস্তই দান-অনুদানের ব্যাপার। দরিদ্র মানুষের সক্ষমতা সৃষ্টি, শিক্ষা ও কর্মের সুযোগ সৃষ্টি, উৎপাদনে অংশিদারিত্বসহ সম্পদ প্রবাহের সাথে সম্পদ সৃষ্টি বিপণন ও এর লভ্যাংশের সাথে অর্থবহ সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে আত্মশক্তিতে বলীয়ান না করা হলে টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হয় না। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ন্যাশনাল ফুড পলিসির ক্যাপাসিটি স্ট্রেনথেনিং প্রোগ্রাম-এর মাধ্যমে খাদ্য নীতিমালা ১১টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে প্রণীত ও তাঁর অধীনে কর্ম-পরিকল্পনা তৈরি হবে বলে জানানো হয়েছে। উদ্দেশ্য খাদ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি, খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা ও খাদ্য নিরাপত্তা বেষ্টনীর কলেবর বৃদ্ধি। লক্ষ্যণীয় এ সবই উপর থেকে দেয়া দান-অনুদানের ব্যাপার। এখানে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর কোনো অংশিদারিত্ব নেই, যার ফলে এ জাতীয় কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হয় এবং খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত না হয়ে ও অন্যান্য সুবিধা বঞ্চিত থেকে দারিদ্র্যের বিশেষ হেরফের হয় না।
অর্থমন্ত্রী শিল্পক্ষেত্রের ব্যাপক প্রসার চেয়েছেন। তিনি জিডিপিতে শিল্পের অংশ বর্তমান ১৫ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে প্রস্তাব করেছেন। আমাদের জনসংখ্যা, বেকারত্ব এবং নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। স্মরণীয় যে, আমাদের দেশে প্রযুক্তি বিদেশ থেকে আনা হয়। বিদেশে এখন পুঁজিঘন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে এবং প্রবৃদ্ধি হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করে। সুতরাং আমাদের এখানে শিল্প প্রসারণের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের জন্য লাগসই শ্রমঘন প্রযুক্তি আমাদেরকেই উদ্ভাবন করতে হবে। সেজন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে যথাযথ বিনিয়োগ প্রয়োজন। এ খাতে এজন্য যথার্থ মানবসম্পদ সৃষ্টি প্রয়োজন এবং গবেষণার জন্য যথার্থ সুযোগ সৃষ্টিসহ শিল্প ও শিক্ষার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া প্রয়োজন। অর্থমন্ত্রী মূলত ব্যক্তি খাতের প্রসারণের মধ্যদিয়ে শিল্পখাতে উন্নয়নের জন্য বিনিয়োগ সংক্রান্ত আইন-কানুন পর্যাপ্ত সরবরাহ ও ঋণপ্রবাহকে গুরুত্ব দিয়েছেন। শিল্পখাতের জন্য ইশতেহারে পাটশিল্পের পুনরুজ্জীবনের কথা বলা হলেও এ সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় যথেষ্ট গুরুত্ব দেখা যায় না।
শিল্প বিকাশের জন্য প্রয়োজন হলো বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিকাশ এবং এক্ষেত্রে বর্তমান পরিস্থিতি নৈরাশ্যজনক। সার্কভুক্ত দেশের তুলনায় আমাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহার অতি নগণ্য। বিদ্যুৎ ও জ্বালানী খাতে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হয়েছে, বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য অতিরিক্ত লাইন স্থাপনের প্রস্তাবনা করা হয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎসহ বিদ্যুৎ উৎপাদনে সম্ভাব্য সকল উৎস ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে এবং কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ স্থাপনের প্রস্তাবও করা হয়েছে। আমাদের প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু জ্বালানী উৎপাদন, সংরক্ষণ, আমদানী বিতরণ এবং বিভিন্ন খাতের ব্যবহার সম্পর্কিত পরিবেশবান্ধব, গৃহস্থালীবান্ধব, ক্ষুদ্রশিল্পবান্ধব একটি নীতি। ইশতেহারে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে এবং তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান ও পশ্চিমাঞ্চলে এলপিজি সরবরাহের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। বাজেট প্রস্তাবনায় ২০১৩ সাল নাগাদ ৫০০০ মেগাওয়াট অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের প্রস্তাবনা রয়েছে। বাপেক্সের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও বিদ্যুৎ সংরক্ষণের প্রস্তাবনায় সাশ্রয়ী বাল্ব ব্যবহারের দিকেও দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। বাজেট প্রস্তাবনা থেকে অনুমান হয় সরকারি খাতের চাইতে বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরতা বাড়বে। পুঁজির চাহিদার কারণে এটা স্বাভাবিক মনে হলেও উন্নয়নের একটি অতি প্রয়োজনীয় উপকরণে যেন যথাযথ নিয়ন্ত্রণ থাকে এবং কোনো গোষ্ঠীর একচ্ছত্র আধিপত্য বা সিন্ডিকেশনের সৃষ্টি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সুষম উন্নয়নের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অতীতে সড়ক ও সেতুর দ্রুত সম্প্রসারণ দেখেছি। কিন্তু নৌপথ ও রেলপথ অবহেলার শিকার থেকে গেছে। ইশতেহারে সড়ক নির্মাণ, বন্দর নির্মাণ, টেলিযোগাযোগ সম্প্রসারণ, স্বল্প ব্যায়ে যাতায়াত, এশীয় ও এশীয় হাইওয়ের সাথে সম্পর্ক স্থাপন, ঢাকা শহরে পাতাল রেলসহ যানজট নিরসনে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং নদী পুনর্খননের কথা বলা হয়েছে। বাজেটে সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রস্তাবনাও রাখা হয়েছে এবং এখাতে বেসরকারি অংশিদারিত্বের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। রেলওয়েকে কর্পোরেট সংস্থায় রূপান্তরিত করে দূরপাল্লার যাতায়াতকে ঢেলে সাজানো ও রেলপথ সম্প্রসারণ সম্পর্কে প্রস্তাবনা রাখা হয়েছে। নৌপথকে নিরাপদ ও নাব্য রাখার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের কাজ সাপ্লাই অপারেট এন্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে সম্পন্ন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। স্থল বন্দরগুলোকে বিওটি’র আওতায় উন্নয়নের প্রস্তাবও করা হয়েছে।
টেলিযোগাযোগ খাতে ইন্টারনেটের সম্প্রসারণ দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সংযুক্ত করা দেশব্যাপী ফাইবার সংযোগ স্থাপনসহ তার ও টেলিযোগাযোগের কাঠামোকে উন্নয়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এখাতে বেসামরিক বিমান ও পরিবহন ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের প্রস্তাবনাও রয়েছে। লক্ষ্যণীয় যে, আইসিটি বিষয়টি শিল্পায়ন, যোগাযোগ, গ্রামীণ উন্নয়ন সমস্ত খাতেই ব্যাপৃত হয়ে আছে। এই প্রযুক্তির সম্প্রসারণের জন্য এক্ষেত্রে শিক্ষার সম্প্রসারণ গবেষণা এবং দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির দিকে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে।
বাজেট প্রস্তাবনায় মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য এবং এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের স্বার্থে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চতর, কারিগরি, পেশাগত শিক্ষা সব বিষয়েই সুযোগ সম্প্রসারণের প্রস্তাবনা রয়েছে। আমাদের শিক্ষাকে জীবনঘনিষ্ঠ, বিজ্ঞানমুখি, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক সক্ষমতা অর্জনের দিকে সবিশেষ দৃষ্টির প্রয়োজন আছে। আমরা এখনো সবার জন্য শিক্ষাকে নিশ্চিত করতে পারি নি। কমিউনিটি বিদ্যালয় এবং অনেক সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয় শিক্ষার যথাযথ উপকরণ ও শিক্ষকের অভাবে মানহীন শিক্ষার ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার যথেষ্ট সম্প্রসারণ ঘটেনি। উচ্চশিক্ষায় জনগণের অংশগ্রহণও সীমিত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় অংশগ্রহণ বাণিজ্য ও সাধারণ শিক্ষার চাইতে তুলনামূলকভাবে কম। বিজ্ঞান শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত। বিভিন্ন শিক্ষাক্ষেত্রে যথাযথ প্রশিক্ষিত শিক্ষকের দারুন অভাব। কার্যকর পাঠ্যক্রম এবং সৃজনশীল ক্ষমতাসৃষ্টিকারী শিক্ষাক্রম এখন পর্যন্ত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলেও ছাত্র-শিক্ষকের নিকট পৌঁছেনি। দারিদ্র্য এখনো শিক্ষায় অংশগ্রহণকে সীমিত করে রেখেছে। এ সমস্ত সমস্যা উত্তরণের জন্য সমন্বিত শিক্ষা নীতির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এছাড়াও প্রতিবন্ধী ও আধিবাসীদের জন্য যথার্থ শিক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় নি। ইশতেহারে মানবসম্পদ উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছিল। সেইসাথে শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষাঙ্গনকে দলীয়করণমুক্ত, শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতনকাঠামো, স্বতন্ত্র কর্মকমিশন এবং পর্যায়ক্রমে স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। যে দেশে ১১ ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা বর্তমান এবং তিন ধরনের শিক্ষার মাধ্যম উপস্থিত এবং যেখানে শিক্ষাকে পণ্য করে বিনিয়োগের একটি বেসরকারি প্রচেষ্টা তীব্র হয়ে উঠছে সেখানে অবৈতনিক সেবা, স্বতন্ত্র কর্মকমিশন, উচ্চতর বেতন কাঠামো, শিক্ষার মানোন্নয়ন ইত্যাদির সমন্বয় সমস্যাসঙ্কুল। বর্তমানের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষার সম্প্রসারণ, বেসরকারি খাতে শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি, বিনামূল্যে বই বিতরণ, বিদ্যালয় পুনর্নির্মাণ, উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিং ছাড়া মৌলিক বিষয়ের দিকে তেমন কোনো দৃষ্টিপাত করা হয় নি। আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে যে বিশাল বিনিয়োগ ও পুনঃচলমান খরচ মেটানোর অর্থসংস্থান প্রয়োজন সে বিষয়ে কোনো আলোচনাই ইশতেহারে বা বাজেট প্রস্তাবনায় লক্ষ্য করা যায় না।
এবারের বাজেট ধারাবাহিকতার বাজেট। বাজেটের নতুন দিক হচ্ছে সরকারের রাজনৈতিক নীতিমালা বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারকে বাজেট আলোচনায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আর তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়েই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। বাজেটে অপ্রদর্শিত আয় বা কালো টাকা বৈধ করার যে সুযোগ দেয়া হয়েছে তা নীতি ও নৈতিকতার দিক থেকে কতটা ঠিক হয়েছে সেটাও ভাবনার বিষয়। বাজেট যত বড়ই হোক না কেন সেটা যথাযথ বাস্তবায়নে সরকার কতটা সফল হবে সেটা দেখতে হবে। এবারের বাজেটে সরকারি বেসরকারি অংশিদারিত্বকে নতুন বলা হচ্ছে, আসলে এটা নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিষয়টি আমাদের বাজেটগুলোতে ছিল। তবে তা উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে ঢোকানো থাকতো। এর অধীনে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হতো সেগুলো বিওপি, বিওটির আওতায় বাস্তবায়ন হতো। তবে একটি দিক থেকে এটিকে নতুন বলে দাবি করার চেষ্টা করা হয়ে থাকতে পারে। আর সেটা হচ্ছে, এবারই প্রথম এটাকে আলাদা খাত হিসেবে ঘোষণা দিয়ে এর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক গুরুত্বের বিবেচনায়ও এটি নতুন হতে পারে। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি একটি কার্যকর দিক। এটি যে নতুন কিছু নয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকেও তার প্রমাণ মেলে। তিনি বলেছেন, এ ব্যবস্থা বিশ্বের অনেক দেশেও চালু আছে। এবারের বাজেটে তিনি মন্ত্রণালয় ধরে ধরে কথা বলেছেন। সেখানে আওয়ামী বা মহাজোট সরকারের জনগণের কাছে যে প্রতিশ্রুতি তার প্রেক্ষাপটে তিনি তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেছেন। এর আগের বাজেটগুলোতে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় দায়িত্বগুলো আলাদাভাবে চিহ্নিত করে দেয়া হতো না। এর ফলে বাজেট বাস্তবায়নে কোন মন্ত্রণালয়ের দায় কতটা তা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ থাকতো না। এবারের বাজেটে কোন কোন মন্ত্রণালয়ের কি কি কাজ এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করতে হবে সেই সঙ্গে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে, সেইসব বিষয় চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার যে জায়গা তৈরির প্রয়াস চালানো হয়েছে তা কার্যকর করা গেলে ভালো ফল পাওয়া যেতে পারে। এ ব্যাপারে একটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেলে ভালো হতো। তিনি বাজেট তৈরির সময় এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নিশ্চয়ই আলোচনা করেছেন। তবে এসব বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর সাথে আলোচনা করেছেন কি-না জানি না, আলোচনা করলে ভালো। কারণ মন্ত্রণালয়ের ওউনারশীপ নিশ্চিত করা না গেলে প্রকল্প বাস্তবায়ন দুরূহ হয়ে পড়ে, ফলে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হয় না।
আমরা নির্বাচনী ইশতেহারের আলোকে বাজেটে প্রস্তাবিত বিভিন্ন পদক্ষেপের আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, অর্থমন্ত্রী ম্যাক্রো ফ্রেমওয়ার্কের চাইতে খাতওয়ারী যে সমস্ত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ইশতেহারে দেয়া হয়েছে সেদিকে অধিকতর দৃষ্টি দিয়েছেন। একথা বলা যায় যে, ইশতেহারে অনেকক্ষেত্রেই কৌশলগত দিক-নির্দেশনা ছিল। একই উদ্দেশ্য অর্জনে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে নানা প্রস্তাবনা রেখেছেন। তিনি বিকল্পগুলো বিবেচনা করেছেন কি-না সেটা পরিচ্ছন্ন নয়। এই কারণে ইক্যুইটি ও এফিসিয়েন্সির বিবেচনা একেবারেই অনুপস্থিত। অন্যদিকে এটাও লক্ষ্যণীয়, বাজেট বিবেচনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ইশতেহারের নানা প্রতিশ্রুতি অনেক বেশিই গুরুত্ব পেয়েছে। যেমন: কৃষি খাত, শিল্প খাতের চাইতে সঙ্গত কারণেই অধিক বিবেচনার দাবিদার হয়েছে।
একইভাবে ই-গর্ভান্সের ব্যাপারে বাজেট ব্যবস্থাপনায় অনেক উচ্চারণ লক্ষ্যণীয়। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিদ্যমান নানা কৌশলকে প্রসারিত করার বিষয়টি যত সহজে বলা যায়, তত সহজে জ্বালানী নিরাপত্তার বিষয়ে নির্দিষ্ট প্রস্তাবনা উপস্থাপিত করা অধিক কষ্টসাধ্য। দারিদ্র্য নিরসন সম্পর্কে বিদ্যমান নানা প্রকল্প ও কর্মকৌশল থাকায় সে বিষয়ে আলোচনা অনেক সহজ হয়েছে। যোগাযোগ খাতে নানা প্রস্তাবনা এসেছে, যদিও এ বিষয়ে ইশতেহারে তেমন বিস্তৃত ধারণা দেয়া হয়নি। মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পর্কে যত সহজে শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, একইভাবে স্বাস্থ্য খাত নিয়ে বিবেচনায় অনেক ঘাটতি লক্ষ্যণীয়। এ বিষয়ে আমাদের উপরে যে আলোচনা তা থেকে এই উপসংহার টানা সম্ভব যে, ইশতেহারে বর্ণিত লক্ষ্যসমূহের যেহেতু অগ্রাধিকারভিত্তিক কোনো নির্দেশনা ছিল না, সেহেতু বাজেটে অর্থব্যয় প্রাক্কলনে এ বিষয়টি ধারাবাহিকতার কারণে উপেক্ষিত থেকে গেল। আমরা আশা করব, ভবিষ্যতের যে বাজেট নির্মাণ ও কাঠামোর ইঙ্গিত অর্থমন্ত্রী দিয়েছেন তার ফলে ইশতেহারে বর্ণিত নানা ইচ্ছার সাথে প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্য দূরীকরণ নিশ্চিত করার জন্য যে চলমান ম্যাক্রো কাঠামো নির্মাণ করা হবে, তার মাধ্যমে একটি সুসমন্বিত বাজেট প্রণয়ন সম্ভব হবে – যেখানে ইউনিয়ন থেকে সকল স্থানীয় সরকারের পর্যায়ে নির্দিষ্ট ও প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ব্যয় ও সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে এবং তারই মাধ্যমে উন্নীত একটি আর্থসামাজিক বিবর্তনসহ ভৌত ও সামাজিক পুঁজির বিকাশের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক বৈষম্য, আন্তঃসামাজিক বৈষম্য দূর করে সবার জন্য সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করা যাবে। বর্তমান বাজেটে এই সমন্বয়টির অভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে অর্থমন্ত্রী নির্বাচনকালে দেয় প্রতিশ্রুতির প্রতি যে গুরুত্ব দিয়েছেন সেটি ভবিষ্যতে বাজেট প্রণয়নে ও তার বিবেচনায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করবে বলেই আশা করি।
অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ : অর্থনীতিবিদ, সভাপতি, সুজন
তথ্য সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৬ জুন ২০০৯
মুহিতের মোহিতকরণ বাজেট
Categories: