মুহিতের মোহিতকরণ বাজেট

ittefaq
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ
বাজেট নানানভাবে বিবেচিত হতে পারে। যারা এটাকে মূলত অর্থনৈতিক দলিল হিসেবে বিবেচনা করেন তাদের জন্য বিবেচনার বিষয় প্রবৃদ্ধি ছাড়াও ডিস্ট্রিবিউশনাল এন্ড এলোকেটিভ এফিসিয়েন্সি, যার ফলে রিয়েল সেক্টরে উৎপাদনে উলস্নম্ফন হয়। এ জাতীয় বিবেচনায় যেহেতু দৃষ্টি থাকে উৎপাদনের দিকে সে কারণে ইক্যুয়িটির প্রশ্নটি অনেক সময় অনুলিস্নখিত থেকে যায়। আমাদের মতো বিভাজিত দারিদ্র্য পীড়িত অর্থনীতিতে এফিসিয়েন্সির সাথে ইক্যুয়িটির প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরম্নত্বপূর্ণ। এ কারণেই বাজেটকে সমাজ বিনির্মাণের একটি কৌশল হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। আমাদের দেশে বাজেটের সমাজতত্ত্ব সাধারণত আলোচনায় আসে না। সরকারি উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন কর্মের মাধ্যমে সামাজিক বিভিন্ন স্তর নানাভাবে প্রভাবিত হয়। এই প্রভাবের ফলে সমাজের সুযোগ-সুবিধা অনেক সময়ই বিষমভাবে বন্টিত হয়, যার ফলে সমাজের সুষম পরিবর্তন বিঘ্নিত হয়ে থাকে। আমাদের আলোচনায় এই ধারণা প্রায়শই অনুপস্থিত। বাজেট অবশ্যই একটা রাজনৈতিক দলিল, এখানে সমাজের রাজনৈতিকভাবে ৰমতায়িত বিভিন্ন গ্রম্নপ তাদের অনুকূলে কর, রাজস্ব আহরণের অভিঘাত এবং ব্যয়ের কারণে সৃষ্ট হরেক-রকম সুযোগ তাদের অনুকূলে নিয়ে থাকে। এ কারণেই বাজেটের রাজনৈতিক অর্থনীতি একটি গুরম্নত্বপূর্ণ আলোচনার দিক। আমরা আমাদের দেশে বাজেটের যে আলোচনা দেখি তাতে বিভিন্ন গ্রম্নপের স্বার্থ-সংশিস্নষ্ট ধারণা পাওয়া যায় এবং অর্থনৈতিক আলোচনায় সামষ্টিক অর্থনীতির চলগুলোকে বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়। এখানে সামষ্টিক অর্থনীতির বেষ্টিক দিকটি বিবেচনায় থাকে না বলে রাজনৈতিক অর্থনীতি অনুক্ত থেকে যায়। আমাদের আলোচনায় আমরা রাজনৈতিক দলের দায়বদ্ধতার দিকটি ধারণ করেছি। বর্তমানে ৰমতাসীন দল নির্বাচনের সময় ইশতেহারের মাধ্যমে নানা প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন। এই আলোচনা সেই প্রতিশ্রম্নতির আলোকে করা হয়েছে। বাজেটের আলোচনায় সংবিধানে প্রদেয় ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপালস্‌ এর বিবেচনায়ও হতে পারে এবং হওয়া উচিত। এতগুলো দিক থেকে বাজেট আলোচনা অবশ্যই দীর্ঘ হবে, আমরা সেদিকে অগ্রসর না হয়ে কেবলমাত্র দায়বদ্ধতার দিক থেকে বাজেটটি আলোচনা করেছি। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আশাকরি বাজেট বিবেচনার অন্যদিকগুলো নানাভাবে আমাদের এই উপস্থাপনায় চলে এসেছে এবং সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এদেশের জনসাধারণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করবে এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে আরো স্বচ্ছভাবে দায়বদ্ধ হওয়ার অবস্থানে নিয়ে আসবে। বর্তমান অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ নিয়ে যে উপস্থাপনা করেছেন তাতে সবার জন্যই কিছু না কিছু আছে। এখানে ইক্যুইটি ও এফিসিয়েন্সির বিবেচনা একেবারে ৰীণ। এ কারণেই এ বাজেটকে মোহিতকরণের একটা প্রচেষ্টা বলে ধারণা করা যায়।

অর্থমন্ত্রীর এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি ব্যয়ের লৰ্যমাত্রা ১ লাখ ১৩ হাজার ৮১৯ কোটি টাকায় নির্ধারিত করে সংসদে বাজেট উপস্থাপন করেছেন। উন্নয়ন এবং অনুন্নয়ন ব্যয় গত বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। বাজেটের আয়কাঠামো ও ব্যয়কাঠামো প্রকৃতিগতভাবে আগের বছরের তুলনায় তেমন পরিবর্তিত হয়নি। সর্বাধিক অনুন্নয়ন ব্যয় প্রাক্কলিত হয়েছে অর্থবিভাগ (৬০.১৭%), এর পরে যে সব মন্ত্রণালয়ের জন্য বেশি অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে সেগুলো হলো: খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (৭.৩৬%), অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (৩.৫৯%), প্রতিরৰা মন্ত্রণালয় (৫.১৩%), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (৩.৩৭%), শিৰা মন্ত্রণালয় (৩.৯৯%) ও কৃষি মন্ত্রণালয় (৩.২১%)। এ সবই আগের বছরের তুলনায় শতাংশ হিসেবে তেমন ভিন্নতা দেখায় নি। উন্নয়ন ব্যয়ের ৰেত্রে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগে (২১.২৯%)। তারপরে আসছে বিদ্যুৎ বিভাগ (১১.৩০%), সড়ক ও রেলপথ বিভাগ (৯.৭৬%), স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ (৯.৭২%) এবং প্রাথমিক ও গণশিৰা (৯.০৫%)। উলেস্নখ্য, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা খাতে বরাদ্দ হয়েছে (৪.১১%), শিৰা খাতে (৩.৪১%), কৃষি খাতে (২.৮৩%), সেতু নির্মাণের জন্য (২.৫৩%) এবং জ্বালানি খাতে (২.২৩%)। দিন বদলের বাজেটে আমরা ব্যয়ের দিক থেকে উলেস্নখযোগ্য কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন লৰ্য করি না। অন্যদিকে আয়ের ৰেত্রেও কর জিডিপি অনুপাত বৃদ্ধি করার আকাঙৰা ব্যক্ত করা হয়েছে এবং সেজন্য করের ৰেত্রে অনুসন্ধান ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার সংস্কারের ওপর পূর্ববর্তী বাজেটগুলোর মতোই অধিক দৃষ্টি দেয়া হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজস্বের ৪২% আমদানি শুল্ক থেকে আসে, এবারের বাজেটেও এ খাত থেকে অধিকতর কর রাজস্ব আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেমনি করা হয়েছে মূল্য সংযোজন খাতের আওতা প্রসারণের জন্য। আয়করের ৰেত্রেও পূর্ববর্তী বছরের চাইতে ভিন্নতর কোনো অবস্থান নেয়া হয়নি। রাজস্ব ব্যতিরেকে রাজস্ব বহির্ভূত আয়ের ৰেত্রেও একই চিত্র পরিলৰিত হয়। বাজেটের ঘাটতি জিপির ৫%-এর মধ্যে রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে, যেটা আগের বছরের চাইতে কিঞ্চিত বেশি। ঋণের বেলায় অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ কিছুটা বাড়বে এবং অভ্যন্তরীণ ঋণ আসবে মূলত ব্যাংকিং খাত থেকে, যেখানে অনেক তারল্য বর্তমানে আছে। বৈদেশিক ঋণের বেলায়ও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে এবং সাম্প্রতিককালের চেয়ে প্রাক্কলিত বাজেটে উন্নয়ন বাজেটের ৫০ শতাংশের বেশি বৈদেশিক ঋণ থেকে আসবে বলে দেখানো হয়েছে। প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি জিডিপির সাড়ে ৫ থেকে ৬ শতাংশ এটা আগের বছরের মতোই। বিনিয়োগ হবে জিডিপির ২০ শতাংশের বেশি, এখানেও ধারাবাহিকতা লৰ্যণীয়। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশ হয়েছিল, এখন খাদ্যদ্রব্য মূল্য কম হওয়ায় এবং পেট্রোল ও ভোজ্যতেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে বলে অনুমান করা হয়েছে। বাজেটে জাতীয় সঞ্চয় জিডিপির কত শতাংশ হবে তার কোনো প্রাক্কলন নেই এবং কর্মসংস্থানের ৰেত্রে বার্ষিক হিসেবে কত জনবৎসর বৃদ্ধি পাবে তারও কোনো লৰ্যমাত্রা নির্দিষ্ট নেই।
নির্বাচনী ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধের কথা বলা হয়েছে এবং কৌশল হিসেবে মজুদদারী ও মুনাফাখোরীর সিন্ডিকেট ভেঙ্গে দেয়ার ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। বাজেটে এ সম্পর্কে কোনো বক্তব্য নেই। দ্রব্যমূল্য কমাতে দেশের উৎপাদন বৃদ্ধির ৰেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের কথা বলা হয়েছে, এৰেত্রে কৃষি ও পলস্নী উন্নয়ন খাতকে সঙ্গত কারণেই অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। সে সাথে ৰুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশকেও গুরম্নত্ব দেয়া হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনের ৰেত্রে কৃষি জমির আওতা সম্প্রসারণ এবং একাধিক ফসল উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। কৃষি খাতে প্রয়োজন মোতাবেক ভর্তুকি থাকবে। যার পরিমাণ ২০০৯-১০ সালে ৩,৬০০ কোটি টাকা যা সংশোধিত বাজেটের ৫,৭৮৫ কোটি টাকার চেয়ে উলেস্নখযোগ্য হারে কম। কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বীজ উৎপাদন ও সরবরাহ, বীজ সংরৰণ ও মজুদ ৰমতা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। লৰ্যণীয় যে, কৃষি গবেষণা ও কৃষি পুনর্বাসন সহায়তা খাতে লৰ্যণীয় বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। কৃষি ঋণের লৰ্যমাত্রাও বাড়ানো হয়েছে। কৃষি খাতে বৈপস্নবিক পরিবর্তনের কোনো প্রস্তাবনা নেই। লাঙল যার, জমি তার এ দিকেও সরকার অগ্রসর হচ্ছেন বলে মনে হয় না। উপরন্তু কৃষকের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াবার প্রচেষ্টাও অনুলেস্নখভাবে বাজেটে এসেছে। বীজ এবং অন্যান্য উপকরণের সমবায়ী মালিকানার প্রতি কোনো প্রাগ্রাধিকার দেয়া হয়নি, যদিও সংবিধানে সমবায়ী মালিকানার ৰেত্রটি সুনির্দিষ্টভাবে উলেস্নখ করা আছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের পরে এৰেত্র অগ্রাধিকারের দাবিদার।
নির্বাচনী ইশতেহারে বিশ্বমন্দা মোকাবেলায় সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে এর অভিঘাত ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেটে বিভিন্ন খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নানা রকমের বিনিয়োগ এবং নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে উলেস্নখ করেছেন। বিশ্বমন্দার প্রভাব মোকাবেলায় বাজেটে অন্যান্য দেশের মতো বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। রফতানি খাতে সরকার তেরোটি পণ্যকে রফতানি সহায়তা দিয়ে থাকে। উপরন্তু বাজেটে অধিকতর ৰতিগ্রস্ত তিনটি খাতে সহায়তার পরিমাণ ২.৫ শতাংশ করে বৃদ্ধি করা হয়েছে। এজন্য বাজেট বরাদ্দ ৪২৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে এবং সহায়তার অর্থ দ্রম্নত পরিশোধের জন্য নীতিমালা সহজীকরণ করা হয়েছে। যার ফলে প্রাপ্য সহায়তার ৭৫ শতাংশ বিলম্ব ছাড়াই তাৎৰণিকভাবে পরিশোধ করা হবে। তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে বন্ডেড ওয়্যার হাউজ সুবিধা, ডিউটি ড্র ব্যাক সুবিধা, ৫ শতাংশ রফতানি সহায়তা এবং সুতা আমদানির ওপর ০ (শূন্য) শুল্কহার বিদ্যমান রাখা হয়েছে। এছাড়াও আমদানি ও বিনিয়োগ সংহত করতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার ১২ ও ১৩ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে, ব্যাংক ঋণ পরিশোধের ডাউন পেমেন্ট-এর মেয়াদ সেপ্টেম্বর ২০০৯ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, কেস টু কেস-এ ঋণ পুনঃতফসিলিকরণের সুবিধা প্রদান করা হয়েছে, রফতানির খাতে নিয়োজিত পস্নান্ট-এর উন্নতি ও যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়েছে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের জন্য প্রদেয় লাইসেন্স ও নবায়ন ফি প্রত্যাহার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এছাড়াও সকল রম্নগ্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের করণীয় কার্যক্রম আশু বাস্তবায়নের পদৰেপ নেয়া হয়েছে।
দারিদ্র্য বিমোচনকে নির্বাচনী ইশতেহারে যথাযথ গুরম্নত্ব দেয়া হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনের প্রধান কৌশল হিসেবে কৃষি ও পলস্নী জীবনে গতিশীলতা আনয়ন, হতদরিদ্রদের নিরাপত্তা প্রদান এবং তরম্নণ উদ্যোক্তাদের যথাযথ সহায়তা প্রদানকে গুরম্নত্ব দেয়া হয়েছে। কৃষি ৰেত্রের বিষয়টি আগেই উলেস্নখ করা হয়েছে। প্রোটিনের চাহিদা পূরণের জন্য পশুসম্পদের বিনিয়োগের মাধ্যমে মাংস, দুধ ও ডিমের সরবরাহ বৃদ্ধি, মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির লৰ্যে জলাশয় ও পোনা উৎপাদন বৃদ্ধি ইত্যাদি ৰেত্রে প্রণোদনা সহায়তা প্রদানের প্রস্তাবনা করা হয়েছে। পানি সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ছাড়া এদেশের ভূমি সম্পদের যথার্থ ব্যবহার সম্ভব নয়, সেইসাথে যুক্ত হচ্ছে গ্রামীণ জনশক্তির যথার্থ ব্যবহার। এজন্য প্রয়োজন নদীসহ সমস্ত জলাশয়ের দূষণ ও দখলমুক্ত করাসহ নদী সংরৰণ, নদী ভাঙন রোধ, লবণাক্ততা প্রতিরোধ, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণ। নদীর নাব্যতা ও টেকসই পুনরম্নদ্ধার আমাদের জলসম্পদের ব্যবহারকে সুনিশ্চিত করতে পারে। বাজেটে এ ব্যাপারে অতীতের মতোই যথেষ্ট বরাদ্দ রাখা হয়েছে। গ্রামীণ অবকাঠামো সম্প্রসারণ, গ্রামীণ বিদ্যুতায়ন, গ্রামীণ স্যানিটেশন ও সুপেয় পানি সরবরাহসহ পলস্নী অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে ঋণ দান, দৰতা উন্নয়ন ও সামাজিক উন্নয়নের ৰেত্রে প্রশিৰণ ছাড়াও নারীর ৰমতায়নের জন্য কার্যক্রম গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। পলস্নী উন্নয়নের জন্য স্থানীয় সরকারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরম্নত্বপূর্ণ। এলজিইডির অনুকূলে উন্নয়ন বরাদ্দের সাথে স্থানীয় সরকারের সম্পর্কটি যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন নয়। বাজেটে সার্বিক ত্রাণ উন্নয়ন নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীর আশির্বাদপুষ্ট একটি বাড়ি একটি খামারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। উলেস্নখ্য, স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করা হলে জেলাভিত্তিক ও মন্ত্রণালয়ভিত্তিক বাজেটের ওপর নেকদৃষ্টি লৰ্যণীয়, যখন স্থানীয় সরকারের কার্যকারিতা বাড়াতে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও জেলা পরিষদের পৃথক ও সমন্বিত বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দৰতা অত্যন্ত গুরম্নত্বপূর্ণ।
দারিদ্র্য বিমোচন ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য বর্তমান সরকার আগের মতোই টিআর, ভিজিএফ, কাবিখা ছাড়াও বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, নিম্ন আয়ের কর্মজীবী মায়ের ভাতা বৃদ্ধি ও ৰেত্র প্রসারণের প্রস্তাব করেছে। এছাড়াও পিতৃ-মাতৃহীন শিশুর কল্যাণ, পথশিশুদের কল্যাণ, দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলা, মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থান, প্রতিবন্ধী সেবা, দরিদ্রের জন্য কর্মসংস্থান, সৃজনমূলক প্রশিৰণ, মেটার্নাল হেলথ ভাউচার ইত্যাদির মাধ্যমে দারিদ্র্যের অভিঘাত সীমিত করার প্রচেষ্টা ও কর্মপ্রস্তাবনা বাজেটে লৰ্য করা যায়। এ সমস্তই দান-অনুদানের ব্যাপার। দরিদ্র মানুষের সৰমতা সৃষ্টি, শিৰা ও কর্মের সুযোগ সৃষ্টি, উৎপাদনে অংশিদারিত্বসহ সম্পদ প্রবাহের সঙ্গে সম্পদ সৃষ্টি বিপণন ও এর লভ্যাংশের সঙ্গে অর্থবহ সম্পর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে আত্মশক্তিতে বলীয়ান না করা হলে টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব হয় না। এ কারণে সুদীর্ঘকালে এ অঞ্চলে দারিদ্র্য নিরসন কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও হতদরিদ্রের সংখ্যা তেমন কমেনি, দারিদ্র্য রেখার নিচের মানুষের সংখ্যাও শতাংশ হিসেবে কমলেও জনমিতি হিসেবে বেড়েছে এবং বিভিন্ন কারণে ঝুঁকির মুখে থাকা দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে থাকা মানুষের সংখ্যা নগণ্য নয়। এই তিন শ্রেণীর মানুষের সংখ্যা আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশ। একটি বৈষম্যমূলক সমাজকাঠামো এবং সম্পদভিত্তিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিধার কারণে দারিদ্র্য বিমোচনের এ সমস্ত তথ্যগত প্রচেষ্টা দারিদ্র্য নিরসনে সহায়ক হয় না। দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে অত্যন্ত সচেতনভাবে উৎপাদনশীল আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পুঁজির ওপরে দরিদ্র মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ছাড়া কখনোই দারিদ্র্য কেবল প্রবৃদ্ধির মাঝে বিদূরিত হবে না। সুতরাং স্বল্প মেয়াদের যে কার্যক্রম বাজেটে উলেস্নখিত হয়েছে তার মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন আনতে দারিদ্র্য নিরসন কৌশলকেই ঢেলে সাজাতে হবে। যার কথা অর্থমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় উলেস্নখ করেছেন। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ন্যাশনাল ফুড পলিসির ক্যাপাসিটি স্ট্রেনথেনিং প্রোগ্রাম-এর মাধ্যমে খাদ্য নীতিমালা ১১টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে প্রণীত ও তাঁর অধীনে কর্ম-পরিকল্পনা তৈরি হবে বলে জানানো হয়েছে। উদ্দেশ্য খাদ্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখা, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, খাদ্যশস্য সংরৰণের ধারণৰমতা বৃদ্ধি, খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা ও খাদ্য নিরাপত্তা বেষ্টনীর কলেবর বৃদ্ধি। লৰ্যণীয় এ সবই উপর থেকে দেয়া দান-অনুদানের ব্যাপার। এখানে সম্পৃক্ত জনগোষ্ঠীর কোনো অংশিদারিত্ব নেই, যার ফলে এ জাতীয় কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হয় এবং খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত না হয়ে ও অন্যান্য সুবিধা বঞ্চিত থেকে দারিদ্র্যের বিশেষ হেরফের হয় না। (চলবে)
[লেখক : অর্থনীতিবিদ ও  সভাপতি, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক]
তথ্য সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫ জুন ২০০৯

Related Post

বিপর্যয় এড়াতে চাই দায়িত্বশীল রাজনীতিবিপর্যয় এড়াতে চাই দায়িত্বশীল রাজনীতি

ড. বদিউল আলম মজুমদার সরকার ও প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সংলাপ শেষ হয়েছে। শোনা যায়, আনুষ্ঠানিক সংলাপ শীঘ্রই শুরু হবে। আমরা এর সফলতা কামনা করি। তবে সংলাপ সম্পর্কে আমাদের

রাজনীতি: সংবিধানের সমালোচনা করলে চরম দণ্ড!রাজনীতি: সংবিধানের সমালোচনা করলে চরম দণ্ড!

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ২১-০৭-২০১১ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের পর বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেন, তাঁরা ক্ষমতায় এলে সংবিধান ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে। বিরোধী দলের নেত্রীর এ বক্তব্যকে