সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সুজন নেতৃবৃন্দ। একইসাথে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সুজন নেতৃবৃন্দ নির্বাচন কমিশন-সহ সরকার, রাজনৈতিক দল, নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গসহ নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। তাঁরা আজ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৭, সকাল ১১.০০টায়, সুজন আয়োজিত ‘রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন: বিজয়ীগণের তথ্য উপস্থাপন ও নির্বাচন মূল্যায়ন’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন নেতৃবৃন্দ এই মন্তব্য করেন।
সংবাদ সম্মেলনে সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সহ-সম্পাদক জাকির হোসেন এবং নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ এবং ড. হামিদা হোসেন উপস্থিত ছিলেন। লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।
লিখিত বক্তব্যে সুজন-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ‘মেয়র পদে মোট ১৩ জন, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২২৬ জন এবং সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদে ৬৭ জন (সর্বমোট ৩০৬ জন) মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও, মনোনয়নপত্র বাছাই ও প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা অনুযায়ী মেয়র পদে ৭ জন, সাধারণ আসনের কাউন্সিলর পদে ২১২ জন এবং সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর পদে ৬৫ জন, মোট ২৮৪ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্য থেকে নির্ধারিত পদে একজন মেয়রসহ ৩৩ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ১১ জন সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর সর্বমোট ৪৫ জন নির্বাচিত হয়েছেন। আমরা সুজন-এর পক্ষ থেকে নবনির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।”
প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রংপুর সিটি করপোরেশনের নবনির্বাচিত মেয়র মো. মোস্তাফিজার রহমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা øাতক। নবনির্বাচিত ৩৩ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যে ১৩ জনের (৩৯.৩৯%) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি’র নিচে, ৭ জনের (২১.২১%) এসএসসি এবং ৫ জনের (১৫.১৫%) জনের এইচএসসি, ৭ জনের (২১.২১%) øাতক এবং ১ জনের (৩.০৩%) স্নাতকোত্তর। নবনির্বাচিত ১১ জন সংরক্ষিত (নারী) আসনের কাউন্সিলরের মধ্যে ৬ জনের (৫৪.৫৪%) শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি’র নিচে, ২ জনের (১৮.১৮%) এসএসসি এবং ১ জনের (৯.০৯%) জনের এইচএসসি, ১ জনের (৯.০৯%) øাতকোত্তর।
প্রার্থীদের পেশা সম্পর্কে তিনি বলেন, “নবনির্বাচিত মেয়র মো. মোস্তাফিজার রহমানের পেশা ব্যবসা। নবনির্বাচিত ৩৩ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যে ২৪ জনই (৭২.৭২%) ব্যবসায়ী। নবনির্বাচিত ১১ জন সংরক্ষিত (নারী) আসনের কাউন্সিলরের মধ্যে ৮ জনই (৭২.৭২%) গৃহিণী।”
প্রার্থীদের মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, “নবনির্বাচিত মেয়র মো. মোস্তাফিজার রহমানের বিরুদ্ধে অতীতে ১টি ফৌজদারি মামলা ছিল; যা থেকে তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। নবনির্বাচিত ৩৩ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যে ১৪ জনের (৪২.৪২%) বিরুদ্ধে বর্তমানে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। অতীতে ছিল ৫ জনের (১৫.১৫%) বিরুদ্ধে।”
প্রার্থীদের আয় সম্পর্কে তিনি বলেন, “নবনির্বাচিত মেয়র মো. মোস্তাফিজার রহমানের বার্ষিক আয় ১০,১২,২৭২ টাকা। নবনির্বাচিত ৩৩ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যে ২৭ জন (৮১.৮১%) বছরে ৫ লক্ষ টাকার কম আয় করেন। নবনির্বাচিত ১১ জন সংরক্ষিত (নারী) আসনের কাউন্সিলরের মধ্যে ৫ জন (৪৫.৪৫%) বছরে ৫ লক্ষ টাকার কম আয় করেন। বিশ্লেষণে বলা যায় যে, স্বল্প আয়কারী প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার হার প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় কম (৮৯.৭৮% এর স্থলে ৭৭.৭৭%) হলেও অপেক্ষাকৃত অধিক আয়কারী প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার হার প্রতিদ্বন্দ্বিতার তুলনায় বেশি (১০.২১ এর স্থলে ২২.২২%)।”
প্রার্থীদের সম্পদ সম্পর্কে তিনি বলেন, “নবনির্বাচিত মেয়র মো. মোস্তাফিজার রহমানের সম্পদের পরিমাণ ১৭,১৫,০০০.০০ টাকা। নবনির্বাচিত ৪৫ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যে শতকরা ৮১.৮১% ভাগের (২৭ জন) স্বল্প স¤পদের অর্থাৎ ৫ লক্ষ টাকার কম মূল্যমানের স¤পদের মালিক। নবনির্বাচিত ১১ জন সংরক্ষিত (নারী) আসনের কাউন্সিলরের মধ্যে ১০ জনের (৯০.০৯%) স¤পদ ৫ লক্ষ টাকার কম।”
তিনি বলেন, “প্রার্থীদের স¤পদের হিসাবের যে চিত্র উঠে এসেছে, তাকে কোনোভাবেই স¤পদের প্রকৃত চিত্র বলা যায় না। কেননা, প্রার্থীদের মধ্যে অনেকেই প্রতিটি স¤পদের মূল্য উল্লেখ করেন না, বিশেষ করে স্থাবর স¤পদের। আবার উল্লেখিত মূল্য বর্তমান বাজার মূল্য না; এটা অর্জনকালীন মূল্য।”
প্রার্থীদের দায়-দেনা সম্পর্কে তিনি বলেন, “নবনির্বাচিত মেয়র মো. মোস্তাফিজার রহমানের জনতা ব্যাংকে ঋণ রয়েছে ১৫,০০,০০০ টাকা। নবনির্বাচিত ৩৩ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যে ঋণ গ্রহীতা মাত্র ৭ জন (২১.২১%)। নবনির্বাচিত ১১ জন সংরক্ষিত (নারী) আসনের কাউন্সিলরের মধ্যে কোনো ঋণ গ্রহীতা নেই।”
প্রার্থীদের আয়কর সম্পর্কে তিনি বলেন, “নবনির্বাচিত মেয়র মো. মোস্তাফিজার রহমান একজন করদাতা। তিনি সর্বশেষ অর্থবছরে ২৫,২৯৫.০০ টাকা কর প্রদান করেছেন। নবনির্বাচিত ৩৩ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যে ২৪ জন (৭২.৭২%) করদাতা। নবনির্বাচিত ১১ জন সংরক্ষিত (নারী) আসনের কাউন্সিলরদের মধ্যে ৫ জন (৪৫.৪৫%) করদাতা।”
দিলীপ কুমার সরকার বলেন, “নির্বাচন কমিশন তথা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয় প্রথম থেকেই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সজাগ ও কঠোর ছিল। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে নির্বাচনী আচরণবিধি যথাযথভাবে অনুসরণের ব্যাপারে ব্যত্যয় ঘটানো হলে সাথে সাথেই তারা নোটিশ করেছেন এবং কখনও কখনও জরিমানাও করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অনাকাক্সিক্ষত কোনো পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক প্রতিকার তথা নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রস্তুতি যথেষ্ট ভাল ছিল। কেননা, পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আমরা মাঠে দেখেছি। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে ১১টি এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নেতৃত্বে ৩৩টি টিম কর্মরত ছিল। নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিতদের বিরুদ্ধেও পক্ষপাতিত্বের কোনো অভিযোগ ওঠেনি। মোটকথা নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অন্যান্য অংশীজনদেরও কমিশন ভালোভাবে কাজে লাগাতে পেরেছে। অন্যান্য নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হতে দেখলেও, এই নির্বাচনে আমরা তা দেখিনি। আমরা সুজন-এর কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়েও নির্বাচন কমিশনের সার্বিক সহযোগিতা পেয়েছি।”
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বলেন, “নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অতীতে বিতর্কিত ছিলো। রংপুর সিটি নির্বাচনের পর কিছুটা হলেও বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে বলে আমি মনে করি। সার্বিক বিচারে রংপুর সিটি নির্বাচর সুষ্টু, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে।”
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “রংপুরে সাত মণ ঘি জুটেছে, তাই রাধা নেচেছে। সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন দায়িত্বশীল আচরণ করেছে। গণমাধ্যম সজাগ ছিলো। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমরাও বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। এরফলে রংপুরে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।’ তবে সরকার যদি নিরপেক্ষ আচরণ না করে তবে সবচেয়ে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘রংপুর সিটি নির্বাচন একটি ছোট জায়গায় হয়েছে। আমরা সবাই এ নির্বাচনকে যতটা গুরুত্ব দিচ্ছি তা আদৌ জরুরি কি-না? ৩০০ আসনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় একদিনেই এবং যেখানে সরকারও পরিবর্তন হবে। তাই আমি মনে করি, এটি জাতীয় নির্বাচনের পূর্বভাস নয়। এ নির্বাচন দিয়ে নির্বাচন কমিশনের দক্ষতা, যোগ্যতা নিরুপণ করা সম্ভব নয়। জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন কতটা দক্ষতা ও কার্যকারিতা প্রদর্শন করতে পারে তাই হবে দেখার বিষয়।”
ড. হামিদা হোসেন বলেন, “সংরক্ষিত আসন-সহ সাধারণ আসনে তিনজন মাত্র নারী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। নির্বাচনে কি আদৌও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম-সুযোগ রয়েছে কি না-এ নিয়ে আমার মনে সংশয় রয়েছে। আমি মনে করি, এর পেছনে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতাই মূলত দায়ী।”
মূল প্রবন্ধ পড়তে এখানে ক্লিক করুন