গত ৩০ জুন ২০১১, আমাদের জাতীয় সংসদ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাশ করেছে। সংবিধান সংশোধন বিলে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের অন্তর্ভূক্তি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিলুপ্তি নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক লেখালেখি ও আলোচনা হলেও, এখনও অনেকেই সংসদে অনুমোদিত পঞ্চদশ সংশোধনীর সার্বিক বিষয়াবলী সম্পর্কে অবগত নন। তাই, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর একটি প্রাথমিক বিশ্লেষণ তুলে ধরার লক্ষ্যে সুজন ১৭ জুলাই ২০১১ ‘সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী ও এর তাৎপর্য’ শীর্ষক একট গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে।
সুজন সহ-সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন, ড. শাহদীন মালিক ও ড. আসিফ নজরুল, রাজনীতিবিদ জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না, জনাব আ স ম আবদুর রব, জনাব হুমায়ন কবীর ও জনাব রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাংবাদিক সৈয়দ আবুল মকসুদ, জনাব মিজানুর রহমান খান ও জনাব ম হামিদ, নারী নেত্রী বেগম সালমা খান, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার প্রমুখ।
বৈঠকে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, গোঁজামিল দিয়ে বর্তমান ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকার একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধন করেছে যা জাতিকে সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তিনি ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলকে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে, সমঝোতার মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে সংবিধানে রাষ্ট্রের মালিক জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তি ঘটানোর আহ্বান জানান। আদালতের রায়ের অজুহাত দেখিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পূর্ণাঙ্গ রায় হাতে না পেয়ে সরকার এহেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যা অনভিপ্রেত। ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং কোনো বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান একসঙ্গে যেতে পারেনা বলে তিনি মত দেন। সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারী নেতৃত্বের ক্ষমতায়নে বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ৫০টিরও বেশী অনুচ্ছেদকে সংবিধানে অযোগ্য ঘোষণা প্রসঙ্গে তিনি বলেন এতগুলো অনুচ্ছেদ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভূক্ত হতে পারে না। তিনি সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক-স্বচ্ছ-দ্বায়বদ্ধ-জনকল্যানমূখী করা, নির্বাচন কমিশনকে স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, দলীয় প্রশাসন, অনুগত আইন-শৃংখলাবাহিনী থাকলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতার পালাবদল অসম্ভব হয়ে পড়বে যা অনাকাংখিত।
ড. কামাল হোসেন প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের ওপর জোর দিয়ে বলেন, আমাদেরকে সঠিকভাবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের পথ খুঁজে বের করতে হবে। সমাজে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এরজন্য নিরপক্ষভাবে দক্ষ, যোগ্য বিচারপতি নিয়োগ দিতে হবে। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করতে হবে যাতে তারা দলীয় সরকারের আজ্ঞাবহ না হয়। তিনি বলেন, সংবিধানে ঘাটতিগুলো পূরণ করা হয়নি বরঞ্চ নতুন সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীকে জঘন্য কাজ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংবিধানের অসামঞ্জস্যগুলো খুঁজে বের করার জন্য এবং স্বাধীনতার চেতনায় সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি ‘পিপলস কমিশন’ গঠন করা যেতে পারে।
ড. শাহদীন মালিক সংবিধানকে চলমান অধিকার এবং অধিকার আদায়ের দলিল উল্লেখ করে বলেন, সংবিধান সংশোধনের পর মন খারাপ হয়ে গেছে। আমার কান্না পাচ্ছে। আমাদের অনেক ভালো একটা সংবিধানকে অপ্রয়োগযোগ্য করে ফেলা হয়েছে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। এই সংশোধনী সমাজকে অস্থিতিশীল করে ফেলেছে বলে তিনি মনে করেন।
জনাব মাহমুদুর রজমান মান্না বলেন, যে রায়ের আলোকে পঞ্চদশ সংশোধনী করেছে সরকার সে রায় প্রদাণকারী প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি পুরো রায় লেখার জন্য ৬ মাস সময় নিয়েছেন যা অনাকাংকিত। দুই নেত্রীর ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত, দলগত সংঘাত আমাদের জীবনকে অস্থির করে তুলেছে বলে তিনি মত দেন। জনাব মিজানুর রহমান খান সংবিধানের মূল দূর্বলতা হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর একক সর্বময় ক্ষমতাকে সমস্যা বলে উল্লেখ করেন। সমস্ত সাংবিধানিক পদে নিয়োগ প্রদান এবং বাতিলের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা এবং মন্ত্রিপরিষদের উপর সর্বময় প্রভাব, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অন্তরায় বলে তিনি অভিমত দেন। কেন্দ্রীভূত শাসন ব্যবস্থার কারনে গণতন্ত্র অকার্যকর হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি গোটা জাতিকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। আসিফ নজরুল জানতে চান, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের স্বার্থে আরো দুই টার্ম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যেতে পারে বলে মত দেন। তাহলে জনগণের স্বার্থে এবং রাষ্ট্রের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে আরো দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখলেন না কেন?
[
সৈয়দ আবুল মকসুদ দেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য, গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জনাব হুমায়ন কবীর আইনজ্ঞদের আহ্বান জানান পঞ্চদশ সংশোধনীর বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ের জন্য। রুহিন হোসেন প্রিন্স ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার নাগরিকদের অধিকার সংবিধানে প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানান। শামরিক শাসক জিয়া, এরশাদের ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কিত ফরমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে সংবিধানে বাস্তবায়িত হওয়ায় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এম হাফিজ উদ্দিন খান রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করেন এবং রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্য আনার প্রস্তাব দেন। রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনের মাধ্যমে সমস্ত সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
’সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী ও এর তাৎপর্য’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত পঞ্চদশ সংশোধনী দেশকে সংকটের দিকে ধাবিত করবে
Categories: