সংসদ সদস্যদেরকে সংসদীয় কাজে নিবিষ্ট করা এবং তাঁদেরকে স্থানীয় উন্নয়ন কাজ থেকে দূরে রাখা; সংসদীয় কার্যক্রমে সর্বোচ্চ অবদান রাখার লক্ষ্যে তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা এবং সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় জনবল ও উপকরণ সহযোগিতা প্রদান করা; অনুমতি ব্যতিরেকে এক নাগাড়ে ৩০ দিনের বেশি সংসদ অধিবেশন বর্জনের কারণে সংসদ সদস্যপদ বাতিলের বিধানসম্বলিত আইন প্রণয়ন করা; সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকারকে কার্যকারিতা প্রদানের লক্ষ্যে একটি আইন ও সংসদ সদস্যদের জন্য জরুরিভিত্তিতে একটি আচরণবিধি প্রণয়ন করা; যে সকল সংসদ সদস্য মিথ্যা হলফনামা প্রদান করে অসদাচারণে লিপ্ত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা করা; দিনবদলের সনদে অন্তর্ভুক্ত অঙ্গীকার অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভার সদস্য এবং সংসদ সদস্য ও তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাব ও আয়ের উৎস প্রতিবছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা এবং দিনবদলের সনদে অন্তর্ভুক্ত অঙ্গীকার অনুযায়ী রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত কতিপয় সুনির্দিষ্ট বিষয় ছাড়া সংসদ সদস্যদের ভিন্নমত প্রকাশের অধিকার প্রদান করা – আজ সকাল ১০:৩০টায় ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিকে’র আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক গোলটেবিল আলোচনায় সংসদকে একটি কার্যকর ও দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার লক্ষ্যে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে এ সকল করণীয় বিষয়সমূহ উপস্থাপন করা হয়। ‘সুজন’ নির্বাহি সদস্য জনাব এএসএম শাহাজাহানের সঞ্চালনায় “সংসদের কার্যকারিতা ও সংসদ সদস্যদের আচরণবিধি” শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনাটি জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়।
বিভিন্ন স্তরে নেতৃত্বের বিকাশের জন্য স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করে তোলা এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তনের ওপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করে সভাপতির বক্তব্যে ‘সুজন’ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ বলেন, মার্কার রাজনীতির পরিবর্তন ঘটিয়ে সৎ ও যোগ্য প্রতিনিধিকে ভোট দিতে হবে এবং এজন্য জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। কিন্তু সেই অবস্থানে কোনো রাজনৈতিক দলই যেতে চান না। তিনি বলেন, সংবিধানে বলা থাকলেও প্রিভিলেজ এক্ট আমাদের হয় নি তাই এটা করা প্রয়োজন। এছাড়া সংসদের ভেতরের কাজের জন্য প্রিভিলেজ এন্ড ইমিউনিটি রয়েছে কিন্তু এমপি’রা আমাদের নেতা তাই সংসদের বাইরেও অনার সিস্টেমের মধ্য দিয়েই অটোমেটিক্যালি রোল মডেল হিসেবে তারা ডিফাইন হওয়ার প্রত্যাশা ছিল – যা হয়নি, তাই কোড অফ কনডাক্ট তাদের জন্য করাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গণতন্ত্রকে সুসংহত করে তুলতে এমপিদের কাজ ও অকাজের ভিত্তিতে এমপি স্কোর কার্ড করা যেতে পারে বলেও এ সময় তিনি মন্তব্য করেন। সাংঘর্ষিক রাজনীতি পরিহার করে সৌহার্দ্য, ঐকমত্য ও সংঘবদ্ধতা প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করে জনাব এএসএম শাহাজাহান বলেন, বড় হওয়াটা বড় কথা নয়, ভালো হওয়াটাই বড় কথা।
জাতীয় সংসদ আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। তাই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভিতের ওপর দাঁড় করানোর জন্য জাতীয় সংসদকে কার্যকর করা অতি অপরিহার্য। এটি আমাদের জাতীয় অঙ্গীকারও বটে উল্লেখ করে মূল প্রবন্ধে ‘সুজন’ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জাতীয় সংসদ হতে পারে আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দু। এটিই সাংবিধানিক পন্থা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কার্যকর ও চলমান রাখতে হলে এর ভিতকে সুদৃঢ় করার কোনো বিকল্প নেই। সংসদকে কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জাতীয় সমস্যা সমাধানের বিকল্প ব্যবস্থা হলো রাজপথ। অসংবিধানিক না হলেও, এটি একটি অনিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি। তাই গণতন্ত্রের ভিত সুদৃঢ় করতে হলে আমাদেরকেও নিয়মতান্ত্রিক পথে চলতে হবে এবং জাতীয় সংসদকে কার্যকর করতে হবে। সংসদের দায়িত্বসমূহ উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, নিজেদের সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাও সংসদের কার্যক্রমের অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কিন্তু সংসদ সদস্যদের নিজেদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার ব্যাপারে আমাদের অতীতের কোনো সংসদই আগ্রহ প্রদর্শন করেনি। নবম জাতীয় সংসদের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায় না। তিনি বলেন, অতীতে আমাদের সংসদ সদস্যগণ গাড়ি বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছেন। এবারও তাঁরা ট্যাক্স ফ্রি গাড়ী পাচ্ছেন, যার মাধ্যমে সরকার কয়েক শ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হবে।
সাবেক মন্ত্রী জনাব সরদার আমজাদ হোসেন বলেন, পার্লামেন্টের বাইরে এমপিরা কি করবেন সেটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ তাই তাদের জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন ও সংসদে তা পাশ করতে হবে। সাবেক সচিব জনাব মুসলেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সংসদে বসে যে ধরনের মন্তব্য করা হয়, যে ধরনের ভাষা ব্যবহার করা হয় সেটা এমপিদের মানায় না। যদি তারা মাননীয়-ই হয়ে থাকেন তাহলে গালাগাল করবেন কেন? সংসদে আলোচনার আহ্বান জানিয়ে তিনি রাজপথে নামার সংস্কৃতির পরিবর্তন করার আহ্বান জানান। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিঞা বলেন, সরকারে থাকুন বা বিরোধী দলেই থাকুন প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে সংসদে যাওয়া ও সংসদের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা। এছাড়া বৈদেশিক চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে এ বিষয়ে সংসদে আলোচনা হওয়া উচিত ও বিষয়টি আইন অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি। সংসদকে কার্যকর করে তুলতে গঠনমূলক সমালোচনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আগে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন জনাব গোলাম মাওলা রনি এমপি। এজন্য একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল মনোভাবের প্রয়োজন রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। লেঃ জেঃ অবঃ মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাংঘর্ষিক রাজনীতিই হলো সবচেয়ে বড় সমস্যা। এর যে বিশ্বচ: সেখান থেকে বের না হয়ে আসলে যতই আইন প্রণয়ন করা হোক না কেন খুব একটা সুফল বয়ে আসবে না। এছাড়া তিনি একটু দেরি হলেও বিরোধী দলের সংসদে যোগদান করাকে স্বাগত জানান। আমাদের অনেক ভুল ভ্রান্তি হচ্ছে, কিন্তু আমাদের অনেক উন্নতিও সাধিত হচ্ছে এটা স্বীকার করতে হবে উল্লেখ করে পাবলিক সার্র্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোস্তফা চৌধুরী বলেন, আমাদের পাবলিক একাউন্স কমিটিগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তোলা প্রয়োজন, একইসাথে তিনি এমপিদের গাড়ির কোনো দরকার নেই বলেও মন্তব্য করেন। সাবেক সচিব জনাব কে এম নুরুল হুদা বলেন, রাস্তঘাট না করলে, গম বিতরণ না করলে ভোট পাওয়া যাবে না এটা কোনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি হতে পারে না। রাজনীতিতে এ জাতীয় সংস্কৃতির পরিবর্তন করা সম্ভব হলেই সার্বিকভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। অবিলম্বে রেটিফিকেশনের ব্যবস্থা করার দাবি জানান প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব এনাম আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এ নিয়ে অলোচনাও হওয়া উচিত। এছাড়া সংসদ সদস্যদের তাদের দায়িত্ব পালনে নিজেদেরকেই সচেতন হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সময়ের প্রয়োজন হবে কিন্তু আগে সংস্কৃতি পাল্টাতে হবে এবং এজন্য রাজনীতিতে ও সমাজে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা জরুরি বলে অভিমত ব্যক্ত করেন রাজনীতিবিদ জনাব মাহমুদুর রহমান মান্না। জাতীয় পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব জনাব সাদেক সিদ্দিকী ব্যরিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের ঘটনা তুলে ধরে বলেন এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক। আচরণবিধিতে এ সকল বিষয় সন্নিবেশনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে অন্যরা সংশোধিত হবেন এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।
এছাড়া গোলটেবিল আলোচনায় আরো বক্তব্য রাখেন ইলিয়াছ কাঞ্চন, রোকেয়া রফিক, প্রফেসর কামাল আতাউর রহমান, জনাব হাবিবুল হাসান প্রমুখ।
Keynote Paper /মূল প্রবন্ধ ডাউনলোড করুন
“সংসদের কার্যকারিতা ও সংসদ সদস্যদের আচরণবিধি” শীর্ষক সুজনে’র গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত
Categories: