সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শানি-পূর্ণ হবে না। তাই সংসদ ভেঙে দিয়ে দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার আহবান জানিয়েছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ। আজ সকাল ১০টায়, জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক আয়োজিত ‘রাজনৈতিক সংকট নিরসনে করণীয়’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় তারা এ আহবান জানান।
মতবিনিমিয় সভায় মূল বক্তব্য উপস’াপন করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজমুদার। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সুজন সভাপতি জনাব এম হাফিজউদ্দিন খান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব জনাব আলী ইমাম মজুমদার, সুজন নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, সুজন নির্বাহী সদস্য জনাব ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাংবাদিক মুনির হায়দার ও গোলাম মুর্তজা প্রমুখ।
ড. বদিউল আলম মজুমদার তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘জাতি হিসেবে আজ আমরা এক ক্রসরোডে অবস’ান করছি। আমাদের একদিকে রয়েছে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শানি-পূর্ণ এবং সবার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণ। অন্যদিকে রয়েছে একদলীয় নির্বাচন করার মাধ্যমে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যাবস’াকে আবারও খাদে ফেলে দেওয়া ব্যবস’া। তাই আজ অনেকের আশঙ্কা যে, বিরোধী দলের বর্জনের মুখে এক তরফা নির্বাচনের ফলে সারাদেশে সহিংতা সৃষ্টি ছড়াবে এবং জাতি হিসেবে আমরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যেতের দিকে ধাবিত হব। এর পরিণতি হবে একটি অকার্যকর, এমনকি উগ্রবাদী রাষ্ট্র।’
সুজন সম্পাদক বলেন, ‘যেহেতু সরকার সংবিধান সংশোধন না করার সিদ্ধান- নিয়েছে, তাই সংবিধানিক কাঠামোর মধ্যেই সংলাপের মাধ্যমে সমাধান বের করতে হবে। এ ছাড়াও সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নির্বাচনকালীন সরকারের নির্বাচিত হবার ব্যাপারে বাধ্যধবাধকতা রয়েছে। তাই নির্বাচিত ব্যক্তিদের নিয়েই নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হতে হবে, যদি না সরকার শেষ মূহুর্তে মত পরিবর্তন করে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যাবস’া সংবিধানে পুনঃস’াপনের সিদ্ধান- নেয়।’
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিরাজমান সংবিধানিক কাঠামোর মধ্য থেকে একটি নির্বাচিত ও কার্যকর নির্বাচনকালীন সরকার দুইভাবে গঠিত হতে পারে বলে আমরা মনে করি। এর একটি হতে পারে দল নিরপেক্ষ ১১ জন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাদেরকে নির্বাচিত করে এনে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা। এজন্য অবশ্য সম-সংখ্য্ক বর্তমান সংসদ সদস্যের পদত্যাগ করতে হবে। নির্বাচনকালীন নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় বিকল্প হতে পারে সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের মধ্য থেকে পাঁচজন করে দশজন এবং নির্দলীয় ব্যক্তিদের মধ্য আরও পাঁচজনকে নিয়ে মোট ১৫ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা। এক্ষেত্রেও নির্দলীয় ব্যক্তিদের নির্বাচিত করে আনতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে প্রথম বিকল্পের দশজন অথবা দ্বিতীয় বিকল্পের ১৫ জনকে একটি অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে মনোনীত করা যেতে পারে। আমাদের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের নিয়ে এই অনুসন্ধান কমিটি গঠিত হতে পারে এবং সবার জ্যেষ্ঠ সাবেক প্রধান বিচারপতি কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন।’
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার লক্ষ্যে সরকারকে বাধ্য করতে জেলায় জেলায় আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে অতীতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় ৮৬, ৯৬ ও ২০০৬ সালের নির্বাচন জনগণ গ্রহণ করেনি। স্বাধীনতার ৪২ বছর পর আমাদের নির্বাচন নিয়ে বিদেশীরা পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন, যা অত্যন- দুঃখজনক। তিনি বলেন, আজকে হলমার্ক ইস্যুতে চার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হলেও সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন যে, এ কিছুই না। তাই এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। গত তিন বছরে সুপ্রিম কোর্টে ৬১ জন বিচারপতি নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যা নজিরবিহীন। কোন যোগ্যতায় তাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে জাতি তা জানতে চায়।’ তাই আদালত তথা রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার অধিকার কারও নেই বলে মন-ব্য করেন ড. কামাল হোসেন।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘বর্তমান সংকট নিরসনে কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। অথচ সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে আমাদের অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস’াসহ অন্যান্য সব খাতই ক্ষতিগ্রস- হবে। তাই নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে জনগণের প্রত্যাশা পুরণে কাজ করার।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বড় দু দলের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। উভয় দলই দলীয়করণ ও দুর্নীতি করে এবং আইনের শাসন মানতে আগ্রহী নয়।’ এ সময় তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দেন।’
বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আমাদের দেশে যারাই ক্ষমতায় থাকেন তারা বিরোধী দলের ওপর নির্যাতন চালায়। তাই কেউই বিরোধী দলে যেতে চায় না। যে কারণে আজকের সংকট তৈরি হয়েছে। আজকে বিদেশী কুটনৈতিকরা আমাদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা এটা মেনে নিতে পারি না। অথচ নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ বিভিন্ন পরামর্শ দিলেও তা গ্রহণ করা হচ্ছে না।’তিনি বলেন, ‘একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে আমাদের ভোটারদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। যেমন- না ভোটের বিধান পুনরায় প্রবর্তন, রি-কল সিস্টেম চালু, স’ানীয় নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতে গঠিত প্যানেলের মাধ্যমে মনোনয়ন দেয়া।’ সর্বপরি যে সরকারই থাকুক না কেন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মন-ব্য করেন এম সাখাওয়াত হোসেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে উন্নয়ন তরান্বিত করতে রাষ্ট্রের ব্যবস’াপনায় নাগরিক সমাজের একটা নজরদারি থাকা প্রয়োজন। কিন’ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত আমাদের এখানে সে রকম কোন নাগরিক সমাজ গড়ে ওঠেনি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনীতিবীদরা তাদের স্বাধীন সত্ত্বা হারিয়ে ফেলেছেন। অতীতে দলীয় সভায় বিরাজমান পরিসি’তি পর্যালোচনা করে দলের পক্ষ থেকে নিয়মিত বিবৃতি দেয়া হতো। কিন’ বর্তমানে সে শৃঙ্খলা নেই। এখন দলের প্রধান প্রতিদিন যা বলেন তাই যেন অলিখিত সংবিধান। তাই আমরা দলের তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট বার্তা শুনতে চাই।’ এর মাধ্যমে গণতন্ত্র শক্তিশালী হবে বলেও মন-ব্য করেন তিনি।
মূল প্রবন্ধ পড়ত এখানে ক্লিক করুন
“সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না” সুজন এর মতবিনিময় সভায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিগণ
Categories: