সংসদ সদস্য আচরণ আইনের অপরিহার্যতা

main-logo.gif
ড. বদিউল আলম মজুমদার
আইনসভা বা সংসদ সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। আর সংসদীয় গণতন্ত্রের চরিত্র ও গুণগত মান নির্ভর করে সংসদ সদস্যদের নিজেদের গুণ, মান ও আচরণের ওপর। একইভাবে সংসদের মর্যাদা এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রতি জনগণের আস্থা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত সংসদ সদস্যদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও তাঁদের সুনাম-দুর্নামের ওপর। তাই সংসদের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে এবং এর কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হলে সংসদ সদস্যদের আচরণ সংযতকরণ ও নিয়ন্ত্রণের কোনো বিকল্প নেই। এ কারণেই বিশেষত আইন প্রণেতাদের সদাচরণ নিশ্চিত করতে একটি সংসদ সদস্য আচরণ আইন প্রণয়ন অপরিহার্য। এর মাধ্যমে তাঁদের অসদাচরণে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা সম্ভব।
ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর অপব্যবহার। বস্তুত ক্ষমতা যেখানে, অপব্যবহারও সেখানে। কারণ ক্ষমতাধররাই ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন। মানবিক দুর্বলতার কারণেই তা ঘটে। তাই ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অনেক সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়। আদালত ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়।
সংসদীয় পদ্ধতিতেও কিছু ‘চেকস’ বা নিবৃত্তকরণের ব্যবস্থা থাকে, যেমন- ‘সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার’ সম্পর্কিত কমিটির মাধ্যমে অসদাচরণের কারণে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সংসদ সদস্যদের অনিয়ম, অসততা ও দুর্নীতি তথা অসদাচরণ জনসমক্ষে সংসদের মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত করে, যা সংসদ অবমাননা বলে গণ্য করা হয়। প্রতিবেশী ভারতের মতো অনেক রাষ্ট্রেই সংসদ অবমাননার অভিযোগে সংসদ থেকে বহিষ্কারের মতো কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়মিতভাবে নেওয়া হয়। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রায় তিন ডজন ব্যক্তির গণপরিষদের সদস্যপদ খারিজ করা হয়। এ ধরনের শাস্তির উদ্দেশ্য হলো সংসদ সদস্যদের সদাচরণ নিশ্চিত করা।
অন্যায় আচরণের জন্য সংসদ সদস্যদের শাস্তি প্রদান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অন্যায় আচরণ করে শাস্তি না পেলে অন্যায়কে উৎসাহিতই করা হয়। তবে অপরাধের পর শাস্তির চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো অপরাধ আগে থেকেই রোধ করা। আর এ জন্যই প্রয়োজন একটি যুগোপযোগী সংসদ সদস্য আচরণ আইন প্রণয়ন এবং এর কঠোর বাস্তবায়ন। একটি যথার্থ আচরণবিধি মেনে চলার বাধ্যবাধকতা থাকলে সংসদ সদস্যরা অপকর্ম থেকে নিজেদের দূরে রাখবেন বলে আশা করা যায়।
সংসদ সদস্যদের কাঙ্ক্ষিত আচরণ
বহুদিনের সংসদীয় গণতন্ত্রচর্চার অভিজ্ঞতার আলোকে সংসদ সদস্যদের আচরণের একটি মানদণ্ড ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের ‘কমিটি অন স্ট্যান্ডার্ড ইন পাবলিক লাইফ’ (Committee on Standard in Public Life) তার পঞ্চম প্রতিবেদনে সাতটি এমন ‘প্রিন্সিপল’ বা নীতিমালা চিহ্নিত করেছে। প্রিন্সিপলগুলো হলো :
১. নিঃস্বার্থতা (Selflessness) : জনসাধারণের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের একমাত্র জনস্বার্থেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা আবশ্যক। তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক অথবা বন্ধুদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকা প্রয়োজন।
২. সত্যনিষ্ঠতা বা সাধুতা (Integrity) : জনসাধারণের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে কোনো ধরনের আর্থিক বা অন্য ধরনের দায় সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক, যাতে তারা তাদের দাপ্তরিক কাজ সম্পাদনে কোনোভাবে প্রভাবিত না হন।
৩. বস্তুনিষ্ঠতা (Objectivity) : জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের যোগ্যতার ওপরই গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। যেমন- সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, ঠিকাদারি চুক্তি স্বাক্ষর অথবা কোনো ধরনের পুরস্কার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য সুপারিশের ক্ষেত্রে।
৪. দায়বদ্ধতা (Accountability) : জনসাধারণের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। তাই তাঁদের পদের জন্য উপযুক্ত ধরনের জবাবদিহির মুখোমুখি হওয়া আবশ্যক।
৫. উন্মুক্ততা (Openness) : জনসাধারণের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সব কাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ উন্মুক্ততা প্রদর্শন করা আবশ্যক। সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনের কারণ তাঁদের তুলে ধরা দরকার এবং একমাত্র বৃহত্তর জনস্বার্থেই তাঁদের তথ্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকা উচিত।
৬. সততা (Honesty) : জনসাধারণের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের নিজ দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব ব্যক্তিগত স্বার্থের বিষয় প্রকাশ করা আবশ্যক। তাঁদের স্বার্থের দ্বন্দ্বে বিষয়গুলো এমনভাবে নিরসন করা দরকার, যাতে জনস্বার্থ সংরক্ষিত হয়।
৭. নেতৃত্ব (Leadership) : জনসাধারণের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের এসব প্রিন্সিপল সমর্থন ও সমুন্নত রাখার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রদর্শন ও দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা আবশ্যক।
ভারতীয় লোকসভার ‘কমিটি টু ইনকোয়ার ইনটু মিসকন্ডাক্ট অব মেম্বারস অব লোকসভার (Committe to Inquire into Misconduct of Members of Loksabha) চেয়ারম্যান ভি কিশোরচন্দ্র এস ডিওর ২০০৮ সালের প্রতিবেদনে ভারতীয় লোকসভার সদস্যদের জন্য আচরণবিধিতে আরো দুটি প্রিন্সিপল বা নৈতিকতার মানদণ্ড যুক্ত করা হয়, যেগুলো হলো-
১. জনস্বার্থ (Public Interest) : সর্বোচ্চ পেশাগত যোগ্যতা, দক্ষতা ও ফলপ্রসূতা প্রদর্শন, রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইন মেনে চলা এবং সর্বদা জনস্বার্থ সমুন্নত রাখার মাধ্যমে লোকসভার সদস্যরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে লোকসভার প্রতি জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা বহাল রাখবেন ও জোরদার করবেন।
২. দায়িত্ব (Responsibility) : লোকসভায় সদস্যদের নিশ্চিত করা দরকার যে তাঁদের সব সিদ্ধান্ত দায়িত্বশীলতার নীতিমালার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ তাঁদের সিদ্ধান্তগুলো যেন অপরিণামদর্শী বা অবহেলাপূর্ণ না হয়; বরং সিদ্ধান্তগুলো যেন গ্রহণ করা হয় এগুলো সম্ভাব্য ও যুক্তিসংগত পরিণামের সঙ্গে সম্পৃক্ত সব বিষয়ের যথাযথ বিবেচনার ভিত্তিতে।
আমাদের সংসদ সদস্যদের আচরণ
স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের কিছু গণপরিষদ সদস্যের আচরণ নিয়ে নানা প্রশ্ন ওঠে। কারো কারো বিরুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানিদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগও ওঠে। কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ গণপরিষদের সদস্যপদ বাতিলসংক্রান্ত রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে একটি নির্দেশ জারি করা হয়। ওই নির্দেশের আলোকে ১৯৭২ সালের ৬ এপ্রিল ১৬ জন সদস্যকে দুর্নীতির অভিযোগে গণপরিষদ থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২২ সেপ্টেম্বর আরো ১৯ জনের গণপরিষদ সদস্যপদ খারিজ করা হয়।
দুর্ভাগ্যবশত পরবর্তী সময়ে ক্রমান্বয়ে আমাদের সংসদ সদস্যদের নৈতিকতার মানে অবনতি ঘটতে থাকে। তাঁরা বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এর একটি বড় কারণ অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া, যা একটি ‘কালচার অব ইম্পিউনিটি’ বা অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতিও আইন প্রণেতাদের মধ্যে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করেছে।
অনেকে আশা করেছিলেন, ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পর সংসদ সদস্যদের গুণগত মানে পরিবর্তন আসবে এবং আমরা সততা ও নৈতিকতার নতুন মানদণ্ড অর্জন করব। কিন্তু এই আশা বাস্তবে রূপায়িত হয়নি এবং ১৯৯১ সাল থেকে কোনো সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগে কোনোরূপ শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অনেকের স্মরণ আছে, পঞ্চম সংসদে একজন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সরকারি দল ও বিরোধী দল একটি তদন্ত কমিটির ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি। যে কারণে পুরো বিষয়টিই ধামাচাপা পড়ে যায়।
অপরাধ কর্মকাণ্ডের জন্য আমাদের সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে যে কোনোরূপ ব্যবস্থা নেওয়া হয় না, তার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। অনেকের স্মরণ আছে, সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও প্রয়াত চিফ হুইফ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে অ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়ার নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কমিটি তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের সুস্পষ্ট প্রমাণ পায়। তা সত্ত্বেও তাঁদের বিরুদ্ধে কোনোরূপ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে সংসদ বিষয়টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে প্রেরণ করে।
সংসদ সদস্যদের অনৈতিক কাজে জড়িত হওয়ার আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো, নবম জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার শুরুতে সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি লঙ্ঘন করে ১৫ জন সংসদ সদস্য নিজেদের স্বার্থ জড়িত আছে এমন সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হন (প্রথম আলো, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০)। অন্য একটি নগ্ন দৃষ্টান্ত হলো, ২০০৯ সালে মিথ্যা হলফনামা দিয়ে ১৮ জন সংসদ সদস্য উত্তরা আবাসিক এলাকায় প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন (প্রথম আলো, ২৭ জানুয়ারি ২০১০)। মিথ্যা বলা একটি গর্হিত কাজ এবং হলফনামার মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য প্রদান একটি দণ্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু আমাদের জানা মতে, তাঁদের কারো বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছরে আমাদের রাজনীতিতে রাজনৈতিক হয়রানির অজুহাতে মামলা প্রত্যাহারের একটি ভয়াবহ অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। গত সরকারের আমলে এমন অজুহাতে দলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় ছয় হাজার মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে সংসদ সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বর্তমান সরকারের আমলেও এ অপসংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে। গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, দলীয় বিবেচনায় সাত হাজারের বেশি মামলা ইতিমধ্যেই তুলে নেওয়া হয়েছে এবং আরো মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ বিবেচনাধীন। এ ধরনের মামলা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত শুধু আইনের শাসনের পরিপন্থীই নয়, এর মাধ্যমে অপরাধ কর্মকাণ্ডও উৎসাহিত হয়। নিঃসন্দেহে আমাদের সংসদ সদস্যরা এ ধরনের কালচার অব ইম্পিউনিটির সুফল ভোগকারী।
প্রয়োজনীয় আচরণবিধির অভাব এবং অপরাধের জন্য শাস্তি প্রদানে অনীহার কারণে আমাদের সংসদ সদস্যদের অনেকেই এখন অনেক নেতিবাচক কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন। টিআইবি এ সম্পর্কে গত বছর একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সারা দেশের ৪২টি জেলায় ৪৪টি দলগত আলোচনার ভিত্তিতে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়, যে আলোচনায় মোট ৬০০ জন আলোচক অংশ নেন। জেলাগুলোতে অন্তর্ভুক্ত ২২০টি আসনের মধ্যে ১৪৯টি আসনের সংসদ সদস্যদের নিয়ে আলোচনাগুলো পরিচালিত হয় এবং আলোচকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মতামত গ্রহণ করা হয়। মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহের সময় সংসদ সদস্যদের ওপর সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের যথার্থতা যাচাই এবং সম্পূরক তথ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১৪৯টি আসনের সংসদ সদস্যের মধ্যে পুরুষ ১৪১ জন (৯৪.৬%) ও নারী সদস্য ৮ জন (৫.৪%); এবং সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ১৩৬ জন (৯১.৩%) ও বিরোধীদলীয় ১৩ জন (৮.৭%)। সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের মধ্যে মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী ২৭ জন (১৮.১%)।
গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত সংসদ সদস্যদের ৫৩.৭ শতাংশ কোনো না কোনো ধরনের ইতিবাচক কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বলে দেখা যায়। তাঁদের মধ্যে নারী সংসদ সদস্য ৬ জন, মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী ১৯ জন এবং বিরোধী দলের ৫ জন সংসদ সদস্য। পক্ষান্তরে দলগত আলোচনা থেকে দেখা যায়, গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত সংসদ সদস্যদের ৯৭ শতাংশ বিভিন্ন নেতিবাচক কার্যক্রমে জড়িত। নেতিবাচক কার্যক্রমে জড়িতদের মধ্যে নারী সদস্য ৭ জন, ২৭ জন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর সবাই এবং বিরোধী দলের সংসদ সদস্য ১২ জন।
ব্যাপক হারে সংসদ সদস্যদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার একটি বড় কারণ হলো, আমাদের সংসদ সদস্যদের সংসদমুখী না হওয়া। বর্তমান সংসদ সদস্যদের, এমনকি অষ্টম সংসদের অনেকেই তথাকথিত স্থানীয় উন্নয়নের নামে স্থানীয়ভাবে অনেক অপকর্মের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছেন। আর তা করা হয়েছে দুর্ভাগ্যবশত সংবিধান লঙ্ঘন এবং উচ্চ আদালতের রায় অমান্য করে। নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার কারণে অনেক সংসদ সদস্য অনেক দুর্নাম কুড়িয়েছেন। তাঁরা বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন, যার প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়বে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। তাই নবম সংসদের অনেক সদস্যই আগামী নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত হবেন বলে ধারণা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি সাম্প্রতিক শিরোনাম ছিল ‘আওয়ামী লীগের ১৫০ এমপি বাদ পড়ছেন’ (২৮ জুন ২০১৩)। সরকার এবং দলের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক জরিপের ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। জরিপ থেকে দেখা গেছে, এসব এমপি এলাকায় জনবিচ্ছিন্ন, দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত এবং স্থানীয় দলীয় নেতা-কর্মীদের সমর্থন হারানো। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভবিষ্যতে এমন অবস্থার পুনরাবৃত্তি এড়াতে হলে সংসদ সদস্যদের সংযত ও দায়িত্বশীল আচরণ আবশ্যক। আর এ জন্যই প্রয়োজন সংসদ সদস্য আচরণ আইন।
সংসদ সদস্যরা ‘হাউস অব দ্য পিপল’ বা মহান জাতীয় সংসদের সদস্য। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি। নাগরিকরা তাঁদের কাছে দায়িত্বশীল ও দৃষ্টান্তমূলক আচরণ আশা করেন। এ ছাড়া সংসদ সদস্যরা সততা, স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করলে জনগণের কাছে সংসদের এবং নিজেদের সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সংসদের অভ্যন্তরে সংসদ সদস্যদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কার্যপ্রণালী বিধিতে সুস্পষ্ট বিধিবিধান থাকলেও সংসদের বাইরে তাঁদের সংযত আচরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কোনো বিধিবদ্ধ আইন নেই। তাই আমরা বেসরকারি বিল হিসেবে ‘সংসদ সদস্য আইন’ পাসের জোর দাবি জানাই। প্রসঙ্গত, প্রতিবেশী ভারতসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই সংসদ সদস্যদের জন্য সুস্পষ্ট আচরণবিধি রয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও তাদের দিনবদলের সনদে এমন একটি আচরণবিধি প্রণয়নের অঙ্গীকার করে।
আইনটি পাসের ক্ষেত্রে আমরা প্রস্তাবিত বিলের ১২ ধারাটি পুনঃস্থাপনের দাবি জানাই। একই সঙ্গে দাবি জানাই সংসদ সদস্যদের কার্যপরিধি সংসদীয় কার্যক্রমের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার। বিশেষত তাঁদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর উপদেষ্টার ভূমিকা ও হস্তক্ষেপের অবসান আজ জরুরি হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে জরুরি হয়ে পড়েছে বৈষম্যমূলকভাবে তাঁদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানি ও আবাসিক এলাকায় প্লটপ্রাপ্তির সুযোগের অবসানের। আরো জরুরি হয়ে পড়েছে সংসদ বর্জনের সংস্কৃতির ইতি টানার। সংসদ সদস্য আচরণ আইন ভঙ্গের অভিযোগে আমরা সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধানও ১৪ ধারায় অন্তর্ভুক্তির দাবি জানাই।
লেখক : সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
প্রকাশিত: কালের কণ্ঠ, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

Related Post

বিভ্রান্ত নাগরিক ও অসহায় নির্বাচন কমিশনবিভ্রান্ত নাগরিক ও অসহায় নির্বাচন কমিশন

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ১০-১০-২০১১ কাজের সুবাদে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আমার যাতায়াত ঘটে। সমাজের সর্বস্তরের জনগণের মতামত শোনার সুযোগ হয়। এসব আলাপ-আলোচনা থেকে আমার মনে হয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে

মেয়র-কাউন্সিলর হওয়ার যোগ্যতামেয়র-কাউন্সিলর হওয়ার যোগ্যতা

ড. ব দি উ ল আ ল ম ম জু ম দা র নির্বাচন কমিশন ৪টি সিটি কর্পোরেশন ও ৯টি পৌরসভার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করেছে। দুর্ভাগ্যবশত জাতীয় পর্যায়ের মতো আমাদের

অতীত হয় নূতন পুনরায়অতীত হয় নূতন পুনরায়

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ২২-০৯-২০১০ পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে সংসদের উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত বিশেষ কমিটি কাজ শুরু করেছে। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত