সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক সংবাদপত্রে সুজন সদস্যদের বহিষ্কারে সংসদের এখতিয়ার এবং আদালতের সিদ্ধান্ত

সদস্যদের বহিষ্কারে সংসদের এখতিয়ার এবং আদালতের সিদ্ধান্ত

t_logo
ড. বদিউল আলম মজুমদার
যুক্তরাজ্যে কোনো লিখিত সংবিধান নেই। তাই দাবি করা হয় যে, সরকারের তিনটি ব্রাঞ্চের মধ্যে পার্লামেন্টই মুখ্য বা সার্বভৌম। তাই পার্লামেন্টের আইনের ক্ষেত্রে অনেকটাই শেষ কথা বলার অধিকার। এছাড়াও ব্রিটিশ হাউজ অব লর্ডস একটি বিচারিক আদালত। কিন্তু আমাদের মতো দেশে, যেখানে লিখিত সংবিধান রয়েছে এবং সংসদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতো ‘কোর্ট অব রেকর্ডস’ (court of records) বা নথিসংরক্ষণকারী আদালত নয়, সে সকল দেশে সংবিধানই ‘সুপ্রিম’ বা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তবে সংবিধানের রক্ষক হিসেবে এর ব্যাখ্যা দেয়ার এখতিয়ার উচ্চ আদালতের।
জনাব কেশব সিংকে উত্তর প্রদেশ প্রাদেশিক পরিষদ কর্তৃক পরিষদ অবমাননার দায়ে জেলে প্রেরণের এবং এ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির কারণে ১৯৬৪ সালে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রেরিত একটি রেফারেন্সের প্রেক্ষিতে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ মতামত [এআইআর (১৯৬৫) এসসি ৭৪৫] দেন যে, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতো ভারতীয় সংসদ কোর্ট অব রেকর্ডস নয়। তাই কাউকে সংসদ অবমাননার দায়ে শাস্তি দেয়ার এখতিয়ার ভারতীয় পার্লামেন্টের নেই। আদালত আরো বলেন: ‘… it is necessary to remember that though our Legislatures have plenary powers, they function within the limits prescribed by the material and relevant provisions of the Constitution. In a democratic country governed by a written Constitution, it is the Constitution which is supreme and sovereign. Therefore, there can be no doubt that the sovereignty which can be claimed by the Parliament in England, cannot be claimed by any Legislature in India in the literal absolute sense.’ (‘…এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে, যদিও সংসদের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে, তবুও সংসদকে সংবিধানের সংশিস্নষ্ট অনুচ্ছেদের বিধানের আওতার মধ্যে থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হয়। লিখিত সংবিধানের আওতায় পরিচালিত একটি গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধানই মুখ্য ও সার্বভৌম। তাই এতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয় যে, ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট যে সার্বভৌমত্ব দাবি করতে পারে, ভারতে কোনো সংসদই আক্ষরিক ও নিরঙ্কুশ অর্থে তা দাবি করতে পারে না।’)
উল্লেখ্য, ১৯৭৭ সালে পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট সাংবিধানিক বেঞ্চের এই রায়ের প্রতি সমর্থন প্রদান করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মধ্য প্রদেশ ও মাদ্রাজ হাইকোর্ট দ্বিমত পোষণ করে রায় দেন যে, ভারতীয় লোকসভা, রাজ্যসভা ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহের তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার এবং তাঁদেরকে বহিষ্কার করার এখতিয়ার রয়েছে।
তবে সংসদ সদস্যদের বহিষ্কারাদেশ সম্পর্কিত ভারতীয় পার্লামেন্টের এখতিয়ার নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের ১০ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখে প্রদত্ত রায়ে। ২০০৫ সালে ১১ জন সংসদ সদস্যদের বহিষ্কারাদেশের পর রাজা রাম পাল নামে একজন লোকসভার সদস্য আদালতে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন [রাজা রাম পাল বনাম মাননীয় স্পীকার (২০০৭) ৩ এসসিসি]। প্রধান বিচারপতি ওয়াই কে সাবারওয়ালের নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের সাংবিধানিক বেঞ্চ মামলার দীর্ঘ রায়ে মূলত দুটি বিষয় খতিয়ে দেখা হয়: সংসদের কি তাদের নিজ সদস্যদের বহিষ্কারের ক্ষমতা আছে? সংসদের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করার এখতিয়ার কি আদালতের রয়েছে? পাঁচ শতাধিক পৃষ্ঠার দীর্ঘ ৪-১ জনের সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে আদালত দুটি প্রশ্নেরই ইতিবাচক জবাব দেন এবং রাজা রাম পালের মামলা খারিজ করে দেন। মামলায় সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে বলা হয়: ‘The expediency and the necessity of exercise of power or privilege by the legislature are for the determination of the legislative authority and not for determination by the courts.’ (‘সংসদীয় ক্ষমতা এবং বিশেষ অধিকার প্রয়োগের উপযোগিতা ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার সংসদীয় কর্তৃপক্ষের। এটি আদালতের বিষয় নয়।’) অর্থাৎ ভারতীয় পার্লামেন্টের তার সদস্যদের বহিষ্কারের ক্ষমতা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে দ্বিমতপোষণকারী বিচারক আর ভি রাভিনড্রানের অভিমতও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন যে: ÔUnlike British Parliament, Indian Parliament is not sovereign. It is the Constitution which is supreme and sovereign and Parliament will have to act within the limitations imposed by the Constitution.’ (‘ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মতো, ভারতীয় পার্লামেন্ট সার্বভৌম নয়। সংবিধানই মুখ্য ও সার্বভৌম এবং পার্লামেন্টকে সংবিধানে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যেই কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।’) তিনি আরো বলেন: Ô… By no stretch of imagination, the power to expel a member can be considered as an ‘incidental’ matter. If such a power was to be given (to the legislature by the framers of the Constitution), it would have been specifically mentioned (in the Constitution).’ [phrases in parentheses are added] এটি কল্পনা করা দুরূহ যে, একজন সংসদ সদস্যকে বহিষ্কার করা একটি ‘লঘু’ বিষয়। যদি (সংবিধান প্রণেতারা সংসদকে) ক্ষমতা দিতে চাইতেন, তাহলে তা (সংবিধানে) সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হতো।”]
সংসদের বিশেষ অধিকার সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ‘রিভিউ’ বা পর্যালোচনা করার এখতিয়ার কি আদালতের রয়েছে? এক্ষেত্রেও রাজা রাম পালের মামলার রায়ের আগে আদালতের সিদ্ধান্ত ছিল বিভক্ত। কেশব সিংয়ের মামলার কারণে রাষ্ট্রপতির প্রেরিত রেফারেন্সের প্রেক্ষিতে প্রাদেশিক পরিষদের সিদ্ধান্তটির আইনি বৈধতা পর্যালোচনা করার এখতিয়ার আদালতের রয়েছে বলে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ ১৯৬৫ সালে মতামত দেন। পক্ষান্তরে পি ভি নরসীমা রাও বনাম স্টেট মামলায় [(১৯৯৮) ৪ এসসিসি] ১৯৯৮ সালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন যে, উৎকোচ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট দেয়ার বিষয়ে ‘পার্লমেন্টারি প্রসিডিংস’ বা সংসদীয় কার্যক্রম সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার আদালতের নেই। আদালত সুস্পষ্টভাবে বলেন: ÔThe bribe-taker MPs who have voted in Parliament against the non-confidence motion are entitled to protection of Article 105(2) and are not answerable to Court of Law for alleged conspiracy and agreement.’ (‘উৎকোচগ্রহণকারী সংসদ সদস্যগণ, যাঁরা অনাস্থা প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন, তাঁরা সংবিধানের ১০৫(২) অনুচ্ছেদের অধীনে দায়মুক্তি পেতে পারেন। তাঁরা ষড়যন্ত্র ও সমঝোতার অভিযোগে আদালতে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন।’) প্রসঙ্গত, আমাদের সংবিধানের ৮৭ অনুচ্ছেদের বিধানও অনেকটা ভারতীয় সংবিধানের ১০৫(২) অনুচ্ছেদের সমতুল্য।
আদালতের এখতিয়ার প্রসঙ্গে রাজা রাম পাল মামলার রায়ে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ভিন্ন অবস্থান নেন। আদালত বলেন যে, সংসদীয় কার্যক্রমের নিরঙ্কুশ দায়মুক্তির দাবির কোনো ভিত্তি নেই। মৌলিক অধিকার লঙঘন, ‘নেচারাল জাস্টিস’ বা স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিহীনতা, ‘র্ই‌রেশনালিটি’ বা অযৌক্তিকতা, ‘পারভারসিটি’ বা বিকৃতি কিংবা গুরুতর বেআইনি বা সংবিধান পরিপন্থী সংসদীয় কার্যক্রম সম্পর্কে পর্যালোচনা করার এখতিয়ার আদালতের রয়েছে। তবে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২২ ও ২১২ অনুযায়ী, কার্যপ্রণালীতে অনিয়মের অভিযোগে আদালতের দারস্থ হওয়ার সুযোগ নেই। এছাড়াও আদালত তথ্য ও দলিলপত্রের সত্যতা এবং পর্যাপ্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না বা সংসদের বিবেচনার ওপর নিজস্ব মতামত চাপিয়ে দেবে না। উপরন্তু ‘প্রপোরশনালিটি’ বা লঘু অপরাধের জন্য গুরুদণ্ড দেয়ার অভিযোগেও আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার অবকাশ নেই। অর্থাৎ সীমিত ক্ষেত্রে সংসদীয় সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করার এখতিয়ার আদালতের রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ রায়ের মাধ্যমে সংসদের ক্ষমতা ও বিচার বিভাগের এখতিয়ার বিষয়ে একটি ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে।
উল্লেখ্য, আদালতের দৃষ্টিতে বহিষ্কারাদেশ প্রদানের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য-প্রমাণের কড়াকড়িও অনেকটা শিথিল। এ প্রসঙ্গে ওয়েসটেল ডাব্লিউ উইলোভি তাঁর Constitutional Law of the United States গ্রন্থে বলেন,: ‘ÔIn determining whether or not a member of congress has been guilty of such acts as to warrant his expulsion the House concerned does not sit as a criminal trial court, and is not therfore, bound by the rules of evidence, and the requirements as the certitude of guilt which prevail in a criminal character, but only as to unfitness for participation in the deliberation and decisions of congress.’ (কোনো সদস্যের কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হতে পারেন এমন অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীর অপরাধ নিশ্চিতভাবে নির্ধারণের বাধ্যবাধকতা নেই, কারণ কংগ্রেস ফৌজদারি আদালত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে না। এক্ষেত্রে ‘রুলস অব এভিডেন্স’ বা সাক্ষ্য-প্রমাণের প্রচলিত বিধি-বিধান অনুসরণেরও বাধ্যবাধকতা নেই।) রাজা রাম পাল বনাম স্পীকার মামলার রায়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকগণ আরো সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, যদি সিদ্ধান্তের সমর্থনে অন্তত কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ থাকে, তাহলে আদালত সংসদের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। (Ô…this Court shall not interfere so long as there is some relevant meterial sustaining the action.’) এছাড়াও সংসদের বহিষ্কারের ক্ষমতা অপব্যবহারের ব্যাপারেও আদালত উদ্বিগ্ন নন।
লেখক: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক
ই-মেইল: badiulm@gmail.com
[‘সুজন – সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে গত ২৮ মে ২০০৯ তারিখে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল আলোচনায় উত্থাপিত ও পরবর্তীতে সামান্য সংশোধিত এই নিবন্ধটি ধারাবাহিকভাবে আমাদের সময়ে প্রকাশিত হচ্ছে। আগামীতে পড়-ন ‘সংসদ সদস্যকে বহিষ্কারের দৃষ্টান্ত আমাদের দেশে নেই’]
তথ্য সূত্র: দৈনিক আমাদের সময়, ১৩ জুন ২০০৯

Related Post

নির্বাচনী ইশতেহারের জন্য বিবেচ্য বিষয়সমূহনির্বাচনী ইশতেহারের জন্য বিবেচ্য বিষয়সমূহ

ড. বদিউল আলম মজুমদার প্রত্যেক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলো প্রথাগতভাবে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। নির্বাচন পরবর্তীকালে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো কী করবে তারই রূপরেখা হলো নির্বাচনী ইশতেহার।

সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচনে কারা জিতলেনসিটি করপোরেশন ও পৌরসভা নির্বাচনে কারা জিতলেন

ড. বদিউল আলম মজুমদার (পূর্ব প্রকাশের পর) একথা সত্য যে, সাম্প্রতিক নির্বাচনে পুরানো ধারার রাজনীতির এবং পেট্রোন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কেরই বিজয় হয়েছে। ভোটারদের কাছে প্রার্থীদের সততা-যোগ্যতা তেমন গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়নি।

“নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বানে” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত“নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বানে” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

গত ১১ ডিসেম্বর ২০১৬ সকাল ১১.৩০টায়, নারায়ণগঞ্জ প্রেস ক্লাবে সুজন নারায়ণগঞ্জ জেলা কমিটি আয়োজিত ‘নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিকারী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান’