সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ড. বদিউল আলম মজুমদার,লেখালেখি সর্বাধিক প্রয়োজন রাজনীতিকদের দায়িত্বশীলতা

সর্বাধিক প্রয়োজন রাজনীতিকদের দায়িত্বশীলতা


ড. ব দি উ ল আ ল ম ম জু ম দা র
‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকছে না!’ ২৭ মে’র যুগান্তরের এ শিরোনাম পড়ে আশ্চর্যান্বিত হয়েছি। সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান না রেখেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর খসড়া চূড়ান্ত করেছে এ লক্ষ্যে গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটি। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায়ের আলোকেই কমিটি তাদের খসড়ায় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধান না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে আমরা কমিটিকে তাদের সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ করব।

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত মামলার পূর্ণ রায় এখনও প্রকাশিত হয়নি। তবে ১০ মে প্রদত্ত রায়ে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ এক সংক্ষিপ্ত এবং বিভক্ত রায়ে আমাদের সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে আদালত রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনস্বার্থে এ ব্যবস্থাকে আরও দুই টার্ম বহাল রাখার সুপারিশ করেছেন। আরও সুপারিশ করেছেন বিচারকদের এ ব্যবস্থা থেকে দূরে রাখতে।
আদালতের রায় ও সুপারিশে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন জড়িত রয়েছে- একটি আইনি, আরেকটি রাজনৈতিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির বৈধতার প্রশ্নটি আইন সম্পর্কিত। অন্যটি রাজনৈতিক প্রশ্ন।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি। গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের মূলনীতির অংশ। এটি আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হিসেবে স্বীকৃত। তাই আদালতে এটিকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করাই স্বাভাবিক। বস্তুত আমরা মনে করি, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আদালত সঠিক রায়ই দিয়েছেন। আর আদালতের রায় শিরোধার্য।
শুধু আইনি দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, কার্যকারিতার দিক থেকেও আমরা মনে করি, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি একটি অবাঞ্ছিত ব্যবস্থা। কারণ এর অনেক অন্তর্নিহিত ও গুরুতর দুর্বলতা রয়েছে। এটি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে, বিশেষত ক্ষমতাসীন দলকে দায়িত্বহীন আচরণ করতে উৎসাহিত করে। কারণ এ ব্যবস্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সহায়তায় নির্বাচন কমিশনের এবং প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের দায় তাদের, বিদায়ী সরকারের নয়। তাই ক্ষমতাসীনরা প্রতিযোগিতা করেই সর্বস্তরে, বিশেষত প্রশাসনে নগ্ন দলীয়করণ ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে ফায়দাতন্ত্রের লাগামহীন বিস্তার ঘটায়, যদিও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথে এসব অপকর্ম পর্বতপ্রমাণ বাধা সৃষ্টি করে। প্রসঙ্গত, গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দলীয় অনুগত কয়েকজনকে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদান, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিচারপতিদের অবসরগ্রহণের বয়সসীমা বৃদ্ধি, বিচারপতি আজিজের নেতৃত্বে গঠিত পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশন, তাঁবেদার রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ, প্রশাসনে অব্যাহত সীমাহীন দলীয়করণ ইত্যাদি পরবর্তী নির্বাচনকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে রাজনীতিকদের দায়িত্বহীন আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ। বলা বাহুল্য, এসব দায়িত্বহীন কারসাজির ফলে ২০০৬ সালে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই পুরোপুরি ভেঙে পড়ে এবং ২০০৭-০৮ সেশনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পরবর্তী রাজনৈতিক সুনামি ছিল এমন কারসাজিরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি।
এ ছাড়াও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার একটি অমর্যাদাকর ও স্ববিরোধী পদ্ধতি। এর মাধ্যমে ধরে নেয়া হয় যে, রাজনীতিকদের সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বিশ্বাস করা যায় না, কিন্তু নির্বাচন-পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সব নাগরিকের জানমাল এবং স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব আমানত হিসেবে তাদের ওপর অর্পণ করা যায়। এটি একটি অস্থিতিশীল পদ্ধতিও বটে। কারণ যে দলই ক্ষমতায় যায়, সে দলই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করতে চায়। চায় বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে অন্তত নিজস্ব দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করতে। পক্ষান্তরে বিরোধী দল চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বহাল থাকুক। বস্তুত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে কার্যকর করার বিষয়ে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি, বরং বিভিন্ন ধরনের কারসাজির মাধ্যমে রাজনৈতিক সুবিধা লোটার হাতিয়ার হিসেবেই সব ক্ষমতাসীন এটিকে ব্যবহার করেছে- ক্ষমতায় থাকাকালীন আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের আচরণে প্রায় একই চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বস্তুত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য তাদের পক্ষ থেকে কোনরূপ রাজনৈতিক সদিচ্ছাই প্রদর্শন করা হয়নি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি নিয়ে অতীতের অতি বাড়াবাড়িও নির্বাচন-পরবর্তী অপশাসন থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ করেছে। এ সুযোগে সুশাসনবিবর্জিত এক ধরনের নির্বাচনসর্বস্ব- মূলত সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রিক- তথাকথিত ‘আংশিক’ গণতান্ত্রিক শাসন আমাদের ওপর চেপে বসেছে। এছাড়াও শুধু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রতি অতি গুরুত্ব দেয়ার কারণে নির্বাচিত সরকার যদি দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও অপশাসন করে পার পেয়ে যায়, তাহলে তাদের ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য বদ্ধপরিকর হওয়াই স্বাভাবিক। আর এ ধরনের মানসিকতাই নির্বাচনকে প্রভাবিত করার লক্ষ্যে সব কারসাজির জন্ম দেয়।
উপরন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির সৃষ্টিই হয়েছে সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯৪ সালে মাগুরার উপনির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের কারচুপি এবং নির্বাচন কমিশনের তা রোধে ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির দাবি ওঠে। নিঃসন্দেহে তখন সমস্যা ছিল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের অসদাচরণ এবং নির্বাচন কমিশনের তা রোধে অপারগতা। এমনি পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক দলের সংস্কার ও দলের অভ্যন্তরে শুদ্ধি অভিযান। একই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংস্কার ও পুনর্গঠন। কিন্তু তা না করে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো দু’টি ক্যাম্পে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের সঙ্গে এক সর্বাত্মক বিরোধে লিপ্ত হয়, যে বিরোধ ‘পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক’ ও ব্রিটিশ কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ দূত হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গভর্নর জেনারেল স্যার নিনিয়ান স্টিফেনসের মধ্যস্থতাও নিরসন করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্র দলগুলোর তীব্র ও সহিংস আন্দোলনের মুখে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি একটি একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এর ফলে রাজনীতিতে ক্রমবর্ধমান দুর্বৃত্তায়ন ও অসদাচরণের সমস্যাগুলো পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া হয়।
এসব দুর্বলতার কারণে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আমাদের চরম ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অকার্যকর করতে বড় ভূমিকা রেখেছে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কারসাজি এবং নির্বাচন পরবর্তীকালের অপশাসন আমাদের রাষ্ট্রকেই ক্রমাগতভাবে দুর্বল করেছে। তাই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার লক্ষ্যে অন্তর্নিহিত দুর্বলতাসংবলিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামের এ অস্থিতিশীল অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি যত দ্রুত বিলুপ্ত হয়, ততই জাতির জন্য মঙ্গল। আরও দেরি হওয়ার আগেই, সুপ্রিমকোর্টের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া সাম্প্রতিক রায় আমাদের জন্য সে সুযোগেরই সৃষ্টি করে দিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কিত কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছা যে আজ অতি জরুরি- মাননীয় আদালত সে বার্তাই রাজনীতিকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। তা না হলে রাষ্ট্রের কার্যকারিতা ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহভাবে ব্যাহত হবে।
তবে ভুললে চলবে না যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনেক অর্জনও রয়েছে। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটি ছবিযুক্ত নির্ভরযোগ্য ভোটার তালিকা তৈরি হয়েছে, যা ভোটার তালিকা নিয়ে অনেক বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে। একই আমলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে এবং বেশ কয়েকটি প্রগতিশীল আইনও প্রণীত হয়েছে, যার অনেকগুলো অবশ্য নবম জাতীয় সংসদ অনুমোদন করেনি। একই সময়ে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, নির্বাচন কমিশনের সচিবালয়কে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের নিয়ন্ত্রণমুক্ত এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে সক্রিয় করা হয়েছে। সর্বোপরি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো, সব নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের মতে, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। তবুও আমি মনে করি, এ অগণতান্ত্রিক, অস্থিতিশীল এবং সমস্যা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য উদ্ভাবিত ব্যবস্থা আমাদের বিরাজমান অপরাজনীতি ও অপশাসনের সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়, কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক গৃহীত সংস্কারগুলো অনেক ক্ষেত্রেই স্থায়ীত্ব অর্জন করে না। তাই সত্যিকারের সমাধান হবে রাজনৈতিক দলের সংস্কার ও রাজনীতিকদের মানসিকতার পরিবর্তন তথা একটি নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যাতে রাজনীতিকরাই স্বেচ্ছায় নির্বাচন প্রক্রিয়াকে কলুষমুক্ত এবং নির্বাচন পরবর্তীকালে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসেন।
এটি সুস্পষ্ট যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অগণতান্ত্রিক। উপরন্তু এটি আমাদের গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ বহন করে না, বরং এটি আমাদের রাজনীতির দেউলিয়াপনারই ফসল। এটি আমাদের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার এবং নির্বাচন পরবর্তীকালে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নে লিপ্ত হওয়ার বিরাজমান রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির দীর্ঘমেয়াদি সমাধানও নয়। তাই এটিকে বিলুপ্ত করতে হবে- আদালতের রায়ে সে মনোভাবই প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
তবে এ মুহূর্তে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করারও উপায় নেই, কারণ তা করলে আগামী নির্বাচনই অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে এবং আমরা এক ভয়াবহ সংকটের দিকে ধাবিত হতে পারি। কারণ আমাদের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করার লক্ষ্যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ নিয়ে অতীতে বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ, এমনকি কারসাজিতে লিপ্ত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। দলীয় অনুগতদের নিয়োগের মাধ্যমে তারা বিচারালয়ের নিরপেক্ষতা অতীতে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে এবং এখনও করছে। প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দলীয়করণের মহোৎসব অতীতে পালন করেছে এবং এখনও করছে। অর্থাৎ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে তারা আজ পর্যন্ত সদিচ্ছা প্রদর্শন করতে পারেনি- এ ব্যাপারে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। তাই আগামী নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে করার সিদ্ধান্ত হবে আমাদের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দলকে জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ‘রাশান রুলেট’ খেলার, যে খেলায় জীবন-মরণের সম্ভাবনা জড়িত, সুযোগ করে দেয়ার মতো।
এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনের আগে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলুপ্তি হবে জাতির জন্য চরম আত্মঘাতী। তাই আদালত বিজ্ঞচিতভাবেই বিচার বিভাগকে দূরে রেখে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনস্বার্থে- রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও জনস্বার্থই সর্বোচ্চ আইন- এটিকে আরও দুই টার্মের জন্য রাখার সুপারিশ করেছেন, যদিও অনেকে আমাদের রাজনীতিকদের মানসিকতা তথা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত এটি অব্যাহত রাখার পক্ষে। বস্তুত আদালত কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছার জন্য আমাদের রাজনীতিকদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। এ জন্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সময়সীমাও বেঁধে দিয়েছেন। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনীতিকদের এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না কারা হবে আরেকটি বড় ধরনের দায়িত্বহীনতা।
প্র্রসঙ্গত, অনেকেই দাবি করেন যে, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করলে আর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজন হবে না- কমিশনই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে। এ দাবি অত্যন্ত বিভ্রান্তিমূলক। কারণ নির্বাচন কমিশন ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচন নির্ভর করে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের সদাচরণ এবং প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতার ওপর। এ কাজে নির্বাচন কমিশন একটি পক্ষ মাত্র।
সুপ্রিমকোর্টের রায়ের আলোকে আমাদের রাজনীতিকদের এখন মোটা দাগে দু’টি বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছতে হবে। তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আগামী দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন সম্পর্কে। বিচার বিভাগের ওপর যেন বিরূপ প্রভাব না পড়ে, সেদিকে নজর রেখে কাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান করা যায় সে সম্পর্কে একটি ফর্মুলা তাদের উদ্ভাবন করতে হবে। একই সঙ্গে রাজনীতিকদের একটি পথরেখা তৈরি করতে হবে, যা অনুসরণ করে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে করা সম্ভবপর হবে।
প্রসঙ্গত, আমি নিজেও ৩ মে আদালতের রায় ঘোষণার আগে, সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত সংসদীয় বিশেষ কমিটির সামনে আগামী দুই টার্মের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের সুপারিশ লিখিতভাবে উত্থাপন করেছি। আমি কমিটির সামনে পরবর্তী দুই টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের একটি রূপরেখাও প্রস্তাব করেছি। আমি কমিটির সামনে আমাদের সব সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের নিয়ে একটি প্যানেল গঠনের প্রস্তাব করেছি। আমি আরও প্রস্তাব করেছি যে, এই প্যানেলভুক্ত সাবেক বিচারপতিরা সর্বসম্মত বা দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য নির্ধারিত করবেন। সবার আগে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বয়োজ্যেষ্ঠদের এ প্যানেলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি, আগামী দুই টার্মের জন্য এ ধরনের একটি সাময়িক ব্যবস্থা সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে নতুন কোন জটিলতা সৃষ্টি করবে না।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যেন নির্বাচন-প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন, সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ-প্রক্রিয়া, রাজনৈতিক দল, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সঠিক তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি, ফায়দাতন্ত্র ও প্রশাসনে দলীয়করণের অবসানসহ অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়, সে সুপারিশও আমি কমিটির সামনে করেছি। সমঝোতার ভিত্তিতে গৃহীত এসব সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে দেশে সহিষ্ণুতা ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা। আর এমন একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ছাড়াই ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভবপর হবে।
এ প্রসঙ্গে মার্কিন জাতির স্থপতিদের অন্যতম বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের একটি উক্তি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ১৭৮৭ সালে মার্কিন সংবিধান রচনার সময় এক নারী তার কাছে সংবিধান রচনা করে কী ধরনের রাষ্ট্র তারা কায়েম করতে চাচ্ছেন তা জানতে চান। ফ্রাঙ্কলিনের উত্তর ছিল, ‘এ রিপাবলিক ম্যাডাম, ইফ ইউ ক্যান কিপ ইট!’ অর্থাৎ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যদি আপনারা তা রাখতে পারেন! এমনিভাবে আমাদের বহু কষ্টার্জিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারও ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে আমাদের সবার, বিশেষত রাজনীতিকদের ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠার এবং দায়িত্বশীল আচরণের ওপর। সংবিধান সংশোধন সম্পর্কিত বিশেষ কমিটির মাননীয় সদস্যদের এবং দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে জাতি আজ সে ধরনের দায়িত্বশীলতাই আশা করে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩১ মে ২০১১

Related Post

নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জনতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জ

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ০৪-০৩-২০১২ বহু জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি মহামান্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সাবেক সচিব কাজী রকিবউদ্দিন আহমদকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবু

জাতীয় সংসদ কি কার্যকর?জাতীয় সংসদ কি কার্যকর?

ড. ব দি উ ল আ ল ম ম জু ম দা র নবম জাতীয় সংসদের মেয়াদ প্রায় এক বছর পূর্ণ হতে চললো। বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সংসদের কার্যকারিতা নিয়ে অনেকের মনেই

অনুসন্ধান কমিটির সামনে চ্যালেঞ্জঅনুসন্ধান কমিটির সামনে চ্যালেঞ্জ

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ৩০-০১-২০১২ বহুদিন ধরে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) পক্ষ থেকে আমরা নির্বাচন কমিশনসহ সব সাংবিধানিক ও অন্যান্য সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রদানের লক্ষ্যে নিরপেক্ষ অনুসন্ধান কমিটি গঠনের