সহস্রাব্দ লক্ষ্য কতটুকু অর্জন হলো

samakal_logo

উন্নয়ন
বদিউল আলম মজুমদার
২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘মিলেনিয়াম সামিটে’ একত্রিত হয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ ‘সহস্রাব্দ ঘোষণা’ প্রদান করেন। এ ঘোষণায় তারা পারস্পরিক অংশীদারিত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে বিশ্বের পিছিয়ে পড়া বিরাট জনগোষ্ঠীর ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও আনুষঙ্গিক বঞ্চনা অবসানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পরবর্তী সময়ে ৮টি সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য এবং এসব লক্ষ্যের অধীনে ১৮টি সুস্পষ্ট টার্গেট চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯০ সালকে ভিত্তি করে ২০১৫ সালের মধ্যে এসব টার্গেট অর্জন করার জন্য ১৮৯টি দেশ প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। শেষ লক্ষ্যটি এবং এর অধীনে টার্গেটগুলো বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব মূলত উন্নত দেশগুলোর। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের সময়ভিত্তিক (time bound) ও সুস্পষ্ট টার্গেটগুলো অর্জনের জন্য বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের সব সাম্প্রতিক উন্নয়ন কার্যক্রম এসব টার্গেট অর্জনের লক্ষ্যেই পরিচালিত হয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু গত ১৮ বছরে আমরা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি?
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের প্রথমটি হলো ক্ষুধা ও চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্পর্কিত। এর অধীনে তিনটি টার্গেট রয়েছে। প্রথমটি হলো, ২০১৫ সালের মধ্যে দৈনিক এক ডলারের কম উপার্জন করে এমন ব্যক্তির সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা। দ্বিতীয় টার্গেটটি হলো, একই সময়সীমার মধ্যে ক্ষুধার্তদের সংখ্যা অর্ধেকে হ্রাস করা।
ইউএনডিপির সহায়তায় বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশন গত বছর তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের অগ্রগতির রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, সর্বশেষ খানা জরিপে অন্তর্ভুক্ত ক্যালোরি গ্রহণের তথ্যের ভিত্তিতে দেখা যায়, ১৯৯০-৯১ সালে মোট জনগোষ্ঠীর ৫৬.৬ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করলেও ২০০৫ সালে তা নেমে আসে ৪০ শতাংশে। ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগে’র হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ সালের বিশ্বব্যাপী মুদ্রাম্ফীতির কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা জনগোষ্ঠী ৪৭ শতাংশে পৌছেছে। এছাড়াও অনেকের ধারণা, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দারিদ্র্য দূরীকরণের হার হ্রাস পেয়েছে। তাই বর্তমান গতিতে অগ্রসর হলে এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা ও স্থানীয়ভাবে বিরাজমান সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগে স্থবিরতার কারণে এ টার্গেটটি অর্জন করা, বিশেষত গ্রামীণ জনপদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। ১৯৯০-৯১ সালে কর্মসংস্থানের হার ছিল ৪৮.৫ শতাংশ, যা ২০০৬ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৫৮.৫ শতাংশে। তাই নিশ্চিত করে বলা যায়, সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সবার জন্য কর্মসংস্থানের টার্গেটটিও অর্জন করা সম্ভব হবে না।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ১৯৯০ সাল থেকে দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেলেও দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমাদের দেশের ১৫ কোটি জনগণের মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৬.৫ কোটি। তবে পপুলেশন ডাটা রেফারেন্স ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ১৬.২ কোটিতে। তাই বর্তমানে আমাদের দরিদ্রের সংখ্যা আরও বেশি হতে বাধ্য।
ক্ষুধা অবসানের টার্গেটের ক্ষেত্রে দুটি পরিমাপ রয়েছে। প্রথমটি হলো, পাঁচ বছরের নিচের স্বল্প ওজনের শিশুর হার। দ্বিতীয়টি হলো, প্রাপ্ত খাদ্যশক্তির পরিমাণ (dietary energy consumption)। ১৯৯০-৯১ সালে পাঁচ বছরের নিচের স্বল্প ওজনের শিশুর হার ছিল ৬৬ শতাংশ, যা ২০০৫ সালে ৪৭.৮ শতাংশে নেমে এসেছে। বর্তমান গতিতে ২০১৫ সালে এ হার দাঁড়াবে ৩৬.৫ শতাংশে; কিন্তু ২০১৫ সালের জন্য এর টার্গেট হলো ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ বর্তমান গতিতে অগ্রসর হলে ২০১৫ সালের জন্য নির্ধারিত ক্ষুধা ও চরম দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্পর্কিত টার্গেট অর্জন করা অসম্ভব হবে।
এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, ক্ষুধা-দারিদ্র্যের প্রচলিত সংজ্ঞা নিয়েই বিশেষজ্ঞদের মধ্যে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। এটি সুস্পষ্ট যে, প্রথাগতভাবে ক্ষুধা-দারিদ্র্যের পরিমাপ করা হয় নূ্যনতম ক্যালোরিপ্রাপ্তির ভিত্তিতে। ধারণা করা হয়, দৈনিক এক ডলার আয় করলে মানুষ তার প্রয়োজনীয় ক্যালোরির এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে। তাই ডলার-এ-ডে’কে (dollar-a-day) দারিদ্র্য সীমারেখা হিসেবে বেঁধে দিয়ে এর নিচে অবস্থানকারীদের ক্ষুধার্ত বলে ধরে নেওয়া হয়। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ক্ষুধা-দারিদ্র্য সম্পর্কে এমন ধারণা মানুয়ের দৈহিক শ্রমশক্তি অক্ষুণ্ন রাখার ওপরই প্রাধান্য দেয়_ মানুষ হিসেবে তার অন্যান্য চাহিদাকে (যেমন সৃষ্টিশীলতা) সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। তাও এতে আবার বর্তমান আয়ের মাধ্যমে বর্তমান দৈহিক শ্রম-ক্ষমতার স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়_ বৃদ্ধ বয়সের আয় ও ভবিষ্যতের দৈহিক শ্রম-ক্ষমতার বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের এসব সনাতন ধারণা মানুষের মৌলিক মানবিক চাহিদাগুলো অগ্রাহ্য করে মৌলিক দেহ ধারণের চাহিদার ওপরই জোর দেয়, যা নিঃসন্দেহে অমানবিক। অধ্যাপক আনিসুর রহমানের মতে, এগুলো গরুর দারিদ্র্যের সংজ্ঞা। কারণ এতে মানুষকে মানুষ হিসেবে ভাবা হয় না; বরং গবাদিপশু হিসেবেই গণ্য করা হয়। প্রচলিত প্রবৃদ্ধিনির্ভর উন্নয়ন কৌশলে, যে কৌশলে দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে ‘চুইয়ে পড়া’র (trickle down) ধারণা ব্যবহৃত হয়, এ ধরনের সংজ্ঞা প্রয়োগ করা হয়।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো, সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষার আয়োজন। এক্ষেত্রে তিনটি টার্গেট রয়েছে। প্রথমটি হলো, ২০১৫ সালের মধ্যে শতভাগ শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয় টার্গেট হলো, প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া শিশুরা যেন সবাই প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করে তা নিশ্চিত করা। তৃতীয়টি হলো, বয়স্ক শিক্ষার হার শতভাগে উন্নীত করা। ১৯৯০-৯১ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৬০.৫ শতাংশ হলেও ২০০৭ সালে তা ৯১.১ শতাংশে পৌঁছেছে। ফলে ২০১৫ সালের মধ্যে এ টার্গেটটি অর্জিত হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়। তবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় টার্গেট অর্জন সম্পর্কে গুরুতর সন্দেহ রয়েছে। প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হওয়া শিশুরা, যারা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পৌঁছে, তাদের হার ১৯৯০-৯১ সালে ছিল ৪০.৭, যা ২০০৭ সালে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫২ শতাংশে। ফলে এ টার্গেটটি অর্জিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। বয়স্ক শিক্ষার হার ২০১৫ সালের ৩৭.২ শতাংশ থেকে ২০০৭ সালে মাত্র ৬৯.৯ শতাংশে পৌঁছেছে, যদিও অনেকের মতে বাস্তবে এ হার আরও অনেক কম। তাই এ টার্গেটটিও অর্জন করা অসম্ভব।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের তৃতীয় লক্ষ্য হলো, ২০০৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় এবং ২০১৫ সালের মধ্যে অন্যান্য শিক্ষার ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের সমতা অর্জন। এক্ষেত্রেও তিনটি টার্গেট রয়েছে। প্রথমটি হলো, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও অন্যান্য শিক্ষার ক্ষেত্রে জেন্ডার সমতা অর্জন। দ্বিতীয়টি হলো, কৃষি খাতের বাইরে ২০১৫ সালের মধ্যে নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানের সমতা সৃষ্টি। অন্যটি হলো, জাতীয় সংসদে নারীর আসন ৩৩ শতাংশে উন্নীতকরণ। প্রাইমারি শিক্ষার ক্ষেত্রে ১৯৯০-৯১ সালে মেয়েদের ভর্তির হার ৮৩ শতাংশ হলেও ২০০৫ সালের মধ্যেই ছেলেমেয়েদের সমতা অর্জিত হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে ১৯৯০-৯১ সালে মেয়েদের ভর্তির হার ৫২ শতাংশ হলেও ২০০৫ সালের মধ্যে এ টার্গেটটিও অর্জিত হয়েছে। তবে টার্সিয়ারি ক্ষেত্রের টার্গেট অর্জন করা সম্ভব হবে না। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ভর্তির ক্ষেত্রে সমতা অর্জিত হলেও বাংলাদেশে শিক্ষার মানে, বিশেষত গ্রামীণ শিক্ষার মানে গুরুতর সমস্যা রয়েছে। কৃষিবহির্ভূত খাতে ১৯৯০-৯১ সালে নারীদের কর্মসংস্থানের হার ছিল ১৯.১ শতাংশ, যা ২০০৫ সালে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৪.৬ শতাংশে। ফলে এ টার্গেটটিও অর্জিত হবে বলে মনে হয় না। সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্বের বেলায় ১৯৯০-৯১ সালে ১২.৭ শতাংশ হলেও ২০০৯ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১৯ শতাংশে, যা বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে ৩৩ শতাংশে পৌঁছবে বলে আশা করা যায়।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের চতুর্থ লক্ষ্য হলো, ২০১৫ সালের মধ্যে পাঁচ বছরের নিচের শিশু মৃত্যুহার দুই-তৃতীয়াংশ কমানো। এক্ষেত্রেও তিনটি টার্গেট রয়েছে। প্রথম টার্গেটটি হলো, পাঁচ বছরের নিচের শিশু মৃত্যুহার ১৯৯০-৯১ সালের ১৪৬ থেকে ২০১৫ সালে ৪৮-এ নামিয়ে আনা। দ্বিতীয় টার্গেটটি হলো, শিশু মৃত্যুহার একই সময়ে ৯২ থেকে ৩১-এ নামিয়ে আনা। তৃতীয়টি হলো, এক বছরের শিশুদের হামের টিকা প্রদানের হার ১৯৯০-৯১ সালের ৫৪ থেকে শতভাগে উন্নীত করা। এ টার্গেট তিনটিই অর্জিত হওয়ার পথে।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের পঞ্চম লক্ষ্য দুটি, যার একটি হলো ২০১৫ সালের মধ্যে মাতৃ মৃত্যুহার তিন-চতুর্থাংশে নামিয়ে আনা। ১৯৯০ সালে প্রতি এক লাখ জীবন্ত শিশুর জন্মের ক্ষেত্রে মাতৃ মৃত্যুহার ছিল ৫৭৪ এবং ২০১৫ সালের জন্য টার্গেট হলো ১৪৪; কিন্তু ২০০৭ সালে এটি মাত্র ৩৫১-তে নেমে এসেছে। তাই এক্ষেত্রে ২০১৫ সালের জন্য নির্ধারিত টার্গেট ১৪৪-এ পৌঁছা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। একইভাবে প্রশিক্ষিত দাইয়ের সহায়তায় শিশু জন্মের হার ৫০-এ উন্নীত করাও সম্ভব হবে না; কারণ ১৯৯০-৯১ সালের ৫ থেকে ২০০৬ সালে এটি মাত্র ২০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
অন্য লক্ষ্যটি হলো, ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রেও একাধিক টার্গেট রয়েছে। একটি হলো, জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহারের হার ১৯৯০-৯১ সালের ৩৯.৭ শতাংশ থেকে ২০১৫ সালে ৭০ শতাংশে বাড়ানো। দ্বিতীয়টি হলো, বয়ঃসন্ধিক্ষণের মেয়েদের জন্মদানের হার ১৯৯১ সালে প্রতি ১০০০-এ ৭৭ থেকে নামিয়ে আনা। এটি ২০১৫ সালে ৪৩ পেঁৗছলেও টার্গেট অর্জিত হবে না। আরেকটি হলো, গর্ভবতী মায়েদের সেবা। গর্ভবতী মায়েরা যারা গর্ভাবস্থায় চারবার ডাক্তারের কাছে যায়, তাদের হার ১৯৯৩ সালের ৫.৫ শতাংশ থেকে ২০০৭ সালে মাত্র ২০.৬ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০১৫ সালে শতভাগে পৌঁছার কথা। অর্থাৎ এ টার্গেটটিও অর্জিত হবে না।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অষ্টম লক্ষ্য তিনটি, যার একটি হলো, এইডসের সংক্রমণ রোধ, কনডম ব্যবহার বৃদ্ধি এবং এইডস সম্পর্কে ১৫-২৪ বছর বয়স্কদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি। দ্বিতীয়টি হলো, এইডস আক্রান্তদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার আয়োজন। শেষটি হলো, ম্যালেরিয়া এবং যক্ষ্মার মতো গুরুতর ব্যাধির ব্যাপকতা অর্ধেকে নামিয়ে আনা। সৌভাগ্যবশত এসব ভয়াবহ ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত টার্গেটগুলো অর্জিত হবে বলে আশা করা যায়।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের সপ্তম লক্ষ্যটি মূলত পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা সম্পর্কিত। এক্ষেত্রে তথ্যের অনেক ঘাটতি ও ভ্রান্তি রয়েছে। মৎস্যসম্পদের নিরাপদ বিচরণ এলাকা, পানিসম্পদের ব্যবহার এবং বিলুপ্ত হওয়া প্রজাতির হার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য নেই। অন্যদিকে বনভূমি রক্ষা ও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন সম্পর্কিত টার্গেট দুটি অর্জিত হবে বলে আশা ব্যক্ত করা হয়, যদিও এ ব্যাপারে অনেকের মনেই সন্দেহ রয়েছে। আমাদের জীববৈচিত্র্যও দ্রুত হারে ধ্বংস হচ্ছে।
সপ্তম লক্ষ্যের অধীনে নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সম্পর্কিত দুটি টার্গেট রয়েছে। সরকারি হিসাবমতে, ১৯৯০-৯১ সালে নিরাপদ পানি ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর হার ছিল ৮৯ শতাংশ, যা ২০০৭ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৯৭.৮ শতাংশে এবং ২০১৫ সালের জন্য এর টার্গেট শতভাগ। আর্সেনিক ও পানিতে লবণাক্ততা সমস্যার ব্যাপকতার কারণে ২০০৭ সালের সফলতার তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। সাম্প্রতিক মূল্যায়নে এর অর্জন সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করা হলেও এই টার্গেটটি অর্জনের সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। ১৯৯০-৯১ সালে উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন প্রণালি ব্যবহারের হার ছিল মাত্র ২১ শতাংশ এবং ২০১৫ সালের জন্য এর টার্গেট ৬০ শতাংশ। ধারণা করা হয়, ২০১৫ সালে এ হার ৫১.৩ শতাংশে পৌঁছবে, ফলে এ টার্গেটটিও অর্জিত হবে না। এক্ষেত্রে আরেকটি টার্গেট হলো শহরে বস্তিতে বসবাসকারীদের সম্পর্কিত। শহরে বস্তিবাসীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে, যদিও এ ব্যাপারে কোনো সঠিক তথ্য নেই।
অষ্টম সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অধীনে অনেক টার্গেট রয়েছে, যার অধিকাংশই উন্নয়ন সহায়তাকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। প্রাপ্ত তথ্য থেকে দেখা যায়, অফিসিয়াল বৈদেশিক সাহায্য ১৯৯০-৯১ সালের ১,১৪৬.২ মিলিয়ন ডলার থেকে ২০০৭-০৮ সালে ৯৬.১ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে; অর্থাৎ উন্নয়ন সহায়তাকারীরা তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। রক্ষা করেননি তাদের জাতীয় আয়ের ০.৭ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তা হিসেবে প্রদান করতে, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈশি্বক অর্থনৈতিক কাঠামোর ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে এবং যুবকদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রযুক্তি সহায়তা দিতে। তবে রফতানির আয়ের হার হিসেবে বৈদেশিক দায় শোধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানেই রয়েছে। অষ্টম লক্ষ্যের অধীনে তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত টার্গেটও রয়েছে। টেলিফোন ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে, যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের হার অনেক বেড়েছে। তবে বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় থেকে আমরা এক্ষেত্রে অগ্রগতির ব্যাপারে আশাবাদী হতে পারি।
পরিশেষে সাম্প্রতিক মূল্যায়ন থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অধীনে চিহ্নিত টার্গেটগুলো অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সফলতা মিশ্র। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছেলেমেয়েদের ভর্তির হারে সমতা অর্জন, শিশু মৃত্যুহার হ্রাস, দুরারোগ্য ব্যাধি রোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সফলতা অর্জিত হলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পেছনে পড়ে আছে। যেমন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের টার্গেটগুলো পূরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয়। এছাড়া ক্ষুধা-দারিদ্র্যের সংজ্ঞা নিয়েই গুরুতর সমস্যা রয়েছে। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের সমস্যা দূরীভূত করতে হলে অবশ্যই উন্নয়ন কৌশলে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। ক্ষুধার্ত ও দরিদ্রদের তাদের ভাগ্য গড়ার কারিগরে পরিণত করতে হবে। নীতিনির্ধারণকে করতে হবে দারিদ্র্যবান্ধব। একইসঙ্গে দরিদ্রদের দিতে হবে জাতীয় সম্পদে তাদের ন্যায্য অধিকার। এছাড়াও প্রয়োজন হবে দুর্নীতি রোধ ও বিনিয়োগ উৎসাহের লক্ষ্যে যথাযথ পরিবেশ সৃষ্টি।
-ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক, সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক
তথ্য সূত্র: দৈনিক সমকাল, ২৪ অক্টোবর ২০০৯


Related Post

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা: ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছিমুক্তিযুদ্ধের চেতনা: ৩৯ বছর পরও আমরা স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ১৭-১২-২০১০ বিখ্যাত গায়ক হায়দার হোসেনের অতি জনপ্রিয় গানের একটি গুরুত্বপূর্ণ কলি, ‘৩০ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি।’ এ গানে স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের আমাদের অর্জন সম্পর্কে তিনি তাঁর

রাজনীতির গুণগত মান উত্তরণ কোন পথে?রাজনীতির গুণগত মান উত্তরণ কোন পথে?

বদিউল আলম মজুমদার গত ২০ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশনের পক্ষে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা উপজেলা ও জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। দেশের আপামর জনসাধারণেরও কামনা, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশ গ্রহণেই ১৮ ডিসেম্বর