সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ড. বদিউল আলম মজুমদার,লেখালেখি সিটি ও পৌর নির্বাচন এবং রাজা-প্রজা সম্পর্ক

সিটি ও পৌর নির্বাচন এবং রাজা-প্রজা সম্পর্ক


ড. বদিউল আলম মজুমদার
গত ৪ আগস্ট চারটি সিটি কর্পোরেশন ও নয়টি পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে এটিই ছিল প্রথম নির্বাচন। তাই এই নিয়ে যেমন আশা-আকাঙক্ষা ছিল, তেমনি ছিল সংশয় ও শঙ্কা। অনেকে আশা করেছিল যে, নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও অর্থবহ হবে। আর অর্থবহ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুণগত মানে পরিবর্তন আসবে – সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিরা ক্ষমতাসীন হবেন। আবার অনেকের মধ্যে আশঙ্কা ছিল যে, সরকার তাদের পছন্দের ব্যক্তিদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার লক্ষে একটি নীল-নকশা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে এবং সিটি ও পৌর নির্বাচনে তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে এবং এ কারণে তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরোধী। এ সকল আকাঙক্ষা-আশঙ্কার প্রেক্ষাপটে সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর একটি পর্যালোচনা উপস্থাপন করা এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছিল পরবর্তীতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচগুলোর, বিশেষত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ড্রেস রিহার্সেলস্বরূপ। তাই এই নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ করার ওপর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আন্তরিকতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা বহুলাংশে নির্ভরশীল।
এর ওপর আরো নির্ভর করে নির্বাচনী ফলাফলের গ্রহণযোগ্যতা। এক্ষেত্রে কি সরকার ও নির্বাচন কমিশন সফল?
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতার একটি বড় মাপকাঠি নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ। প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ৪টি সিটি কর্পোরেশন গড়ে ৭৮.৭৪ শতাংশ ভোটার ভোট প্রদান করেছে। এরমধ্যে সর্বোচ্চ ভোট প্রদানের হার ছিল বরিশালে, ৮২.০৩ শতাংশ, আর সর্বনিম্ন ছিল সিলেটে, ৭৫ শতাংশ। পৌরসভার ক্ষেত্রে গড় ভোট প্রদানের হার ছিল ৮৭.৭১ শতাংশ। নয় পৌরসভার মধ্যে বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় ভোট পড়েছে সর্বোচ্চ হারে ৯৪.৬৬ শতাংশ এবং সীতাকুণ্ডে পড়েছে সর্বনিম্ন ৮৩.৪০ শতাংশ। প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী এ সকল নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতির হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসাথে বৃদ্ধি পেয়েছে নারী ও সংখ্যালঘুদের ভোট প্রদানের হার।
অতীতের নির্বাচনগুলোতে একটি বড় সমস্যা ছিল জাল ভোট প্রদান। এবার জাল ভোট প্রদানের হার ছিল অতি নগণ্য। শোনা যায়, পুরো বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে মাত্র একটি জাল ভোট পড়েছিল, তাও সংশিস্নষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তার অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য। জাল ভোট প্রদানের সুযোগ ছিল না বলে ডামি বা জাল প্রার্থীর সমস্যাও ছিল না। জাল ভোটের দৌরাত্ম্য দূর করার ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, যা তৈরি নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি বড় অর্জন। তবে, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা অন্তর্ভুক্ত ভোটার নম্বরের সাথে জাতীয় আইডি কার্ডের নম্বরের অমিল থাকায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভোটারদের সমস্যার সম্মুখিন হতে হয় এবং কিছু ভোটার ভোট দিতে পারেননি। গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী এদের সংখ্যা মোট ভোটারের তুলনায় অতি নগণ্য।
অন্যবারের তুলনায় নির্বাচনী ব্যয়ও অপেক্ষাকৃত কম ছিল বলে অনেকের ধারণা। ব্যয় হ্রাসের একটি বড় কারণ ছিল, শোডাউন, তোরণ নির্মাণ, ভোট ক্যাম্প স্থাপন ইত্যাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ। টাকার বিনিময়ে ভোট ক্রয়-বিক্রয়ের অভিযোগ অনেক স্থান থেকেই উঠেছে, যদিও এগুলো দৃশ্যমান ছিল না।
ভোটগ্রহণও শান্তিপূর্ণ হয়েছে – উল্লেখযোগ্য কোন সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি। ভোটারদের হুমকি দেয়ার কিংবা বেলট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেনি। ভোটারগণ ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়েই ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে। কোথাও, বরিশাল ছাড়া, ভোট গণনার ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দেয়নি। বরিশালের ভোট গণনার ক্ষেত্রে সমস্যার একটি বড় সম্ভাব্য কারণ ছিল, আমাদের অভিজ্ঞতানুসারে, সংশিস্নষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তার অযোগ্যতা ও অদক্ষতা। ভোট গণনায় আর কী ঘটেছিল তা আমরা নির্বাচন কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট থেকে জানতে পারব বলে আশা করি। তবে সার্বিক বিবেচনায় ৪টি সিটি কর্পোরেশন ও ৯টি পৌরসভায় নির্বাচন ছিল সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য।
বিতর্কিত প্রার্থীদের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাব্য কারণ
১১ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর অনেকেই আশা করেছিল যে, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসবে এবং ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোতে তা প্রতিফলিত হবে। নির্বাচনে বিতর্কিত ব্যক্তিরা প্রত্যাখ্যাত হবেন এবং সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত ব্যক্তিরা অধিকহারে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফল আশানুরূপ হয়নি- দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগে অভিযুক্ত অনেক ব্যক্তিই স্বাচ্ছন্দে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। কেন তা হলো?
বিতর্কিত ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়ার পেছনে অনেক সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। একটি কারণ হলো, ১১ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখের পর অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের এবং তাদের অনেককে কারাগারে অন্তরীণ করা হলেও, আমাদের রাজনীতিতে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কোনরূপ গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। অনেকেই ১১ জানুয়ারির পূর্বাবস্থায় – অর্থাৎ রাজনৈতিক হানাহানিতে – ফিরে না যাওয়ার কথা বললেও, হানাহানির মূল কারণ, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে তারা তেমন সোচ্চার হননি। ফলে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠেনি এবং দুর্বৃত্তরা সামাজিকভাবে ধিকৃতও হননি। যার কারণ অবশ্য দেশের জনমত সৃষ্টিকারী ব্যক্তিবর্গের অধিকাংশের দলীয় আনুগত্য এবং দলবাজির উধের্ব উঠতে না পারা। তাই দুর্বৃত্তদের মধ্যে কোন অনুশোচনা বা লজ্জাবোধ সৃষ্টি হয়নি, যা তাদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে পারতো। অর্থাৎ ১১ জানুয়ারি ২০০৭ তারিখের ঘটনার পর বড় বড় কিছু নেতা-নেত্রীদেরকে, যাদেরকে কোনভাবে স্পর্শ করা যাবে না বলে অনেকের ধারণা ছিল, কারাগারে অন্তরীণ করার মত প্রলয়ঙ্করী ঘটনা ঘটলেও, জাতির মানসিকতায় তেমন পরিবর্তন ঘটেনি বলেই মনে হয়।
এছাড়াও আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও এমন পর্যায়ে পৌঁছেনি যে, কোনরূপ গর্হিত কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্তরা স্বেচ্ছায় গণপ্রতিনিধিত্বমূলক বা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন এবং নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেন। আর বিতর্কিত ব্যক্তিরা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ফলে অনেক সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরা এগিয়ে আসেননি। অর্থাৎ সাম্প্রতিক নির্বাচনে ‘গ্রাসামস্‌ ল’ কাজ করেছে – ‘খারাপ’ প্রার্থীরা ‘ভাল’ প্রার্থীদেরকে নির্বাচনী ময়দান থেকে বিতাড়িত করেছে।
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোও বিতর্কিত প্রার্থীদেরকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে পারেনি। যেমন, সরকার অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের মামলা করেছে, কিন্তু এ সকল মামলাগুলো নিস্পত্তি করতে পারেনি। অনেকের মতে, এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভূমিকাও সহায়ক ছিল না। নির্বাচন কমিশনও মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারেনি এবং হলফনামায় অসত্য তথ্য দেয়ার কিংবা তথ্য গোপন করার জন্য মনোনয়নপত্র বাতিল করেনি। এছাড়াও কমিশন হলফনামা ও আয়কর রিটার্নের কপি প্রকাশের ব্যাপারে গাফিলতি করেছে। যেমন, আমরা ‘সুজনে’র পক্ষ থেকে বহু কাঠখড় পোড়ানোর পর মাত্র নির্বাচনের আগের দিন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের রিটার্নিং অফিসারের কাছ থেকে প্রার্থীদের আয়কর রিটার্নের তথ্য পাই, তাও সে তথ্য ছিল আংশিক। ফলে তথ্যগুলো গণমাধ্যম ও ভোটারদের কাছে যথাসময়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এছাড়াও ‘সুজন’ ব্যতীত অন্য কোন সংগঠন প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ ধারাবাহিকভাবে এগুলো বিতরণের এবং এর মাধ্যমে ভোটার সচেতনতা সৃষ্টির কোনরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। গণমাধ্যমের জন্যও ছিল এটি প্রথম অভিজ্ঞতা, তাই তাদের পক্ষেও গভীর অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরি করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবপর হয়নি।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। তারা এখন পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। বরং তারা দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগে কারারুদ্ধ ব্যক্তিদেরকেও মনোনয়ন ও সমর্থন প্রদান করেছে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনৈতিক দলের উদ্যোগী ভূমিকা ছাড়া রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করা অসম্ভব।
বিতর্কিত ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়ার পেছনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের বিদ্যমান সামন্তবাদী প্রথা। সামন্তবাদী প্রথায় একটি পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, যা রাজতন্ত্রের অধীনে রাজা-প্রজার সম্পর্কের সমতুল্য। এ প্রথায় সাধারণ জনগণের কোন ‘অধিকার’ থাকে না, যদিও আমাদের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য অনেকগুলো মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে। স্বাধীন রাষ্ট্রের ‘নাগরিক’ হিসেবে তারা রাষ্ট্রের মালিক এবং সংবিধান অনুযায়ী সকল ক্ষমতার উৎস হওয়ার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও দেশের অধিকাংশ জনগণ, বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখনও রাষ্ট্রের ‘মালিকে’ পরিণত হতে পারে নি – তারা এখনও প্রভূতুল্য শাসকদের করুণার পাত্রই রয়ে গিয়েছে। ফলে যে সকল নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা তাদের প্রাপ্য, তা তারা পায় না। তাদের ন্যায্য অধিকারগুলো অর্জনের জন্য তাদের অবলম্বনের আশ্রয় নিতে হয়। বস্তুত, পেট্রন বা পৃষ্ঠপোষকদের কৃপা বা অনুগ্রহের কারণেই তারা বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, পৃষ্ঠপোষকরা তাদেরকে নিরাপত্তাও প্রদান করে থাকে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের হয়রানি থেকে রক্ষা করে।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিদেশী শাসকরা ছিলেন প্রভূ, আর নেটিভ বা স্বদেশীরা ছিলেন প্রজা। ‘সরকার বাহাদুর’ শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে অবকাঠামো সৃষ্টির পাশাপাশি প্রজাদের জন্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ও সেবার ব্যবস্থা করতেন। বিদেশী শাসকদের সহযোগী হিসেবে তাদের সৃষ্ট মধ্যস্বত্ত্বভোগী জমিদার ও ভূস্বামীরাও প্রজাদের প্রতি নানাভাবে দয়া-দাক্ষিণ্য প্রদর্শন ও হাসপাতাল-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা প্রদান করতেন এবং প্রজাদের পেট্রন বা পৃষ্ঠপোষক হিসেবে কাজ করতেন। আর জমিদার শ্রেণীর এ সকল পৃষ্ঠপোষকদেরকেই ভিক্ষা-অনুদান ও নানা ধরনের কৃপাপ্রাপ্ত প্রজারা অনেক ক্ষেত্রে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করতো।
স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি সংবিধান রচিত এবং এতে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিধান রাখা হলেও, নাগরিকরা বহুলাংশে এখনও প্রজাই রয়ে গিয়েছে। প্রাপ্য অধিকার দিয়ে তাদেরকে নাগরিক হিসেবে ক্ষমতায়িত করা হয়নি, তাদের নিজেদেরও সে ধরনের মানসিকতা গড়ে ওঠেনি। ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন, ওমা আমি নয়ন জলে ভাসি ’ – জাতীয় সঙ্গীতের এ কথাগুলো তাদের অনেকের কাছে ফাঁকা বুলি বৈ কিছুই নয়। এমনি ব্যবস্থায় রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন ধরনের ফায়দা তোলার মাধ্যমে নব্য প্রভূতে পরিণত হয়েছেন। নির্বাচন তাদের জন্য সভ্য সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে প্রভূত্ব অর্জনের প্রতিযোগিতা মাত্র, কারণ নির্বাচন পরবর্তীকালে তারা যা-ইচ্ছা-তাই করে পার পেয়ে যেতে পারেন।
মূলত দলবাজি ও ফায়দাবাজির নগ্ন প্রদর্শনীর – দলীয় বিবেচনায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কারণে গত দুই সরকারের, বিশেষত গত সরকারের আমলে নির্বাচিত প্রতিনিধি ও সাধারণ জনগণের মধ্যে পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক আরো দৃঢ়তর হয়েছে। দলীয় সাধারণ সম্পাদকদেরকে ফায়দা প্রদানের কেন্দ্রবিন্দু স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে এ সম্পর্ককে চলমান রাখা হয়। নানা ধরনের ফায়দা প্রদানের মাধ্যমে সাম্প্রতিককালে আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যগণ, বিশেষত সরকার দলীয় সংসদ সদস্যগণ তাদের নিজস্ব নির্বাচনী এলাকায় এক ধরনের জমিদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তারা তাদের সমর্থকদেরকে বৈধ-অবৈধ সুযোগ-সুবিধাই প্রদান করেননি, তাদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করেছেন। বলাবাহুল্য যে, এ ধরনের দলবাজি ও ফায়দাবাজির কারণে পুরো জাতি, যে জাতি ১৯৯০ সালেও ঐক্যবদ্ধ ছিল, তারা বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। ক্রমান্বয়ে অনেকটা অন্ধ দলীয় আনুগত্য সৃষ্টি হয়েছে। এ আনুগত্যকে ধরে রাখার জন্য ফায়দা প্রদানের সাথে সাথে বিভিন্ন ধরনের সিম্বলিজম বা প্রতীক – ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ’, ‘জিয়ার আদর্শ” – ব্যবহার এবং পরস্পরের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা হয়েছে।
মানুষ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সাধারণত নিজস্ব স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়। ভোট প্রদানের ক্ষেত্রেও তা সত্য – অধিকাংশ ভোটার ভোট দেয় তাদেরকেই, যারা তাদেরকে বৈধ-অবৈধ নানান সুযোগ-সুবিধা (নগদপ্রাপ্তি যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত) ও নিরাপত্তা প্রদান করতে পারে। বাংলাদেশে দুইটি দল – বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল – তা প্রদান করতে সক্ষম। তাই অতীতে তারা এ দুইটি দলকেই মূলত ভোট দিয়েছে। ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে প্রার্থীদের সততা ও যোগ্যতার বিবেচনা সাধারণ ভোটারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় নয়। সদ্যসমাপ্ত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও তাই হয়েছে – ভোটাররা তাদের নব্য প্রভূদেরকেই ভোট দিয়েছে। (চলবে)
[লেখক : সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক]
তথ্য সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫ আগস্ট ২০০৮

Related Post

রাজনীতি: গণতন্ত্র এবং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিরাজনীতি: গণতন্ত্র এবং আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

এম হাফিজউদ্দিন খান | তারিখ: ২৩-০৫-২০১১ রোববার জাতীয় সংসদের যে অধিবেশনটি শুরু হয়েছে, সেটি নানা কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই অধিবেশনে ২০১১-১২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট পেশ ও অনুমোদিত হবে। দ্বিতীয়ত, এ

জবাবদিহিতা: নির্বাচনী ইশতেহারে চাই অর্থবহ অঙ্গীকারজবাবদিহিতা: নির্বাচনী ইশতেহারে চাই অর্থবহ অঙ্গীকার

বদিউল আলম মজুমদার প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক দলগুলো প্রথাগতভাবে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। নির্বাচন-পরবর্তীকালে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা কী করবে তারই রূপরেখা হলো নির্বাচনী ইশতেহার। ইশতেহারগুলোতে অনেক ভালো

ঢাকাকে ভাগ করবেন নাঢাকাকে ভাগ করবেন না

ঢাকাকে ভাগ করবেন না বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ২৮-১১-২০১১ গত ২৩ নভেম্বর সরকার স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন, ২০০৯-এর সংশোধনকল্পে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করেছে। বিলটির উদ্দেশ্য মূলত ঢাকা