গত ১৫ অক্টোবর ২০২০, বৃহস্পতিবার, সকাল ১১টায় নাগরিক সংগঠন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর পক্ষ থেকে শীর্ষক ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ ও প্রতিকারে করণীয়’ একটি অনলাইন গোলটেবিল বৈঠক এর আয়োজন করা হয়। এই অনলাইন গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুজন সভাপতি জনাব এম হাফিজউদ্দিন খান এবং লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন সুজনের নির্বাহী সদস্য ড. শাহনাজ হুদা। গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
এছাড়াও এই গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন সুজনের সহ-সভাপতি ড. হামিদা হোসেন, সহ- সম্পাদক জনাব জাকির হোসেন, কোষাধ্যক্ষ সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, নির্বাহী সদস্য সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ , অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, জনাব ফারুক মাহমুদ চৌধুরী, জনাব সফিউদ্দিন আহমেদ, জনাব আকবর হোসেন, সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য ড. সি আর আবরার, জনাব সঞ্জীব দ্রং , জনাব একরাম হোসেন, জাতীয় কমিটির সদস্য জনাব একরাম হোসেন, জনাব সঞ্জীব দ্রং , সুজনের রংপুর কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম বেঞ্জু, অ্যাডভোকেট শিব্বির আহমেদ লিটন, সভাপতি, ময়মনসিংহ মহানগর কমিটি , রণজিৎ দত্ত, সম্পাদক, বরিশাল জেলা কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির চেয়ারম্যান জনাব সালমা আলী, জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জনাব তানিয়া হক সহ প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল ফর ইলেকটোরাল সিস্টেম (আইএফইএস), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ উইমেন সহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং সাংবাদিকবৃন্দ।
ড. শাহনাজ হুদা তাঁর প্রবন্ধে বলেন, বাংলাদেশে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা একটি নৈমিত্তিক ঘটনা। উদ্বেগজনক হারে নারী এবং শিশুদের প্রতি এই সহিংসতা বেড়েই চলেছে। আইন ও শালিশ কেন্দ্রের (আসক) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৯৭৫টি এবং ধষর্ণচেষ্টা করার ঘটনা ২০৪টি। ধর্ষণ করার পরে ৪৩ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছিল ও ১২ জন আত্মহত্যা করেন। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) দ্বারা পরিচালিত অন্য একটি জরিপে দেখা গেছে, এপ্রিল মাসেই বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ২৭টি জেলাতে ৪,২৪৯ জন নারী এবং ৮৬ জন শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছিল। এদের মধ্যে ১,৬৭২ জন নারী এবং ৪২৪ জন শিশু লকডাউনের সময় জীবনে প্রথমবারের মত পারিবারিক সহিংসতার মুখোমুখি হয়েছিল।জনগণের একটি বিশাল অংশ তাদের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রবেশের অধিকার পাচ্ছে না। অন্যদিকে অপরাধীদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা এবং বিচারহীনতা ও দুর্নীতির সংস্কৃতি চলমান থাকায় আইনের শাসনের যথাযথ চর্চায় বাধাগ্রস্থ হয়।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, করোনা মহামারীর সঙ্গে এখন ধর্ষণ মহামারীও যুক্ত হয়েছে। এই মহামারী এখন সমাজের সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান। সরকার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করেছে। সবেচেয়ে বড় কথা হলো বিচার হোক। বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক প্রভাব ইত্যাদি কারণে যথাযথ বিচার হচ্ছে না। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি দূর করে অপরাধীকে যথাযথ বিচারের আওয়াতায় এনে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সালমা আলী বলেন, শুধু আইন করলে হবে না। সমাজে, পরিবারে সব ক্ষেত্রে নারীদের সমান মর্যাদায় দেখার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আমাদের দেশে ভিক্টিমকে সাইকোসোশ্যাল কাউন্সেলিং সাপোর্ট দেয়া হয়না। যারা জেন্ডার ভায়োলেন্স নিয়ে কাজ করেন তাদের সহ ট্রায়াল কোর্ট, জজ কোর্ট প্রতিটি জায়গায় আইনজীবীদের এই বিষয়ে প্রশিক্ষণের দরকার আছে।
তানিয়া হক বলেন, আমাদের একটি ক¤িপ্রহেনসিভ ফ্যামিলি পলিসি থাকা প্রয়োজন। রেসপনসিবল পেরেন্টিং রেসপনসিবল নাগরিক তৈরি করে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও পরিবর্তন আনা দরকার, নৈতিক ও যৌন শিক্ষা দিতে হবে। পাশাপাশি মিডিয়াতে নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করার বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে।
সি আর আবরার বলেন, পরিবার, সমাজে অবক্ষয় – এগুলো আগেও ছল। কিন্তু বর্তমান সময়ে কেন এটা উলম্ফন ঘটলো? লোকজন মনে করে যে, আমি যা খুশি করতে পারবো এবং করে পার পেয়ে যাব। সরকার তড়িঘড়ি করে আইন পরিবর্তন করলো। নাগরিক হিসাবে আমরা বলতে চাই, নাগরিকদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট যে কোনো বিষোয়ে নাগরিকদের মতামত নিতে হবে, নাগরিকদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
রেজওয়ানা হাসান বলেন, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র কোনো একটি দিক থেকে না, সবদিক থেকে আমাদের বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। ধর্ষিতাকে সামাজিকভাবে নিগৃহীত না করে ধর্ষককে বয়কট করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, ধর্ষণের ক্ষেত্রে শ্রেণিগত স¤পর্কের জায়গাটা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি না। আবার সামগ্রিকভাবে যৌন অপরাধ নিয়েও কথা বলছি না। ধর্ষণ যৌন একটি নিকৃষ্টতম যৌন অপরাধ। কোনো একটি লেন্স দিয়ে না দেখে সামগ্রিকভাবে বিষয়টি দেখতে হবে।
রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন ধর্ষণের সঙ্গে যৌন ক্ষুধার খুব একটা স¤পর্ক নেই। নারীর প্রতি নিজেদের মাসকুলিনিটি দেখানোর জন্য, পুরুষ কতটা শক্তিশালী সেটা দেখানোর জন্য পুরুষ ধর্ষণ করে। বিচারের ক্ষেত্রে আমরা রেস্টওরেটিভ জাস্টিসের এর কথা বলছি না। শুধু অপরাধীকে শাস্তি দিলেই হবে না, অপরাধের যিনি ভিকটিম তার মানসিক ট্রমার বিষয়টিও দেখতে হবে।
নাছিমা আক্তার জলি বলেন, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নারীদের মর্যাদার জায়গা থেকে না দেখলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে না বলে আমি মনে করি।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, ৫ বছর আগে ঢাকায় মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে একজন গারো নারীকে ধর্ষণের বিচার কিন্তু এখনো হয়নি। এই যে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা চলমান রয়েছে এর পরিবর্তন না হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদও বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে আলোচনা করেন।
একরাম হোসেন বলেন, পুলিশ, প্রসিকিউশনসহ আইনের সবক্ষেত্রে পরিবর্তন করতে হবে। মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ধর্ষণবিরোধী ক্যাম্পেইন করে সরকারকে প্রয়োজনে কমিউনিটি পর্যায়ে এই মারাত্মক অপরাধ রুখতে হবে। এম হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যধি। এটা সমাধান করতে হলে আমাদের অনেক বিষয় সমাধান করতে হবে। তবে এ মুহুর্তে যেটা সবচেয়ে জরুরি সেটা হলো – বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। নির্যাতিতা নারী যাতে বিচার পান সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। সভাপতির বক্তব্যের মাধ্যমেই এই অনলাইন বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।