সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক গোলটেবিল বৈঠক সুজন-এর উদ্যোগে ‘আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

সুজন-এর উদ্যোগে ‘আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

আসন্ন গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ পরিবেশে আয়োজনের দাবি জানিয়েছেন নাগরিক সংগঠন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর নেতৃবৃন্দ। তারা আজ ২৩ এপ্রিল ২০১৮, সকাল ১০.০০টায়, জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘সুজন’-এর উদ্যোগে আয়োজিত ‘আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচন: নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এ আহ্বান জানান।

বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন ‘সুজন’ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জনাব এম হাফিজ উদ্দিন খান। মূল প্রবন্ধ উপস’াপন করেন ‘সুজন’-এর নির্বাহী সদস্য ও বিশিষ্ট স’ানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ‘সুজন’ কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। আলোচনায় অংশ নেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন, বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা এবং ব্যারিস্টার জোর্তিময় বড়ুয়া। এছাড়া আগামী প্রকাশনীর সত্তাধিকারী জনাব ওসমান গনী, সুজন-এর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার-সহ বিভিন্ন সেক্টরের প্রতিনিধিরা উপসি’ত ছিলেন।

মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আগামী ১৫ মে ২০১৮ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন । এ নির্বাচনকে ঘিরে জনমনে প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। থাকা স্বাভাবিক। তবে সকল প্রশ্নের বিষয় মূলত একটি বিন্দুতে এসে শেষ হয়। তা হচ্ছে সরকারি প্রভাবমুক্ত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শানি-পূর্ণ নির্বাচন, যেখানে প্রার্থীরা নির্ভয়ে নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে প্রচার-প্রচারণা চালাবে এবং নির্বাচনের দিন স্বাধীনভাবে কোনো রকমের ভয়-ভীতি ছাড়া মানুষ পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে। এটি কোনো বাড়তি বা অতিরিক্ত চাওয়া নয়। দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনানুযায়ী এটিই হওয়া স্বাভাবিক। কিন’ নানা কারণে এ স্বাভাবিক চাওয়া এদেশে সাধারণ এ আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিকভাবে পূরণ হয় না। এক্ষেত্রে যেটি প্রয়োজন তা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের দৃঢ়তা এবং সরকারের সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতন্ত্রের প্রতি আন-রিক শ্রদ্ধা। তাছাড়া রয়েছে সকল প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর আইনানুগ সদাচারণ।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে নির্বাচনে ‘ক্ষমতা ভীতি’ একটি ‘হিস্টিরিয়া’ বা ‘ফোবিয়া’ যাই বলা হোক সেভাবে সর্বগ্রাসীরূপে দেখা দিয়েছে। জাতীয় কিংবা স’ানীয় নির্বাচন আসলেই জনমনে প্রথম যে ভীতি বা আশঙ্কা দেখা দেয় তা হচ্ছে সরকার বা সরকারি দলের অনুকূলে নির্বাচনী ফলাফলকে নেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হতে পারে। এক্ষেত্রে নির্বাচনী আইন বা দেশের প্রচলিত অন্যান্য আইনের প্রয়োগ সবার জন্য সমানভাবে হবে না। বিরোধী পক্ষগুলো সমস্বরে অভিযোগ করতে থাকে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও জেলা পরিষদ নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক কারচুপি, অনিয়ম ও সহিংসতা চলে। যার কোনো একটিরও কোনো প্রতিকার হয়নি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে প্রতিকার চাওয়ার সাহসও হয়নি। অনিয়ম এবং জীবনহানির অসংখ্য ঘটনা প্রতিকারবিহীনভাবে মিলিয়ে যায়।’

ড. তোফায়েল আহমেদ নাগরিক মনের কতগুলো প্রশ্ন তুলে ধরেন। ‘প্রশ্নগুলো হলো: ১. ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের স’গিত নির্বাচনের ভাগ্যে কী ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে? এ নির্বাচন কি জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা আছে? ২. পাঁচটি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনী তফসিল একসাথে না হয়ে প্রথমে দুটিতে করার কারণ কী? এ পাঁচটি নির্বাচন কি একই তফসিলে করা যেত না? ৩. রমজানের পর বাকি তিনটি ও ঢাকার দুটি করপোরেশনের স’গিত নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা কি নিশ্চিত? ৪. বর্তমান দুই সিটি ও অন্য তিন বা সর্বমোট বাকি পাঁচটি করপোরেশনের নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শানি-পূর্ণভাবে অনুষ্ঠানে সরকার ও নির্বাচন কমিশন কী রূপ ভূমিকা পালন করতে পারে? ৫. এ নির্বাচনসমূহে অংশগ্রহণকারী সকল দল ও ব্যক্তির জন্য সমান সুযোগ কি নিশ্চিত করা হবে?’

তিনি বলেন, ‘সুজন-এর প্রধান চাওয়া হলো সুষ্ঠু ও আইনানুগ নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিশ্চিত হোক। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন, সরকার অর্থাৎ বিভিন্ন স-রের প্রশাসনিক অধিকর্তাগণ যার যা দায়িত্ব তারা নিরপেক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সাথে তা পালন করুন, অংশগ্রহণকারী সকল দল ও ব্যক্তিগণ নির্বাচনী সদাচারণ করুন, এলাকার নাগরিকগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য আগ্রহী হোক এবং কিছু ত্যাগ স্বীকারে অঙ্গীকারবদ্ধ হোক। নাগরিক সক্রিয়তা ছাড়া গণতন্ত্র অর্থবহ ও বিকশিত হতে পারে না।’

ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘২০১৮ নির্বাচনের বছর। ইতিমধ্যে অনেকগুলো নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হয়েছে। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন-সহ এ পর্যন- অনুষ্ঠিত সকল স’ানীয় নির্বাচনের মধ্যে শুধুমাত্র নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও রংপুরের সিটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বাকি নির্বাচনগুলো বরাবরই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এখন জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে ঢাকা, ময়মনসিংহ-সহ আটটি (গাজীপুর, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল) সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তাবে। এ নির্বাচনগুলো কতটুকু স্বচ্ছ, সুষ্ঠু ও অবাধে অনুষ্ঠিত হয় তার উপর জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ অনেকখানি নির্ভর করবে।’

এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস’ার প্রথম ধাপ হলো নির্বাচন, যে নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও শানি-পূর্ণ। কিন’ বর্তমানের নির্বাচনগুলো এ মানদণ্ডগুলো পূরণ করতে পারছে না। এজন্য সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের পাশাপাশি সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে নাগরিকদেরও সোচ্চার হতে হবে।’ স’ানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে পরিচালনা করা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বলে মন-ব্য করেন তিনি।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা দরকার। কারণ একটি নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে নিরাপত্তা নিয়েই সবচেয়ে বেশি চিনি-ত থাকতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে মানুষ নির্বাচন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। কারণ মনে করে, ভোট দিলে যা, না দিলেও তা। তাছাড়া মানুষ নিশ্চিত নয় যে সে তার ভোট দিতে পারবে কি-না।’

এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামা যাচাই-বাছাই করে দেখা দরকার। এক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা না থাকলে কমিশন দুদক বা এনবিআর-এর সহায়তা নিতে পারে।’ হলফনামার বর্তমান ছকে পরিবর্তন আনা দরকার বলেও মন-ব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘ব্যালট বক্স ভোটের দিন সকালে ভোটকেন্দ্রে পাঠানো উচিত। এজন্য ভোট হওয়া উচিত গ্রীষ্মকালে, সকাল ৯.০০টা থেকে ৫.০০টা পর্যন- পর্যন- এবং প্রতি এক ঘণ্টা পর পর কত ভোট পড়লো তার হিসাব রাখা উচিত।’

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বর্তমানে নির্বাচনের ব্যাপারে গণউদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ মনে করে বর্তমানে সুষ্ঠু, অবাধ ও শানি-পূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করছে না।’ তিনি বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত হওয়ায় গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচন অনেক বার্তা বহন করবে। কারণ এই দুটি নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে কি-না এবং নির্বাচনে কারা জয়লাভ করবে সেদিকে দেশবাসীর নজর থাকবে।’ আলাদতের একটি রায়ের উদাহরণ টেনে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা দিয়ে স’ানীয় সরকার পরিচালনা করলে তা কোনো স’ানীয় সরকার হয় না।’ স’ানীয় সরকারকে একীভূত করা এবং স’ানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য কতগুলো আইনি সংস্কার করা দরকার বলে মন-ব্য করেন তিনি।

উল্লেখ্য, গোলটেবিল বৈঠকের শুরুতে ড. তোফায়েল আহমেদ ও বিধান চন্দ্র পাল-এর একটি বই ‘নগরায়ন ও নগর সরকার’-এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

গোলটেবিল বৈঠক থেকে জানানো হয়, সুজন-এর উদ্যোগে আগামী ৩০ এপ্রিল ২০১৮, সকাল ১০.০০টায় জয়দেবপুর কনভেনশন সেন্টারে গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মেয়র প্রার্থীদের নিয়ে ‘জনগণের মুখোমুখি অনুষ্ঠান’ এবং ২৮ এপ্রিল ২০১৮, সকাল ১০.০০টায় শহীদ পার্ক, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী মেয়র প্রার্থীদের নিয়ে ‘জনগণের মুখোমুখি অনুষ্ঠানে’র আয়োজন করা হবে। এছাড়া ০৩ মে ২০১৮, দুই সিটি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্যের বিশ্লেষণ তুলে ধরার উদ্দেশ্যে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হবে। এছাড়াও সুজন-এর উদ্যোগে ০৩-১২ মে খুলনা ও গাজীপুর সিটিতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান/প্রচারণা, ১৩ মে ২০১৮, সুষ্ঠু, অবাধ ও শানি-পূর্ণ নির্বাচন আয়োজন ও সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার আহ্বানে গাজীপুর ও খুলনায় মানববন্ধন কর্মসূচি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় (িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/ংযঁলধহ.নফ) বিভিন্ন প্রচারণা চালানো হবে।

Related Post

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তত আরো দুই টার্ম বহাল রাখার পক্ষে ঐক্যমত গত ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন। যার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা

দেশ সত্যিই বাজিকরদের হাতেদেশ সত্যিই বাজিকরদের হাতে

বদিউল আলম মজুমদার আল আমিন-আনাম : সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, দেশ সত্যিই আজ বাজিকরদের হাতে। বাজিকর হলো-চাঁদাবাজ, দুর্নীতিবাজ, খুনি, দালালরা। বাজিকরদের আধিপত্য যতদিন থাকবে রানাদের উত্থান ও দাপট

‘চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত‘চতুর্থ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন এবং স্থানীয় সরকার সংস্কার প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

নির্বাচনই যথেষ্ট নয়, উপজেলা পরিষদকে কার্যকর করার আহ্বান দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস’াকে শক্তিশালী ও কার্যকর করা আমাদের সাংবিধানিক নির্দেশনা। অথচ স্বাধীনতার ৪৩