‘নতুন নির্বাচন কমিশনকে জনগণের মধ্যে আস্থা অর্জন করা এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে মতানৈক্যে পৌঁছা এবং স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিতে হবে’ বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব ড. এ. টি. এম শামসুল হুদা। তিনি আজ ২ মার্চ ২০১৭, সকাল ১০.০০টায়, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক আয়োজিত জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠকে এই নেতৃবৃন্দ করেন।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন বলতে শুধু পাঁচজনকে বোঝায় না। বর্তমান কমিশনের সর্বমোট ৪ হাজার কর্মকর্তা রয়েছে। কমিশনের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য আলাদা নির্বাচনী ক্যাডার থাকা দরকার।’ নির্বাচন কমিশনের নাম পরিবর্তনের সমালোচনা করেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে ধীরগতিতে অগ্রসর হওয়া দরকার এবং যাদের ওপর ইভিএম মেশিনের দায়িত্ব দেয়া হবে তাদের ওপর আস্থা থাকতে হবে।’
সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান-এর সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সুজন নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, জনাব আলী ইমাম মজুমদার, বিচারপতি মো. আব্দুল মতিন, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, জনাব অধ্যাপক হুমায়ূন কবীর হিরু এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলাম প্রমুখ।
আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রবন্ধের শুরুতে নবগঠিত নির্বাচন কমিশনকে স্বাগত জানান। একইসঙ্গে পুরো জাতির স্বার্থে আমরা তাঁদের সফলতা কামনা করেন। তাঁদের সফলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুজন-এর পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানেরও আশ্বাস জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘নবগঠিত নূরুল হুদা কমিশন বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সফলতা অর্জন করতে হলে তাঁদেরকে এগুলো কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে হবে। এসব চ্যালেঞ্জের প্রধান উৎস হলো বিদায়ী রকিবউদ্দীন কমিশনের ব্যর্থতা। সরকারও অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। নবগঠিত নির্বাচন কমিশনের সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো তাদের সংখ্যা। কারণ পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট বর্তমান কমিশনের ক্ষেত্রে একটি বড় ঝুঁকি হলো তাদের মধ্যে সম্ভাব্য মতানৈক্য। বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে আশা করি নবগঠিত কমিশন এ চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে পারবে।’
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশনের সামনে অন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হলো কমিশনের স্বাধীনতা অক্ষুণœ রাখা। আগের শামসুল হুদা কমিশনের নেতৃত্বে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়েছিল। নবগঠিত কমিশনের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনী ও রাজনৈতিক দলের সংস্কার প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা। সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হলে আইনি কাঠমোতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা নতুন কমিশনের জন্য আইনি কাঠামোতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের প্রস্তাব করছি: (১) ‘না-ভোটে’র বিধানের পুনঃপ্রবর্তন; (২) মনোনয়নপত্র অনলাইনে দাখিলের বিধান; (৩) জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনে নির্বাচনের ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা ও আয়কর বিবরণী দাখিলের বিধান; (৪) সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে প্রদান; এবং (৫) রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্যদের নাম ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও নিয়মিত আপডেট করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি।’
তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য আইন ও বিধি-বিধানে সংস্কার করলেই হবে না, নির্বাচন কমিশনকে সেগুলো কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।’ এছাড়া সুষ্ঠু ভোটার তালিকা তৈরি, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণের দিকে নজর দেয়া, নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে আগের অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত বিধানটি ফিরিয়ে আনা, প্রার্থীদের নির্বাচনী হলফনামা খতিয়ে দেখা ও বর্তমান ছকে পরিবর্তন আনা, নির্বাচনী ব্যয় হ্রাস ও মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করা, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন রোধে রাজনৈতিক দলের অর্থের উৎসের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, নির্বাচনী বিরোধের দ্রুত মীমাংসা করা, নির্বাচনী সহিংসতা রোধে পদক্ষেপ নেয়া, আচরণবিধি আচরণবিধি মানতে কঠোরতা প্রদর্শন, আইন-কানুন ও বিধি-বিধানের প্রতি চরম উদাসীনতা প্রদর্শন করা, নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ প্রদানের বিধি-বিধান সুনির্দিষ্ট করার লক্ষ্যে একটি আইন করা ইত্যাদি সুপারিশ/প্রস্তাব তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি, নবগঠিত নির্বাচন কমিশন তাদের সততা, নিষ্ঠা, নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতা প্রদর্শন করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কমুক্ত ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হবেন।’ সরকার নির্বাচন কমিশনকে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘স্বচ্ছতার ভিত্তিতে আমরা চেয়েছিলাম নির্বাচন কমিশনে নিয়োগের লক্ষ্যে অনুসন্ধান কমিটি যাদের নাম সুপারিশ করবে তাদের নামগুলো প্রকাশ করা হবে, যাতে জনগণ তাদের যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু তা করা হয়নি।’ বর্তমান নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে হলে দক্ষ ও সাহসী হতে হবে এবং সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘বর্তমান কমিশনের প্রধান কাজ হবে কমিশনের প্রতি জনগণের আস্থা ফেরানো। এছাড়া স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বলে আইনে প্রচুর সংস্কার আনতে হবে, নির্বাচনী বিরোধ মিমাংসায় নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপন, বড় শহরগুলোতে সংসদীয় আসন সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়া দরকার।’
বিচারপতি আব্দুল মতিন বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে প্রধান দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের এবং আদালতের রায় অনুযায়ী এজন্য তাদের সব ধরনের ক্ষমতা রয়েছে। তবে সরকারকে এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে হবে। এছাড়া সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে।’ শামসুল হুদা কমিশন যেসব সুপারিশ রেখে গিয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘নির্বাচন শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের বিষয় নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে কমিশন ব্যর্থ হলে পুরো জাতির বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়। তাই আগামী জাতীয় নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।’ নতুন কমিশন তাদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা দিয়ে এবং নৈতিক গুণাবলী দিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম হবেন বলেন আশা করেন তিনি।
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘সকল দলের মতামতের ভিত্তিতে ইভিএম-এর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। আমরা নতুন প্রযুক্তি কেন নেব না তা ভাবতে হবে।’ নবগঠিত নির্বাচন কমিশন সততা ও যোগ্যতা দিয়ে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনের সদিচ্ছা ও কমিশনারদের যোগ্যতা থাকা দরকার। কিন্তু বর্তমান সিইসির বড় কোনো দায়িত্ব পালনের নেই বলে আমরা জানি।’ এছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন সহায়ক সরকার থাকা দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মূল প্রবন্ধ পড়তে এখানে ক্লিক করুন