সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক গোলটেবিল বৈঠক সুজন-এর উদ্যোগে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

সুজন-এর উদ্যোগে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

????????????????????????????????????

বিচারহীনতা রোধ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতের আহ্বান

বিচার বিভাগ, নির্বাহী ও আইন বিভাগ থেকে পৃথক হওয়ার পাশাপাশি বিচার কার্যে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা দরকার। কিন্তু স্বাধীনতার চার দশক পরও আমরা প্রতিনিয়ত বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলছি। অর্থাৎ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে, স্বস্তি নেই, আছে উৎকণ্ঠা। আজ ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে সুজন নেতৃবৃন্দ এ মন্তব্য করেন। সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার-এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন ড. কামাল হোসেন, বিচারপতি আব্দুল মতিন, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন, সৈয়দ আবুল মকসুদ, জনাব আবুল হাসান চৌধুরী, জনাব আলী ইমাম মজুমদার, ড. তোফায়েল আহমেদ, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ মহসেন রশিদ, ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা, অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, অ্যাডভোকেট হাসান তারিক চৌধুরী, জনাব জাকির হোসেন, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর এবং জনাব হুমায়ূন কবীর হিরু প্রমুখ।

আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন নির্বাহী সদস্য ও বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, “১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগ ছিল নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। নিম্ন আদালতের প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিল সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু ১৯৭৫ সালের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথকতা উভয়ই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার পথে বিচার বিভাগ যাতে অন্তরায় না হতে পারে সেই যুক্তিতে উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারক নিয়োগ, বরখাস্ত, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদি সব ক্ষমতাই ন্যস্ত করা হয় একচ্ছত্রভাবে রাষ্ট্রপতির ওপর। এমনকি ৯৬(৩) অনুচ্ছেদের বিচারপতিদের অব্যহতি সংক্রান্ত সংসদের আইন করার যে ক্ষমতার উল্লেখ ছিল সেটার বিলুপ্তি ঘটানো হয়। অর্থাৎ বিচারপতিদের ব্যাপারে সর্বময় ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী হয়ে পড়েছিলেন শুধু এবং কেবলমাত্র রাষ্ট্রপতি। ১৯৭৫ এ বিচারপতিদের স্বাধীনতা ভীষণভাবে ক্ষুন্ন করার যে অধ্যায় সেখান থেকে গত ৪০ বছরে  আমাদের যাত্রা ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগ সংক্রান্ত যে বিধি-বিধান ছিল সেটা পুনরুদ্ধার বা শুরুর পর্যায়ে ফিরে যাবার যাত্রা। তবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথকীকরণ নিশ্চিত করার যে বিধান ছিল সেখানে আমরা এখনো সম্পূর্ণ ফিরে যেতে পারি নাই।

তিনি এ অবস্থা থেকে উত্তরণে কিছু সুপারিশ করেন। যথা-সংবিধানের ৯৫(২)(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচারপতি নিয়োগের স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য আইন প্রণয়ন করা; সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ বাতিল করে ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১১৫, ১১৬ প্রতিস্থাপন করে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণ নিশ্চিতকরণ; সংবিধানের ১১৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের জন্য সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বা বিচার বিভাগীয় প্রশাসন ব্যবস্থা স্থাপন করা; উপযুক্ত প্রশিক্ষণ সাপেক্ষে সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন বিচারপতিকে সার্বক্ষণিকভাবে বিচার বিভাগীয় প্রশাসনের দায়িত্ব পালন; মামলার জট কমানো ও বিচার প্রার্থীদের প্রত্যাশা পূরণের জন্য বার ও বেঞ্চের যৌথ উদ্যোগ গ্রহণ; বিচারক-সহ বিচার বিভাগের সকল স্থরে কর্মকর্তাদের জন্যে অর্থপূর্ণ প্রশিক্ষণ ও উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা; এবং বিচার বিভাগের জন্য বাজেট বাড়ানো।

তিনি বলেন, ‘তবে বাস্তবতা হলো, যে সরকারের ব্যাপক জনসমর্থন নেই; সংসদে সতিকারের বিরোধী দল নাই এবং সংসদ কার্যত অকার্যকর; নির্বাচন কমিশন যেখানে সরকারি দলকে জেতাতে ব্যস্ত; আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও দুদকের অন্যতম প্রধান কাজ ভিন্ন দলের রাজনীতিবিদদের শায়েস্তা করা এবং সরকারের প্রধান লক্ষ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সেখানে আইনের শাসন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের জন্যে প্রস্তাব করা যায়, কিন্তু এ ধরনের কোনো পদক্ষেপের বাস্তবায়নের প্রত্যাশা সুদূর পরাহত।’

ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের সংবিধান পেয়েছি। এ সংবিধানের রক্ষক হলো সুপ্রিম কোর্ট। তাই সুপ্রিম কোর্টকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। এদেশের মানুষের মধ্যে মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে। তাই জনগণ দেশের মালিক নয় এবং বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকবে না- এ ধরনের ঘোষণা দেয়া হলে জনগণ মেনে নেবে না।’ তিনি বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা মানে সুষ্ঠু প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারপতিদের নিয়োগ দান এবং সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা। অথচ দীর্ঘ সময় পার হলেও বাংলাদেশের এখনো বিচারপতি নিয়োগ আইন প্রণয়ন হয়নি, যে কারণে যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে না হয়ে দলীয় ভিত্তিতে বিচারক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।’ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না থাকলে কারো অধিকার সুরক্ষিত থাকে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

বিচারপতি আব্দুল মতিন বলেন, ‘সার্বজনীন মানবাধিকায় ঘোষণায় প্রত্যেক নাগরিকের বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু সে বিচার হতে হবে স্বাধীনভাবে।’ তিনি বলেন, ‘বিচারপতিদের নিয়ে সংসদে আলোচনা করা যাবে না এবং ব্যক্তিগত ডিনারে আহ্বান করা যাবে না-ভারতে এ ধরনের আইন থাকলেও আমাদের এখানে এ ধরনের আইন নেই। আমি মনে করি, এ ধরনের সংস্কৃতি বন্ধ করা দরকার। না হয় বিচারপতিরা স্বাধীনভাবে রায় দিলেও জনগণের মধ্যে বিচার বিভাগের প্রতি এক ধরনের অনাস্থা তৈরি হবে।’

এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘আমরা বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও কার্যকর দেখতে চাই। কিন্তু কলুষিত রাজনীতি বিরাজমান থাকলে বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে না। এ অবস্থায় দুর্নীতি রোধ করা এবং রাজনৈতিক সংস্কার দরকার, যাতে বিচার বিভাগকেও স্বাধীন করা যায় এবং মানুষ ন্যায়বিচার পায়।’

সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা দরকার। এছাড়া বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়। কিন্তু আমাদের বিচার বিভাগ গবির ও দুর্বল বান্ধব নয়।’ এ অবস্থায় আমাদের বিচার বিভাগকে ক্ষমতাবান্ধব না হয়ে দুর্বলবান্ধব হওয়া দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি।

ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বিচার বিভাগ পরিপূর্ণ স্বাধীন না হওয়ায় দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি রয়েছে এবং বিভিন্নভাবে মানুষ বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘গ্রাম সরকার আইন নিয়ে আরও ভাবা দরকার। বিশেষ করে একে সালিশী আদালত না বলে ভিলেজ কোর্ট বলার যৌক্তিকতা আছে কিনা তাও ভাবা দরকার।’

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘সাবেক একজন বিচারপতি যেভাবে প্রধান বিচারপতিকে আক্রমণ করে চলেছেন তা স্বয়ং বিচার বিভাগকে হেয় করার শামিল।’ বিচার বিভাগ স্বাধীন না হলে মানুষ বঞ্চিত না হলে মানুষ বঞ্চিত হয় মন্তব্য করেন তিনি।

ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খোলামেলা ও বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করা দরকার। কিন্তু আদালত অবমাননা আইনের অপপ্রয়োগের কারণে বর্তমানে খোলামেলা আলোচনা করা যায় না। আমরা শুনেছি যে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মানে না আইন মন্ত্রণালয়। অথচ সেক্ষেত্রে আদালত অবমাননার রুল জারি করা হচ্ছে না।’ বিচারক নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিচারক নিয়োগের আইন না থাকায় অনেক অযোগ্য আইনজীবী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন। চারটি ডিগ্রির মধ্যে তিনটিতেই তৃতীয় শ্রেণি পেয়েছেন এমন আইনজীবীও বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বলে শোনা যায়।’

Related Post

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তত আরো দুই টার্ম বহাল রাখার পক্ষে ঐক্যমত গত ১০ মে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন। যার ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা

সুজন-এর উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের শিক্ষার বর্তমান হালচাল’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনসুজন-এর উদ্যোগে ‘বাংলাদেশের শিক্ষার বর্তমান হালচাল’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

শিক্ষা খাতে বিরাজমান অরাজকতা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন, কৃত্রিমভাবে পাশের হার বাড়ানো এবং প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত আইন অনুসরণ করা এবং

“সুশাসন ও উন্নয়ন: প্রেক্ষিত উপজেলা নির্বাচন” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত“সুশাসন ও উন্নয়ন: প্রেক্ষিত উপজেলা নির্বাচন” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত

গত ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ ‘স্বশাসিত ইউনিয়ন পরিষদ এডভোকেসি গ্রুপ-বাংলাদেশ’ ও ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর যৌথ উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাব-এর ভিআইপি লাউঞ্জে একটি গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সুজন-এর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাজী এবাদুল