সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক গোলটেবিল বৈঠক সুজন-এর উদ্যোগে ‘রংপুরের সফল নির্বাচনের ধারাবহিকতা রক্ষায় করণীয়’ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

সুজন-এর উদ্যোগে ‘রংপুরের সফল নির্বাচনের ধারাবহিকতা রক্ষায় করণীয়’ গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

রংপুরে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন হলো তার ধারাবাহিকতা আগামী সকল নির্বাচনে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন সুজন নেতৃবৃন্দ। তাঁরা আজ ১১ জানুয়ারি ২০১৮ জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে ‘রংপুরের সফল নির্বাচনের ধারাবহিকতা রক্ষায় করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এই দাবি জানান।

গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। আলোচনায় অংশ নেন সুজন নির্বাহী সদস্য জনাব আলী ইমাম মজমুদার, ড. আসিফ নজরুল, সাবেক অতিরিক্ত সচিব জনাব শফিউল আলম, রাজনীতিবিদ হুমায়ুন কবীর হিরু, সুজন ঢাকা জেলা কমিটির সম্পাদক জনাব আবুল হাসনাত, জনাব ক্যামেলিয়া চৌধুরী, মহানগর কমিটির সহ-সভাপতি জনাব নাজিম উদ্দিন প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী জনাব দিলীপ কুমার সরকার।

মূল প্রবন্ধে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সকল পর্যবেক্ষকের মতেই সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রংপুরের সিটি করপোরেশন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ তথা গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এতে ভোটার তালিকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, অর্থাৎ মনে হয় যেন রংপুরে সকল এলিজেবল বা ভোটার হবার যোগ্য ব্যক্তি ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছেন। যারা প্রার্থী হতে চেয়েছেন তারা প্রার্থী হতে পেরেছেন। ভোটারদের সামনে বিকল্প প্রার্থী ছিল, অর্থাৎ নির্বাচনটি ছিল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। এই নির্বাচনে ভোটারগণ কোনোরূপ ভয়-ভীতির উর্ধ্বে ওঠে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন। নির্বাচনে কোনো সহিংসতা ঘটেনি। ভোটগুলো সঠিকভাবে গণনা হয়েছে। পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়াটিই ছিল মোটামুটি স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য। রংপুরের নির্বাচনকে তাই, আন্তর্জাতিক আইনের ভাষায়, ‘জেনুইন ইলেকশান’ বা সঠিক নির্বাচন বলা চলে।’

তিনি বলেন, ‘রংপুর সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার অন্যতম কারণ হলো সেখানে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা প্রদর্শন এবং জন আস্থা অর্জনের লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। কমিশন ৩৩ জন নির্বাহী ম্যাজিট্রেটের অধীনে ৩৩টি এবং বিচারিক ম্যাজিট্রেটের অধীনে ১১টি ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করেছে। এছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়ে পাঁচ হাজার সদস্যকে মোতায়েন করেছে। সর্বোপরি রংপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং প্রশাসন তথা সরকার দায়িত্বশীল আচরণ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও সদাচারণ করেছে। একইসঙ্গে এ নির্বাচনে গণমাধ্যম ওয়াচডগের ভুমিকা পালন এবং নাগরিক সমাজও ব্যাপক সক্রিয়তা প্রদর্শন করেছে।’

তিনি বলেন, ‘রংপুরে সাত মন ঘি জুটেছে, তাই রাধাও নেচেছে। অন্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি করা গেলেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে। অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে না, যদিও এর জন্য কমিশনের ভূমিকাই সর্বাধিক। বস্তুত, নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা, নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য (necessary) হলেও, তা যথেষ্ট (sufficient) নয়। আরও সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে, সবচেয়ে নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে না, যদি না সরকার ও রাজনৈতিক দল সদিচ্ছা প্রদর্শন এবং দায়িত্বশীল আচরণ না করে। তাই রংপুরের নির্বাচন মানুষের মধ্যে আশাবাদ সৃষ্টি করলেও, তা থেকে আগামী নির্বাচনগুলো, কেমন হবে তার কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে না। ’

তিনি আরও বলেন, ‘ রংপুরের সফল নির্বাচনের অভিজ্ঞতার ধারাবাহিকতা অন্যান্য সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রক্ষা করা গেলেও, সংসদ নির্বাচনে তার পুনরাবৃত্তি করা যাবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কারণ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হয় না। পক্ষান্তরে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল হয়। তাই জাতীয় নির্বাচনের সমীকরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আর আমাদের দেশের ‘বিজয়ীদের সবকিছু করায়ত্তে’র (winner-take-all) সংস্কৃতিতে যেকোনো মূল্যে নির্বাচনে জেতার এক অশুভ প্রতিযোগিতা বিরাজমান। তাই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য বা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল মরণপণ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলে আমরা আশ্চার্যান্বিত হব না। তাই ঢাকাসহ আগামী ছয়টি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হলেও আগামী একদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে তা কোনোভাবেই নিশ্চিত করে বলা যাবে না।’

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে এবং নির্বাচনকালীন সরকার ও সংসদ ভেঙে দেওয়া সম্পর্কে একটি ঐকমত্যে না পৌঁছলে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে তার নিশ্চয়তা কোনোভাবেই দেওয়া যায় না।’

জনাব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশন রংপুরের নির্বাচনের আগে কুমিল্লায় একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে তা ভুলে গেলে চলবে না। রংপুরের নির্বাচনে আইন-শৃ্খংলা বাহিনীর সাড়ে পাঁচ হাজার সদস্য কাজ করেছে।’ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করার জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন দরকার বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সার্বজনীন ভোটাধিকার ব্যবস্থাকে মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলি, তা আমাদের পুনরুদ্ধার করতে হবে। এক্ষেত্রে সুজন-এর সাথে সাথে রাজনৈতিক দল-সহ সকলকে স্ব স্ব অবস্থান থেকে কাজ করে যেতে হবে।’

জনাব শফিউল আলম বলেন, ‘আমরা নৈরাশ্যবাদী হতে চাই না। আমরা মনে করি, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের প্রত্যাশা ও আন্তরিকতা থাকলে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। একজন নাগরিক হিসেবে আমি আশা করি, রংপুরের নির্বাচনের ধারাবাহিকতা আগামী নির্বাচনগুলোও অব্যাহত থাকবে। ’

ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘সুজন সীমিত সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ রাখার জন্য নির্বাচনকেন্দ্রিক যেসব কাজ করছে তাতে আমরা আশাবাদী হতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘রংপুরের নির্বাচন নিয়ে আমরা খুব একটা আশাবাদী হতে পারি না। কেননা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হলেও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল অংশগ্রহণ করতে পারেনি।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন যদি অংশগ্রহণমূলক হয় তাহলে সরকারের যত খারাপ দূরভিসন্ধি থাকুক না কেন, তাতে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা সহজ হয় না। ’

জনাব দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ‘রংপুরের নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যেসকল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে রংপরের নির্বাচন সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য। এ নির্বাচনে সুজন-এর উদ্যোগে মেয়র পদপ্রার্থীদের নিয়ে একটি এবং অন্য ১৫টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদপ্রার্থীদের নিয়ে ‘ভোটার মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে হাজার হাজার ভোটার অংশ নিয়েছেন। এসব অনুষ্ঠানে হলফনামায় প্রদত্ত প্রার্থীদের তথ্যের তূলনামূলক চিত্র তৈরি করে বিতরণ করা হয়, যাতে ভোটারগণ তথ্যের দ্বারা ক্ষমতায়িত হয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। আমরা মনে করি, সুজন কর্তৃক এসকল কার্যক্রম যে যে ওয়ার্ডে পরিচালিত হয়েছে সেখানে নির্বাচনি সহিংসতা ঘটেনি। সুতরাং ভবিষ্যতেও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে আমাদের নির্বাচন কমিশনের সাথে এ সকল কার্যক্রম আরও বেশি বেশি পরিচালিত করতে হবে।’

মূল প্রবন্ধ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

Related Post

“সুশাসন ও উন্নয়ন: প্রেক্ষিত উপজেলা নির্বাচন” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত“সুশাসন ও উন্নয়ন: প্রেক্ষিত উপজেলা নির্বাচন” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত

গত ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭ ‘স্বশাসিত ইউনিয়ন পরিষদ এডভোকেসি গ্রুপ-বাংলাদেশ’ ও ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর যৌথ উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাব-এর ভিআইপি লাউঞ্জে একটি গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সুজন-এর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি কাজী এবাদুল

‘রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সংলাপ, সমঝোতা, সমাধান জরুরি’ – গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাগণ‘রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে সংলাপ, সমঝোতা, সমাধান জরুরি’ – গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাগণ

গত ২৮ মে ২০১২, সকাল ১০ টায়, জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে, সুজনে’র উদ্যোগে ‘চলমান রাজনৈতিক সংকটের উত্তরণ কোন পথে’ শীর্ষক একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই সদ্য প্রয়াত

“সংসদের কার্যকারিতা ও সংসদ সদস্যদের আচরণবিধি” শীর্ষক সুজনে’র গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত“সংসদের কার্যকারিতা ও সংসদ সদস্যদের আচরণবিধি” শীর্ষক সুজনে’র গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত

সংসদ সদস্যদেরকে সংসদীয় কাজে নিবিষ্ট করা এবং তাঁদেরকে স্থানীয় উন্নয়ন কাজ থেকে দূরে রাখা; সংসদীয় কার্যক্রমে সর্বোচ্চ অবদান রাখার লক্ষ্যে তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করা এবং সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয়