সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক গোলটেবিল বৈঠক সুজন-এর উদ্যোগে ‘সংবিধান সংশোধন, বিচারপতিদের অভিশংসন ও এর তাৎপর্য’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

সুজন-এর উদ্যোগে ‘সংবিধান সংশোধন, বিচারপতিদের অভিশংসন ও এর তাৎপর্য’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

Picture of Roundtable‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের নিকট অর্পণ করা হলে বিচার বিভাগ সরকারের কাছে নতজানু হতে বাধ্য হবে এবং এর বিরূপ প্রভাব অন্যান্য সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানেও পড়বে।’ তাই ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান- নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক নেতৃবৃন্দ। গত ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ১০.৩০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের কনফারেন্স লাউঞ্জে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর উদ্যোগে ‘সংবিধান সংশোধন, বিচারপতিদের অভিশংসন ও এর তাৎপর্য’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে সুজন নেতৃবৃন্দ এ আহ্বান জানান।

সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও নির্বাহী সদস্য বিচারপতি কাজী এবাদুল হক-এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিচারপতি আমিরুল কবীর চৌধুরী, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন, সুজন এর নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, ড. মিজানুর রহমান শেলী, ড. শওকত আরা হোসেন, ড. বোরহান উদ্দীন খান, সুজন নির্বাহী সদস্য প্রকৌশলী মুসবাহ আলীম, সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, বাসদের সাধারণ সম্পাদক কমরেড খালেকুজ্জামান, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলাম লেখক মিজানুর রহমান খান, রাজনীতিবিদ মাহমুদুর রহমান মান্না, সাবেক সংসদ সদস্য হুমায়ূন কবীর হিরু ও সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমাদের দেশে বহুদিন থেকেই প্রধানমন্ত্রীর একনায়কত্ব চলে আসছে। বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দিলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংসদীয় ব্যবস’ায় ‘প্রিন্সিপলস অব সেপারেশন অব পাওয়ার’ বা ক্ষমতার পৃথকীকরণ পদ্ধতির কার্যকারিতা অপেক্ষাকৃত দুর্বল, কারণ সংসদীয় পদ্ধতিতে আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগের বিভাজন অনেকটা কৃত্রিম। আর তাঁর সংসদের ওপর বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা অর্পণ করলে এ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে বলেই অনেকের আশঙ্কা, যা কর্তৃত্ববাদী সরকার সৃষ্টির পথকে সুগম করবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রস্তাবিত ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে উদ্বেগের একটি কারণ হলো এর প্রেক্ষাপট। আমাদের সংবিধান রচনাকালে বিরাজমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আর বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখনকার রাজনীতিবিদরা মান ও মননের দিক থেকে অনেক বেশি উন্নত ও জনকল্যাণমুখী ছিলেন। কিন’ বর্তমানে আমাদের রাজনীতিবিদদের মান ও মননের অনেক অবনতি ঘটেছে। তাই সংসদের হাতে বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতার অপব্যবহার হবে না, তা আজ জোর দিয়ে বলা যায় না। আর বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার প্রধান ও সংসদ নেতা যে সিদ্ধান- নেবেন তাই কার্যকর হবে। সুতরাং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হবে বলেই অনেকের আশঙ্কা।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার জন্য সংবিধানের অনেকগুলো অনুচ্ছেদে – যেমন, অনুচ্ছেদ ৯৫, ৯৬, ৯৯, ১১৫ ও ১১৬ – পরিবর্তন আনা দরকার, সেখানে শুধুমাত্র ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিবর্তনের প্রস্তাব আনা হয়েছে। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সরকার হস-গত করতে চাইলেও, বিচারক নিয়োগে যোগ্যতার মাপকাঠি নির্ধারণের ব্যাপারে তারা সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে তারা দলবাজির অবসান ঘটাতে এবং সংবিধান নির্দেশিত বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করতে তারা অনাগ্রহী।’
সুজন সম্পাদক বলেন, ‘সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদে নিযুক্ত ব্যক্তিদের অপসারণের ক্ষেত্রেও উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের পদ্ধতিই প্রযোজ্য। এমনকি সংসদ কর্তৃক আইনের দ্বারা সৃষ্ট বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য। অর্থাৎ মনে হয় যেন সরকার এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারার উদ্যোগ নিয়েছে এবং সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সরকারের একটি বৃহত্তর ও সুদূরপ্রসারী নিবর্তনমূলক স্কিমেরই অংশ। এই সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার সব সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মাথার ওপর একটি ভয়াবহ খড়গ টানানোর পাঁয়তারায় লিপ্ত হয়েছে।’
ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘বিচারপতিদের অপসারণ-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী যেভাবে করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই ঠিক নয়। এ ব্যাপারে সবার মতামত নিতে হবে। শুধু এই সংশোধনীই নয়, সংবিধানের কোনো সংশোধনীই জাতীয় ঐকমত্য ছাড়া করা উচিত নয়। তার কারণ গণতন্ত্র শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই মাসে হঠাৎ করে সব কাজ বাদ দিয়ে সরকার সংবিধান সংশোধনের কাজ শুরু করল কেন? অথচ সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগের আইন এখনো হয়নি। বিচার বিভাগের এসব বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে সংবিধান সংশোধন কেন জরুরি হলো।’
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘ভোটারবিহীন একটি নির্বাচনের পর হঠাৎ করে সংসদের কাছে বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা প্রদান সন্দেহের উদ্রেক না করে পারে না। এ সংশোধনী আনার আগে বিভিন্ন আইনি দিক খতিয়ে দেখে সিদ্ধান- নেওয়া দরকার ছিল।’ সরকারের এ সিদ্ধানে-র ব্যাপারে সবাইকে সোচ্চার হবার আহ্বান জানান তিনি।
বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বলেন, ‘বিচারপতিদের অভিশংসন করতে হলে আইন প্রণয়ন করতে হয়। ভারতে ১৯৬৬ সালে এ সংক্রান- আইন প্রণয়ন করা হয়। তাই অতি দ্রুত আমাদের দেশেও এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করতে হবে।’ তবে আইন প্রণয়ন কমিটিতে যেন বিচারপতিদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, সেদিকে খেয়াল রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী বলেন, ‘বিচারপতিদের সততা, স্বচ্ছতা ও কর্মদক্ষতা সম্পর্কে বিচারপতিরাই সবচেয়ে ভালো জানবেন। তাই সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ যৌক্তিক। একইসাথে বিচারক নিয়োগে আইন ও বিচারকদের জন্য অনুসরণীয় কোড অব কনডাক্ট থাকা আবশ্যক।’ ষোড়শ সংশোধনী আনার আগে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংশোধন আনা দরকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিচারপতিদের অভিশংসন সংসদের হাতে দেওয়ার আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসেয়েশন, বার কাউন্সিল-এর সাবেক নেতৃবৃন্দের সাথে সরকারের আলোচনা করা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। এছাড়াও তিনি বর্তমান সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে কীভাবে কার্যকর করা যায় সে বিষয়েও সকলকে মতামত প্রদানের আহ্বান জানান।
অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে সরকার একযোগে বহু প্রতিষ্ঠানের ওপর খগড় টানার উদ্যোগ নিয়েছে। এ সংশোধনী বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে একটি বাধা হয়ে দাঁড়াবে।’
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর প্রভাব ভয়াবহ হতে বাধ্য। কারণ বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া হলে এক সরকারের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারকগণ অন্য সরকারের আমলে অপসারণের শিকার হবেন। এমনিতেই প্রধানমন্ত্রীর হাতে প্রচুর ক্ষমতা। এ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ হবে এবং বিভিন্ন সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের মুখে পড়বে।’ তিনি অভিশংসনের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে অর্পণ করে একে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান।
মিজানুর রহমান খান বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অকার্যকর হয়ে পড়ে আছে, এ নিয়ে কেউ কথা বলছে না। এছাড়া বিচারকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করার কোন ব্যবস্থা নেই। এজন্য Peer Review System থাকা দরকার। যাতে বিচার বিভাগ নিজেরাই নিজেদের সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধান করতে পারে।’
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে শুধুমাত্র বিচারকরাই সংসদ দ্বারা অভিশংসনের মুখে পড়বেন না, একই সাথে নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য সংস্থার সদস্যরাও সংসদ কর্তৃক অভিশংসনের মুখে পড়বেন। যার ফলে এ সংস্থাগুলোর কার্যকারিতাও হুমকীর মুখে পড়বে।’

Related Post

সুজন-এর উদ্যোগে ‘গুম ও অপহরণ: নাগরিক উদ্বেগ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিতসুজন-এর উদ্যোগে ‘গুম ও অপহরণ: নাগরিক উদ্বেগ ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশে গুম ও অপহরণ এক সর্বনাশা মাত্রা লাভ করেছে। এতে নাগরিক সমাজ ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও শঙ্কিত বলে মন্তব্য করেছেন সুজন নেতৃবৃন্দ। আজ ৮ মে ২০১৪ জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘সুজন-সুশাসনের

সুজন-এর উদ্যোগে ‘নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনসুজন-এর উদ্যোগে ‘নতুন নির্বাচন কমিশনের সামনে চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক আয়োজন

‘নতুন নির্বাচন কমিশনকে জনগণের মধ্যে আস্থা অর্জন করা এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার বিশেষ করে রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে মতানৈক্যে পৌঁছা এবং স্বাধীন সচিবালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিতে হবে’ বলে মন্তব্য

“সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার, ক্ষমতা ও দায়মুক্তি: স্বরূপ ও ব্যাপকতা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত“সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার, ক্ষমতা ও দায়মুক্তি: স্বরূপ ও ব্যাপকতা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত

আমাদের সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদে সংসদ ও সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ও দায়মুক্তির বিধান রয়েছে। সাংবিধানিক বিধানানুযায়ী সংসদ আইনের দ্বারা এগুলো সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে অদ্যাবধি কোনো আইন