জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালা-২০১৪ বাতিল করে গণমাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের মতামতের ভিত্তিতে সমপ্রচার আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন সুজন নেতৃবৃন্দ। গত ২১ আগস্ট ২০১৪ সকাল ১০.৩০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর উদ্যোগে ‘সমপ্রচার নীতিমালা, আইন ও সমপ্রচার কমিশন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে সুজন নেতৃবৃন্দ এ দাবি জানান। সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার-এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন সুজন এর নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, সুজন নির্বাহী সদস্য প্রকৌশলী মুসবাহ আলীম, সাবেক তথ্যমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সায়ীদ, সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী, বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক গোলাম রহমান, বিশিষ্ট সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান, সাবেক সংসদ সদস্য হুমায়ূন কবীর হিরু, সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য জনাব রেহানা সিদ্দিকী, ও সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য ও বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব জনাব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ‘সরকার ঘোষিত জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালা ইতোমধ্যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। নীতিমালা রচয়িতারা ছাড়া আর কেউ এই নীতিমালা সমর্থনে এগিয়ে আসেনি।’
প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘সমপ্রচার মাধ্যমকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনার জন্যে সরকার এই নীতিমালা প্রণয়ন করেছে – এই ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়। এর পেছনে সরকারের একটা রাজনৈতিক নীলনকশাও রয়েছে। ৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পর সরকার অনেকটা অস্বস্তিতে আছে। প্রধান বিরোধী দলকে সরকার নানা কৌশলে কোনঠাসা করতে পারলেও গণমাধ্যমকে বশে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই টিভির ‘সংবাদ’ ও সমালোচকদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্যেই প্রথম পদক্ষেপ হলো জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালা।’
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, “এক মাসের মধ্যে সমপ্রচার আইন তৈরির জন্যে একটি কমিটি করবেন।” আমরা তাঁর এই ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। আমরা আশা করবো আইন ও গণমাধ্যম বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এই কমিটি গঠন করা হবে। আইন প্রণয়ন কমিটির কাছে বর্তমান নীতিমালাটি গাইডলাইন হিসেবে দেয়া হলে তা ঠিক কাজ হবে না। কারণ নীতিমালার বহু ধারা ত্রুটিপূর্ণ ও অস্পষ্ট।’
প্রবন্ধে সমপ্রচার কমিশন কীভাবে গঠন করা যায় তার একটি বিকল্প প্রস্তাব রাখেন। সরকার প্রধান অংশীজন (এ্যাটকো), জাতীয়ভিত্তিক বিভিন্ন পেশাজীবী ফোরাম, (অন্তত ১০টি) সক্রিয় নাগরিক ফোরাম (অন্তত ৫টি) এদেরকে ১ জন চেয়ারম্যান ও ১০ জন সদস্যের নাম প্রস্তব করার দায়িত্ব দিতে পারেন। সদস্যদের যোগ্যতার মাপকাঠিও বলে দিতে হবে। যাঁদের নাম প্রত্যেক তালিকায় কমন হবে তাঁদেরকেই সরকার সমপ্রচার কমিশনে মনোনয়ন দিতে পারেন।’
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর সমপ্রচার কমিশনের সদস্যদের যোগ্যতার মাপকাঠিও কী হবে তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেন। তিনি ইলেকট্টনিক মিডিয়ার জন্যে পৃথক ‘সমপ্রচার কমিশন’ গঠন না করে বর্তমান প্রেস কাউন্সিলকে ঢেলে সাজিয়ে ‘মিডিয়া কাউন্সিল’ করার যে প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তাও বিবেচনার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘এ নীতিমালার কিছু ভয়ংকর দিক রয়েছে যা, গণতন্ত্র তথা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ নীতিমালা সংবিধান ও তথ্য অধিকার আইনের সাথেও সাংঘর্ষিক। সামগ্রিক বিচারে এ নীতিমালা গ্রহণযোগ্য নয়।’ তিনি যোগ্য, দক্ষ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সমপ্রচার কমিশন গঠন করা উচিৎ বলে মন্তব্য করেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো সব সময় গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালাও এ ধরনের একটি প্রেক্ষাপটে প্রণয়ন করা হয়েছে। মূলত, প্রতিযোগিতাহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা – ইত্যাদি বিষয়ে সবার কণ্ঠরোধ করা এবং ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত কার জন্যই এই নীতিমালা।’
তিনি বলেন, ‘এই নীতিমালা বাতিল করে প্রথমে সমপ্রচার কমিশন গঠন করতে হবে। কিন’ কমিশন গঠনে আমাদের অভিজ্ঞতা অত্যন- করুণ। আপনাদের সকলের স্মরণ আছে যে, সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো। সার্চ কমিটিতে কারা ছিলেন? তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন ও বিতর্ক। সাধারণত সার্চ কমিটিতে সরকারের পছন্দের লোকেরা নিয়োগ পেয়ে থাকেন।’ তাই দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সমপ্রচার কমিশন গঠনের দাবি জানান সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, ‘জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালা একটি মানসম্মত নীতিমালা হয়নি। কারণ নীতিমালায় বেশ কিছু বিষয়ে স্ববিরোধীতা রয়েছে। নীতিমালায় দেশি গণমাধ্যম পরিচালনার নীতিমালা সম্পর্কে আলোচনা করা হলেও বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেল সমপ্রচার নিয়ে কোন আলোচনা করা হয়নি। অথচ বিদেশি অনেক চ্যানেলের কারণে আমাদের দেশে বিরূপ সাংস্কৃতিক প্রভাব পড়ছে। সুতরাং সকলের মতামতের ভিত্তিতে এমন একটি সমপ্রচার আইন প্রণয়ন করতে হবে যাতে আমরা একটি দায়িত্বশীল গণমাধ্যম পাই।’
অধ্যাপক আবু সায়ীদ বলেন, ‘এ নীতিমালার কিছু কিছু বিষয়ে একমত হওয়া গেলেও বেশকিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। সর্বোপরি এটি নীতিমালা নয়, এটি সমপ্রচার ক্ষেত্রে একটি ইতিমালা হয়েছে। অর্থাৎ গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করার জন্যই এই নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।’
অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্য ও ভিন্নমত পোষণকারীদের কণ্ঠরোধ করতেই সরকার জাতীয় সমপ্রচার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। নীতিমালা অনুযায়ী, কমিশনের হাতে আইনি ক্ষমতা থাকবে না। এর মাধ্যমে তথ্য মন্ত্রণালয় যে কারো বিরুদ্ধে ব্যবস’া নিতে পারবে।’
সমপ্রচার নীতিমালা তৈরির পেছনে সরকারের রাজনৈতিক নীলনকশা রয়েছে বলে মন-ব্য করেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। আমাদের প্রেস কাউন্সিল থাকার পরও কেন এই নীতিমালা? – এমন প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, ‘এই নীতিমালা বাস-বায়ন করা হলে সরকার হয়তো কিছুদিন পর হয়তো সাংবাদিকদের ড্রেস কোড নিয়েও আইন প্রণয়ন করবে।’ এ সময় তিনি সমপ্রচার নীতিমালা স’গিত করে এটি পুনর্বিবেচনার দাবি জানান।
জনাব নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘ইলেকট্টনিক মিডিয়ার জন্যে পৃথক ‘সমপ্রচার কমিশন’ গঠন না করে গণমাধ্যমের জন্য সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন প্রয়োজন। পাশ হওয়া সমপ্রচার নীতিমালার বিভিন্ন বিষয়ে অস্পষ্টতা ও স্ববিরোধিতা রয়েছে।’ এ সময় তিনি নীতিমালাটি ধরে পুঙ্খানাপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে সরকারের কাছে একটি প্রস-াবনা প্রদানের জন্য সুজন-এর প্রতি আহ্বান জানান।