সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক সংবাদ সম্মেলন সুজন-এর উদ্যোগে ‘হাওর এলাকার হাহাকার’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

সুজন-এর উদ্যোগে ‘হাওর এলাকার হাহাকার’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা এবং সেখানকার মানুষদের জরুরি সহায়তা দেয়ার দাবি জানিয়েছেন সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক নেতৃবৃন্দ। আজ ২৬ এপ্রিল ২০১৭ সকাল ১১.১০টায়, জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুজন আয়োজিত ‘হাওর এলাকার হাহাকার’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন নেতৃবৃন্দ এই আহ্বান জানান।

সংবাদ সম্মেলনে সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, আলী ইমাম মজুমদার ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, জাতীয় কমিটির সদস্য ড. স্বপন আদনান এবং সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী জনাব দিলীপ কুমার সরকার উপস্থিত ছিলেন। লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন সুজন-এর সহযোগী সমন্বয়কারী সানজিদা হক বিপাশা।

লিখিত বক্তব্যে সানজিদা হক বিপাশা বলেন, ‘গত ২৯ মার্চ থেকে পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে বাঁধ ভেঙ্গে ও বাঁধ উপচে সুনামগঞ্জ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল পানিতে তলিয়ে গিয়েছে। তাহিরপুর উপজেলার ‘শনির হাওর’ নামে যে হাওরটির ফসল ঢলের পানি থেকে রক্ষা পেয়েছিলো, এখন সেটার ভেতরেও পানি ঢুকতে শুরু করেছে। রক্ষা পায়নি জামালগঞ্জ উপজেলার ‘পাকনার হাওরে’র বোরো ধান। পানিতে তলিয়ে গিয়েছে নেত্রকোণা, সিলেট, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ এবং মৌলভীবাজারের কিছু কিছু এলাকা। ফলে ঐ অঞ্চলের একমাত্র ফসল বোরো ধানের ক্ষেত বিনষ্ট হওয়ায় সেখানকার মানুষ হাহাকার করছেন। একইসাথে তারা আশঙ্কা করছেন দুর্ভিক্ষের। এমতাবস্থায় হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা এবং কৃষকদের জরুরি সহায়তা দেয়া জরুরি হয়ে পড়ছে।’

তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় এবং টানা বর্ষণের কারণে ধানের ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বেশিরভাগ পুকুরের মাছ ভেসে গিয়েছে। এখন মড়ক দেখা দিয়েছে মাছসহ জলজ প্রাণীর। মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দেশের বিভিন্ন এলাকায় বাঁধ ভেঙ্গে হাওর প্লাবিত হওয়ায় এখন পর্যন্ত এক হাজার ২৭৬ মেট্রিকটন মাছ বিনষ্ট হয়েছে এবং ৩ হাজার ৮৪৪ টি হাঁস মারা গিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে (্আমাদের সময়, ২৩ এপ্রিল ২০১৭)। তলিয়ে যাওয়া ধান গাছ পঁচে অ্যামোনিয়া গ্যাস সৃষ্টি হওয়ায় এবং ফসলে প্রয়োগ করা রাসায়নিক সার ও কীটনাশক পানিতে মিশে দূষিত হয়ে পড়েছে পানি, দেখা দিয়েছে অক্সিজেন স্বল্পতা। বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় এবং মানুষের স্বাস্থ্যহানির। কোনো কোনো এলাকায় হাঁসের মড়ক দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু এলাকায় সবজি ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় সেগুলো বন্ধ রয়েছে। উল্লেখ্য, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইউরেনিয়াম ও কয়লা খনির বর্জ্য ভাটির দিকে নেমে আসাকে পানি দুষণের কারণ কিনা এমন প্রশ্ন তুলেছেন। যদিও প্রাথমিক পরীক্ষায় এর প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’

সানজিদা হক বলেন, ‘এমতাবস্থায় সরকারের কর্তব্য হবে সুনামগঞ্জ-সহ পাহাড়ি ঢলে তলিয়ে যাওয়া অঞ্চলের বিপর্যয়টি আন্তরিকভাবে ও গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা এবং ঐ অঞ্চলের বিপদাপন্ন মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ গ্রহণ করা।’

তিনি বলেন, ‘সুজন’ জন-মানুষের এই ভাবনার সাথে সম্পূর্ণরূপে একমত। বোরো প্রধান হাওর এলাকার কৃষকদের বাঁচিয়ে রাখতে আমরা সুনির্দিষ্ট কিছু  প্রস্তাবনা আপনাদের সম্মুখে উপস্থাপন করতে চাই:

১.    দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২-এর ২২ ধারা অনুযায়ী, ‘রাষ্ট্রপতি, স্বীয় বিবেচনায় বা ক্ষেত্রমত, উপ-ধারা (৩) এর অধীন সুপারিশ প্রাপ্তির পর… দেশের কোন অঞ্চলে দুর্যোগের কোন ঘটনা ঘটিয়াছে যাহা মোকাবেলায় অতিরিক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা… আবশ্যক, তাহা হইলে… সংশ্লিষ্ট অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করিতে পারিবেন।’ উক্ত আইনের আলোকে ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকাসমূহকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা; ২. ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করে কৃষকদের জরুরি সহায়তা ও পুনর্বাসন প্রদান করা। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের কৃষকদের বাঁচাতে আগামী বৈশাখী ফসল তোলার আগ পর্যন্ত হাওরাঞ্চলে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি অব্যাহত রাখা; ৩. বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করা, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া এবং দুর্নীতির অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরৎ নিয়ে আসার পদক্ষেপ গ্রহণ করা; ৪. ফসল রক্ষা বাঁধগুলো জরুরি ভিত্তিতে মেরামত করা, হাওরাঞ্চলে ফসলরক্ষা বাঁধকে যুগোপযোগী করা, বাঁধের ডিজাইনে পরিবর্তন আনা এবং শুকনো মৌসুমে হাওর এলাকার নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওর খনন করাসহ স্থায়ী ও টেকসই সমাধান; ৫. কৃষকের পাশাপাশি মৎস্য আহরণ পেশায় জড়িতদের সুরক্ষার জন্য সরকারি পুনর্বাসনের আওতায় নিয়ে আসা; ৬. পাশাপাশি মৎস্যসম্পদ সুরক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপক প্রতিষেধকমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা; ৭. জরুরি ভিত্তিতে দুর্যোগ কাটাতে যথাযথ প্রক্রিয়ায় স্বল্পমূল্যে খোলাবাজারে খাদ্যদ্রব্য বিক্রির ব্যবস্থা করা।

সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, ‘হাওর এলাকার অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের তেমন কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সরকারের একজন সচিব বলেছেন, কোনো এলাকার অর্ধেক মানুষ মারা না গেলে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যাবে না, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’

সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘হাওর অঞ্চলের হাহাকারের কারণ যেমন প্রাকৃতিক, তেমন মনুষ্য সৃষ্টি। যাদের কারণে এ ঘটনা ঘটেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এত বিপর্যয় ও ক্ষয়-ক্ষতির পরেও কেন এ অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা হলো না তা আমার নিকট বোধগম্য নয়।’

জনাব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘হাওর এলাকা ডুবে গিয়েছে, আগামী বৈশাখের আগে ঐ এলাকা ভাসবে না। সুতরাং এই মৌসুমে আর ফসল ফলানোর সুযোগ নেই। কোনো সবজি ফলানোর সম্ভাবনাও নেই। সুতরাং এসকল এলাকায় খাদ্য সরবরাহে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে।’

সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘হাওরাঞ্চলের বিষয়টি একটি জাতীয় দুর্যোগ। এসকল এলাকার মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিলেই হবে না, তাদের ঋণও মওকুফ করতে হবে। বাঁধ নির্মাণে যে দুনীতি হয়েছে তা তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।’

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘হাওর এলাকার ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কতটা প্রকট ও তীব্র তা আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্য থেকেই অনুধাবন করতে পারি। তিনি বলেছেন, তিনি হাওরে এমন ক্ষয়ক্ষতি জীবনে দেখেননি। আমরা মনে করি, দ্রুত হাওর এলাকাসমূহকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা দরকার।’ তিনি বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম তদন্ত করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান।

ড. স্বপন আদনান বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকায় বর্তমানে খাবার ও পানির অভাব দেখা দিয়েছে। ভবিষ্যতে সেখানকার দুই কোটি মানুষ মানুষ যখন খাবার পাবে না তখন তারা জমি বিক্রি করতে শুরু করবে। এতে তারা ঘরবাড়ি হারিয়ে কোথায় যাবে?’ তিনি বর্তমান দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য সাধারণ জনগণকে নিয়ে দুর্যাগ মোকাবিলা কমিটি গঠনের আহ্বান জানান।

মূল প্রবন্ধ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

Related Post

সিটি করপোরেশন নির্বাচন: ২০০৮ ও ২০১৩ প্রার্থীদের তথ্যের তূলনামূলক বিশ্লেষণসিটি করপোরেশন নির্বাচন: ২০০৮ ও ২০১৩ প্রার্থীদের তথ্যের তূলনামূলক বিশ্লেষণ

আগামী ১৫ জুন ২০১৩ তারিখে বরিশাল, খুলনা, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। চারটি সিটি কর্পোরেশনে সর্বমোট ১২ জন মেয়র প্রার্থী, ১১৮ টি সাধারণ ওয়ার্ডে ৫৪৮ জন

“ভোটার তালিকা নিয়ে জটিলতা ও উত্তরণের পন্থা” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন“ভোটার তালিকা নিয়ে জটিলতা ও উত্তরণের পন্থা” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন

গত ০৭ ডিসেম্বর, ২০০৬ সকাল ১১টায় সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর আয়োজনে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি হল রুমে “ভোটার তালিকা নিয়ে জটিলতা ও উত্তরণের পন্থা” শীর্ষক একটি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সুজনের সভাপতি

“নবম জাতীয় সংসদের মহিলা আসন ও উপনির্বাচনে প্রার্থীদের তথ্য প্রকাশ” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত“নবম জাতীয় সংসদের মহিলা আসন ও উপনির্বাচনে প্রার্থীদের তথ্য প্রকাশ” শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত

গত ১৮ মার্চ রিপোর্টার্স ইউনিটির হল রুমে “নবম জাতীয় সংসদের মহিলা আসন ও উপনির্বাচনে প্রার্থীদের তথ্য প্রকাশ” শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে