বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার দীপ্ত শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে সফলভাবে সম্পন্ন হলো সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক-এর সপ্তম জাতীয় সম্মেলন-২০২০। আজ ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স-বাংলাদেশ-এর মাল্টিপারপাস হলরম্নমে (ঢাকা) অনুষ্ঠিত হয় এ সম্মেলন। সারা দেশ থেকে আগত ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের প্রায় এক হাজার সুজন নেতৃবৃন্দ এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন।
সকাল ১০.০০ জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের শুভ সূচনা হয়। অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন সুজন কেন্দ্রীয় সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান। সম্মেলনে অতিথি হিসেবে উপসি’ত ছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব আবু হেনা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির চেয়ারম্যান ড. রেহমান সোবহান, বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, গণসংহতি আন্দোলনের সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি প্রমুখ।
সুজন নেতৃবৃন্দের মধ্যে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সুজন নির্বাহী সদস্য আলী ইমাম মজুমদার, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, সহ-সম্পাদক জাকির হোসেন, সুজন জাতীয় কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর শিড়্গক রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখ উপসি’ত ছিলেন।
জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। শোক প্রসত্মাব পাঠ করেন সুজন-এর সহ-সমপাদক জনাব জাকির হোসেন। এই সময় পরলোকগত সুজন নেতৃবৃন্দের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
স্বাগত বক্তব্য দেন সুজন সভাপতি এম হাফিজউদ্দিন খান। তিনি বলেন, ‘আজকের বিরাজমান রাজনৈতিক প্রেড়্গাপটে সুজন-এর এই সম্মেলন অত্যনত্ম তাৎপর্যপূর্ণ। আজকে দেশের নির্বাচনী ব্যবস’া ভেঙে পড়েছে। অথচ গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের জন্য নির্বাচন অত্যনত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতেও সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা দেখি না। তাই দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণকে সোচ্চার করে তুলতে হবে।’
জনাব আবু হেনা বলেন, ‘সুজন গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য কাজ করছে। এজন্য সুজন অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।’ তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্র চলতে পারে যখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত হন। আর এই প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন নির্বাচনের মাধমে। তাই যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচিত করা গেলে গণতন্ত্র কাজ করতে পারে এবং সুশাসন বিরাজ করতে পারে।’
তিনি বলেন, বিগত সময়ে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও সুজন-সহ অন্যান্যদের ধারাবাহিক অ্যাডভোকেসির ফলে দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস’ায় বিভিন্ন সংস্কার সাধন করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য ছিল, নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সচিবালয়, আরপিও এবং আচরণবিধির সংশোধন, প্রার্থীদের তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা, ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও রাজনৈতিক দলের আয়-ব্যয়ের বিবরণ দেয়ার বিধান ইত্যাদি। কিন’ এতসব সংস্কারের পরও আজ আমরা কেন গণতন্ত্র ও সুশাসন নিয়ে চিনিত্মত?
তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, একটা দেশ তার মাটির জন্য বড় হয় না। দেশের মানুষ ভালো ও যোগ্য হলে দেশও ভালো ও যোগ্য হয়। তাই যতই আইন করা হোক না কেন, যদি সেগুলো কার্যকর করা না হয় এবং সমভাবে সবার জন্য বাসত্মবায়ন না হয়, তাহলে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না।’
ড. আকবর আলী খান বলেন, ‘সুজন-এর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের যোগাযোগ। আমি মনে করি, সুজন অত্যনত্ম ভালো কাজ করছে। তারা সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। সুজন সত্যিকার অর্থেই একটি সিভিল সমাজ। সুজন যেসব গবেষণামূলক কাজ করছে তার জন্য অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য।
তিনি বলেন, সিভিল সমাজকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে হবে। যদিও তারা সবসময় রাজনীতি এড়াতে পারে না। তবে স্বতন্ত্র থাকাই ভালো।’ তিনি আরও বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক সমস্যা রাতারাতি দূর হতে হবে না। কারণ রাজনৈতিকরা এই সমস্যা সৃষ্টি করেছেন, তারা এটি সহজে দূর করবেন বলে মনে হয় না। আমি মনে করি, ২০ দফার পরিবর্তে এখন একদফা দাবি তোলা দরকার, সেটা হলো সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা।’
সাংগঠনিক প্রতিবেদন উপস’াপনকালে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সুজন সচেতন নাগরিকদের উদ্যোগে গড়ে ওঠা একটি সংগঠন। ২০০২ সালে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীদের নির্বাচিত করার লড়্গ্য নিয়ে সংগঠনটি যাত্রা শুরম্ন করে। পরবর্তীতে দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলকে লড়্গ্য হিসেবে সুজন-এর লড়্গ্য নির্ধারণ করা হয়।’
তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুজন যেসব কাজ করছে তার মধ্যে অন্যতম হলো: ১. নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীদের নির্বাচিত করা; ২. রাজনৈতিক সংস্কার সংক্রানত্ম কার্যক্রম; ৩. বিভিন্ন নীতি-নির্ধারণী ও জনগুরম্নত্বপূর্ণ ইস্যুতে জনমত সৃষ্টি; ৪. নাগরিক অধিকার আদায়ে সোচ্চার করা; ইত্যাদি।
তিনি আরও বলেন, ‘শানিত্মপূর্ণভাবে ড়্গমতা বদলের হাতিয়ার হলো নির্বাচন। কিন’ আজকে দেশের নির্বাচনী ব্যবস’া ভেঙে পড়েছে। এজন্য আমাদের নির্বাচনী ব্যবস’াকে সঠিক পথে আনা ও গণতন্ত্রকে কার্যকর করার জন্য আমাদের কার্যক্রমকে আরও বেগবান করতে হবে।’
জনাব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে পরিচ্ছন্ন করার লড়্গ্যে সুজন নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো প্রার্থীদের হলফনামা জনগণের সামনে তুলে ধরা। সুজন-এর এই প্রচেষ্টাকে আমি স্বাগত জানাই।’
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘নাগরিকদের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিকদের সক্রিয় থাকতে হয়। এড়্গেত্রে সুজন অসাধারণ কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘দেশ আজ শুধু গণতন্ত্রহীনই নয়, বরং দেশে আজ এক নতুন রাষ্ট্র কাঠামো দাঁড় হয়েছে, যা কোনো তুলনা হয় না। আজকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে প্রতিনিয়ত নাগরিকদের অধিকার হরণ করা হচ্ছে। তাই আমাদেরকে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে হবে। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের আন্দোলনের মাধ্যমেই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান, ‘আজকে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙড়্গা ও মানুষের অধিকার প্রতিনিয়ত ভুলণ্ঠিত হচ্ছে। তাই আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বসত্মরে একটা আমুল সংস্কার দরকার।’
রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘তিনজোটের রূপরেখার মাধ্যমে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হয়। তখন রাজনৈতিক দলগুলো থেকে স্লোগন তোলা হয়, ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’। কিন’ সুজন স্লোগান তুলে, ‘আমার ভোট আমি দেব, জেনে, শুনে বুঝে দেব’। স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটার পরও আজও আমাদেরকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন পরিচালনা করছে এটা অত্যনত্ম দুঃখের বিষয়। আমি মনে করি, একটি সংস্কার প্রসত্মাব পাস হওয়া দরকার। কারণ আমরা গণতন্ত্রহীনতা, ভোটাধিকারহীনতা চাই না।’
প্রসঙ্গত, উদ্বোধনী অধিবেশনের পর কর্ম-অধিবেশন ও কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত। সবশেষে সুজন-এর নব-নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ও জাতীয় কমিটির সদস্যবৃন্দের পরিচিতির মাধ্যমে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।