‘নির্বাচন ও সংসদ বর্জন করা কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়’: ড. এটিএম শামসুল হুদা
‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে আজ ১০ নভেম্বর ২০১৮, শনিবার, সকাল: ১০.৩০টায় ‘জাতীয় নির্বাচনী অলিম্পিয়াড’-এর আয়োজন করা হয়। আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাব্রতী সংস্থা ‘দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’-এর সহযোগিতায় উক্ত অনুষ্ঠানটি সিরডাপ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স সেন্টার, চামেলী হাউস, ১৭, তোপখানা রোড, ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সুজন সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এটিএম শামসুল হুদা, সুজন নির্বাহী সদস্য ড. তোফায়েল আহমেদ, সুজন নির্বাহী সদস্য সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।
উল্লেখ্য, জাতীয় নির্বাচনী অলিম্পিয়াডের আগে সারাদেশের ৩০টি নির্বাচনী আসনে ২৯৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনী অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানগুলোতে প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। উক্ত নির্বাচনী অলিম্পিয়াডে বিজয়ী প্রথম তিনজনকে নিয়ে (মোট ৭৩) আজ অনুষ্ঠিত হলো জাতীয় নির্বাচনী অলিম্পিয়াড।
অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে সকাল ৯.০০টায় অনুষ্ঠিত হয় গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সুশাসন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় পর্বে সকাল ১০.৩০টায় অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা। এই পর্বে নির্বাচনী অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সুজন নেতৃবৃন্দ ও আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ।
রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়ার আগেই নির্বাচন কমিশন কেন তফসিল ঘোষণা করলো- এক শিক্ষার্থীর এমন প্রশ্নের জবাবে এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘২৮ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন করার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন আইনগতভাবে বাধ্য। কিন্তু সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য কমিশন চাইলে তফসিল ঘোষণা আরও পিছিয়ে দিতে পারতো। তাছাড়া ডিসেম্বর মাসে বিভিন্ন স্কুলের পরীক্ষা চলছে। আরেকটি বিষয় হলো- যদি ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে ২৮ জানুয়ারির আগে এক মাসের বেশি সময় মাস ধরে একসাথে দুটি সংসদ বহাল থাকবে। এটি দেশে সাধারণত দেখা যায় না।’
এই প্রসঙ্গে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য হুদা কমিশন দুই বার তফসিল ঘোষণা পিছিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়ার আগেই এই কমিশন কেন এত তাড়াহুড়ো করে তফসিল ঘোষণা করলো তা আমাদের বোধগম্য নয়।’
নির্বাচনে ইভিএম প্রসঙ্গে ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, ‘আমরা যখন কমিশনে ছিলাম, ভারত থেকে কিংবা বেসরকারি কোম্পানি থেকে আমরা ইভিএম মেশিন ক্রয় করিনি। বরং বুয়েট ও মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির মাধ্যমে আমরা ২৫০টি মেশিন তৈরি করেছিলাম। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল সেগুলো আমরা শুধু স্থানীয় নির্বাচনে ব্যবহার করবো। কিন্তু পরের কমিশন এসে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা বাদ দিল। কিন্তু এই কমিশন হঠাৎ করেই একটি বেসরকারি কোম্পানি থেকে ইভিএম ক্রয় করছে। প্রশ্ন হলো- কমিশন যদি সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন করতে চায়, তাহলে সবার ঐকমত্য ছাড়া কমিশন কেন ইভিএম ব্যবহার করতে চাচ্ছে এটি প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়।’ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের আগে বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার দরকার হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
যেহেতু সরকারের সাথে সমঝোতা হয়নি, তাই জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নিবে কিনা- এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, ‘নির্বাচন ও সংসদ বর্জন করা কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয় বলে আমি মনে করি। কারণ জনগণ ভোট দিয়ে যাদেরকে সংসদে পাঠায়, তারা যদি কথায় কথায় সংসদ বর্জন করেন, তাহলে জনগণকে ক্ষমতাহীন করা হয়, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমি মনে করি, কোনো বিষয়ে মত-দ্বিমত থাকতেই পারে, কিন্তু নির্বাচনী মাঠ বর্জন করা ঠিক নয়। তাছাড়া কোনো একটি দেশ যখন এগিয়ে যায়, তখন প্রথাগত রাস্তার আন্দোলন মানুষ মেনে নেয় না।’
অনুষ্ঠানের শেষভাগে ড. এটিএম শামসুল হুদা বলেন, ‘নির্বাচনের পর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে সাধারণত কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। আমি মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে যাতে গণতন্ত্রের চর্চা হয় সেজন্য পদক্ষেপ নেয়া দরকার। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের এক্ষেত্রে এখতিয়ার নেই। তাই একটি আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে দায়বদ্ধ করতে হবে।’
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক ও শাসনব্যবস্থায় যাতে ক্ষমতায় ভারসাম্য তৈরি হয় সেজন্য উদ্যোগ নেয়া দরকার। গণভোট ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে যাতে কেউ সংবিধানের মৌলিক কিছু বিষয় পরিবর্তন করতে না পারে সেজন্যও উদ্যোগ নেয়া দরকার।’ তত্ত¡বধায়ক সরকার বাতিল করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক পরিসর ও মূল্যবোধ সংকুচিত হয়, এমন কোনো বিষয়ে আদালতের হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়। আদালতের কাজ হলো দিক-নির্দেশনা দেয়া।’
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘আমরা আগে সেস্নাগান দিতাম, ‘আমার ভোট আমি দিব, যাকে খুশি তাকে দিব’। বর্তমানে এই সুযোগ আর নেই। কারণ আমরা অনেকেই পছন্দের প্রার্থী খুঁজে পাই। দেখা যায়, নির্বাচনে টাকার খেলার প্রভাবে ভালো প্রার্থীরা নির্বাচনী মাঠে থাকতে পারেন না।’ বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা, গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ রাখা এবং আন্তঃসম্পর্ক বৃদ্ধির জন্য স্থানীয় সরকারের জন্য একটি সমন্বিত আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করেন তিনি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন তৈরি করে সরকার আইনকে অস্ত্রে পরিণত করেছে। আমরা দেখেছি, বিগত সময়ে যতগুলো নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে, তার একটিও সুষ্ঠু হয়নি। এর মূল কারণ হলো প্রশাসনের ব্যাপক দলীয়করণ।’ আমরা মনে করি, একটি সাংবিধানিক কমিটি করে আমাদের নির্বাচনী পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা এবং আইন তৈরি করে নির্বাচন কমিশনে কমিশনার নিয়োগ করা দরকার।’ তিনি প্রার্থীদের যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য তরুণ ভোটারদের আহবান জানান।
অনুষ্ঠানের শেষভাগে ‘জাতীয় নির্বাচনী অলিম্পিয়াডে’ বিজয়ী দশজনের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়।