রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানের জন্য জাতীয় ঐক্য আজ একান্ত জরুরি_ এমনি মন্তব্য করেছেন ‘সুজন_সুশাসনের জন্য নাগরিক’ নেতৃবৃন্দ। আজ ১২ অক্টোবর ২০১৭, সকাল ১০.০০টায়, জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুজন আয়োজিত ‘রোহিঙ্গা সমস্যা: বর্তমান পরিস্থিতি ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে সুজন নেতৃবৃন্দ এই আহ্বান জানান।
বৈঠকতে সুজন সভাপতি জনাব এম হাফিজউদ্দিন খান, সুজন নির্বাহী সদস্য ড. হামিদা হোসেন ও সৈয়দ আবুল মকসুদ, জনাব আবুল হাসান চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রদূত জনাব মুন্সী ফয়েজ আহমেদ, জনাব এম আনোয়ারুল হক, ড. সি আর আবরার, জনাব এ এস এম আকরাম, জনাব রেহেনা সিদ্দীকী এবং সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার উপস্থিত ছিলেন। লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সুজন নির্বাহী সদস্য জনাব আলী ইমাম মজুমদার।
লিখিত বক্তব্যে জনাব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন নেত্রী অং সান সুচি বলেছিলেন, তার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে। কেন তারা দেশ ছেড়ে যাচ্ছে তাও খতিয়ে দেখা হবে। কিন্তু তাঁর এ ভাষণের পরও এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা এসেছে বাংলাদেশে। পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বেশ আগে। বক্তব্যের সারবত্তা থাকলে অন্তত তিনি দেশত্যাগ দ্রুত বন্ধ করে একটি আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হতেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করবো, বিভিন্ন দেশের যত স্বার্থই মিয়ানমারের থাকুক তারা হতভাগ্য রোহিঙ্গা নিধন বন্ধ ও তাদের দ্রুত ফিরিয়ে নেয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে কার্যকরী প্রভাব রাখতে পারে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের মান্যবর রাষ্ট্রদূত যখন কক্সবাজার থেকে অন্য কূটনীতিকদের সাথে সফর করে এসে বলেন এদেশে আসা রোহিঙ্গাদের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তাবু ও কম্বল, তখন আমরা সত্যিই ব্যথিত হই। প্রকৃতপক্ষে তাদের সর্বাগ্রে প্রয়োজন মিয়ানমারের নাগরিত্বের স্বীকৃতি ও স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের নিরাপদ ও সম্মানজনক ব্যবস্থা।’
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘এখনও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না শেষ পর্যন্ত কত রোহিঙ্গা এদেশে আসবে। তাই তাদের নিবন্ধন, আশ্রয় শিবির নির্মাণ, ত্রাণ কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিকরণ, পয়ঃনিষ্কাশন, পানি সরবরাহ ও চিকিৎসা ইত্যাদি শুরুতেই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়, যে সমস্যা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে।’
তিনি বলেন, ‘প্রশ্ন হচ্ছে যে, আমাদের জনবহুল দেশটি কি রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে নিয়ে নেবে? এরূপ ভাবনা একেবারেই অসঙ্গত। রোহিঙ্গাদের পক্ষে যে বিশ্ব জনমত তাকে কাজে লাগাতে আমাদের সক্রিয় ও বিরামহীন প্রচেষ্টা নিতে হবে। যারা মিয়ানমারকে এ নিধনযজ্ঞে সক্রিয় বা নিরবে সমর্থন করছে আমাদের প্রতিও তাদের দায়বদ্ধতা আছে। এটা কুটনৈতিক চ্যানেলে তুলে ধরতে হবে বারংবার। মিয়ানমার সরকারই গঠন করেছিল কফি আনান কমিশন। সে কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে।’
রোহিঙ্গাদের বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য জনাব আলী ইমাম মজুমদার কতগুলো বিষয় তুলে ধরেন:
ক) এত ব্যাপকসংখ্যক লোকের বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন। এটা যথেষ্ট সময় নেবে। দ্রুততার জন্যে অধিক জনবল ও যন্ত্রপাতি পাঠানোর ব্যবস্থা নিলে ভাল হয়; খ) নিরাপদে ঘুমানোর মত একটি জায়গা করে দিতে সময় লাগলেও এর বিকল্প নেই। তবে একটিমাত্র শিবিরে সকল আগত রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেবার ব্যবস্থাটি কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এতে ছোঁয়াচে রোগ দ্রুত বিস্তারের আশঙ্কা থাকে। উল্লেখ্য, আগের দুই দফায় ১৩ থেকে ১৫টি শিবিরে ভাগ করে রাখা হয়েছিল রোহিঙ্গাদের; গ) মিয়ানমারে বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নিম্নমানের। আগত রোহিঙ্গাদের মাঝে অনেকে ছোঁয়াচে রোগে আক্রান্ত। জটিল রোগ ব্যাধিও রয়েছে অনেকের। এদের নিবারণমূলক টিকা, ইনজেশন দেয়া এবং রোগাক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও চালিয়ে রাখতে হবে। এটি যাতে ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য আবশ্যক সতর্কতা; ঘ) কয়েক হাজার শিশু-কিশোর পিতৃ-মাতৃহীনভাবে এদেশে আশ্রয় নিয়েছে বলে জানা যায়। তাদের দেখভালের জন্যে একটি ভিন্নতর ব্যবস্থাপনা না থাকলে সুযোগ সন্ধানীরা বিপথে পরিচালনা করতে সচেষ্ট হবে। আগত অসংখ্য নারী ও শিশুর নিখোঁজ হওয়া এবং পাচারকারীদের তৎপরতার খবর ইতিমধ্যেই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে; ঙ) প্রচুর অন্তঃসত্ত্বা নারী এসেছে আশ্রয়ের সন্ধানে। তাদের অনেকের স্বামী নিহত বা নিখোঁজ। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের নিরাপদ সন্তান প্রসব ও সম্ভাব্য সেবা যতœ অগ্রাধিকারে রাখা দরকার; চ) অনেক আহত ও রোগাক্রান্ত রোহিঙ্গার চিকিৎসা চলছে। সেটা চলমান ও জোরদার করা দরকার; ছ) রেশন ব্যবস্থা চালুর জন্যে নিবন্ধন অত্যাবশক হলেও অন্তর্বর্তীকালীন কোন ব্যবস্থায় তা চলছে তা আমরা অবগত নই। রান্নার জ্বালানি সরবরাহ করা না হলে বন-বাদাড় উজাড় হয়ে যাবে। পুষ্টিহীনতা তাদের একটি বড় সমস্যা। এটা মোকাবিলা করতে বিশ্ব খাদ্য সংস্থা ও রেড ক্রিসেন্ট-এর পক্ষ থেকে পদক্ষেপ জোরদার করা আবশ্যক; জ) শিবিরবাসীরা বন্দী না হলেও ভিন দেশের নাগরিক। মর্যাদা ও দরদের সাথে রাখা হয়েছে তাদের। তবে দেয়া যাবে না ছড়িয়ে পড়তে। এরজন্যে একাধিক স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা দরকার; ঝ)কোনো অবস্থাতেই যাতে এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসমূলক কোনো কাজ কিংবা চোরাচালানির সাথে যুক্ত হতে না পারে তার জন্যে নিবিড় নজরদারির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে আমাদের এ প্রিয় দেশটির এ সুন্দর অঞ্চলটি যেন সন্ত্রাসী অধ্যুষিত বলে আখ্যায়িত না হয়। ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়; ঞ) অন্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোকজনের নিরাপত্তা যাতে কোনো অবস্থাতেই রোহিঙ্গাদের দ্বারা বিঘিœত না হয় সেদিকে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের খুব কাছাকাছি শিবিরের অবস্থান। সেটি আমাদের জন্যে একটি স্পর্শকাতর অঞ্চল। রোহিঙ্গারা কোনো অবস্থাতেই যাতে সে অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে না পারে তা নিশ্চিত করা আবশ্যক।
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট জাতীয় জীবনে এক বড় বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। এটি আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। ১৯৭৮ সালে থেকে এ সমস্যার শুরু। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে আমাদের দেশের সরকার এর ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র। কিন্তু এই দেশটির সাথে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আজও তৈরি হলো না কেন তা আমাদের বোধগম্য নয়।’ তিনি আরো বলেন, আমরা এ সমস্যার সমাধান চাই। শরণার্থীদের তারা তাদের দেশে ফেরৎ নিয়ে যাক।’
সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বাংলাদেশের পক্ষে প্রায় দশ লক্ষ শরণার্থীর চাপ সহ্য করা দুরূহ হবে। এছাড়াও রোহিঙ্গা ইস্যু ভয়াবহ নিরাপত্তাজনিত সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এ বিরাট উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় আবদ্ধ করে রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। ফলে তারা জীবন-জীবিকা নির্বাহের প্রচেষ্টায় স্থানীয়দের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, এমনকি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে পারে। উপরন্তু বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারে। সবচেয়ে শঙ্কার বিষয় হলো যে, চরমভাবে নিগৃহীত ও ক্ষুব্ধ এ জনগোষ্ঠীকে স্বার্থান্বেষী মহল উগ্রবাদের পথে প্ররোচিত করতে পারে, যা শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো রিজিয়নকেই অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।’
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন যাবৎ বঞ্চিত, নিগৃহীত।এ সংকটের আশু সমাধান প্রয়োজন। ৭১’ এর পরে এ ধরনের জাতীয় দুর্যোগ আর আসেনি। এ সংকটের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব রয়েছে ।’
ড. হামিদা হোসেন বলেন, ‘আমাদের উচিৎ কফি আনান কমিশনের প্রতিবেদনটি নিয়ে কাজ শুরু করা। তিনি বলেন, সরকারকে বেসরকারী সংগঠন, সাধারণ জনগণ সকলকে নিয়ে এ সংকট সমাধানে কাজ করতে হবে। আর তা না হলে এ সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করবে।’
মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘এ সংকটের ২টি দিক রয়েছে, একটি দিক হলো এতো লোক আশ্রয়হীন হয়ে আমাদের দেশে এসে পড়েছে, তাদের দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। অপরদিকটি হলো এসকল মানুষকে তাদের দেশে ফেরৎ পাঠাতে হবে। তিনি বলেন, একটি বিশাল জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার ও রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হয়েছে, যা অকল্পনীয় ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। এ ব্যর্থতা শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের।’
সমগ্র জাতি ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ সংকটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে উল্লেখ করে ড. সি আর আবরার বলেন, ‘কিভাবে যে তারা দিনাতিপাত করছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। শিশুগুলো এতিমের মতো ঘুরে বেরাচ্ছে। গর্ভবতী নারীদের অবস্থাও শোচনীয়। তিনি বলেন, আমার মনে হয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভাজন করার দরকার নেই, তারা সকলেই শরনার্থী। শুধুমাত্র যারা শেষে এসেছে তাদের দিকে বিশেষ দৃষ্টি প্রদান জরুরি। তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে অবশ্যই ফেরত পাঠাতে হবে এবং এ জন্য আমাদের চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে।’
আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, ‘মিয়ানমারের সেনাবহিনী কর্তৃক রাখাইনে যে সহিংসতা ও সন্ত্রাস চালানো হয়েছে তা ভিন্ন মাত্রার। গণমাধ্যমের কারণে আজ এ ঘটনা সকলেই অবগত। এ ঘটনা হিচলারের নাৎসী বাহিনীকেও হার মানিয়েছে। মিয়ানমার পূবপরিকল্পিতভাবে দীর্ঘদিন চিন্তা করে এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
মূল প্রবন্ধ পড়তে এখানে ক্লিক করুন