বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ২৬-০৯-২০১২
১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া বিভক্ত রায়টি বিতর্কিত। আমাদের আশঙ্কা যে এটি আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি জাতিকে চরম বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এ প্রসঙ্গে একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ টানা যেতে পারে।
আমেরিকার গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে ‘ড্রেড স্কট বনাম স্যানডফোর্ড’ মামলায় ১৮৫৭ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন যে আফ্রিকান-আমেরিকানরা (যাদের তখন নিগ্রো বলে আখ্যায়িত করা হতো) যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নয়। তাদের আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার নেই, এমনকি মার্কিন কংগ্রেসের ক্রীতদাস প্রথা বাতিল করারও এখতিয়ার নেই। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রজার ব্রুক টেনির নেতৃত্বে সাত-দুই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রদত্ত রায়কে ‘ড্রেড স্কট ডিসিশন’ বলে বহুল পরিচিত এবং মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে সর্বাধিক ধিক্কৃত সিদ্ধান্ত বলে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন এটিকে ‘এরোনিয়াস’ বা ভুল রায় বলে আখ্যায়িত করেছেন। বস্তুত, জাতির বিবেককে আঘাত হানা এ রায় দানের সময়কালকে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাসে একটি অতি কলঙ্কজনক অধ্যায় বলে মনে করা হয়। প্রসঙ্গত, বিচারপতি খায়রুল হকের রায়েই ড্রেড স্কট বনাম স্যানডফোর্ড মামলার রায়সহ আরও অনেক ধিক্কৃত বিচারিক সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ আছে।
ইতিহাসবিদদের মতে, মার্কিন উচ্চ আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকেরা মনে করেছিলেন যে এ রায়ের মাধ্যমে তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিরাজমান বর্ণবাদের সমস্যার সমাধান করেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত রায়ের ফল হয়েছে উল্টো। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, এ রায়ের কারণে সারা দেশে যে ক্ষোভ-বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল মার্কিন গৃহযুদ্ধ।
আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকও সমপ্রতি দৈনিক মানবজমিনকে (১৮ সেপ্টেম্বর ২০১২) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন যে তাঁর লেখা রায়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে অমীমাংসিত মতবিরোধ রয়েছে, তার সমাধান নিহিত আছে এবং এতে সংকটও কেটে যাবে। আমাদের মতে, তাঁর এ দাবি সঠিক নয়। বরং এটি জাতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে, যদি না রাজনীতিবিদেরা প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে এ ব্যাপারে একটি সমঝোতায় পৌঁছান।
কেন সংখ্যাগরিষ্ঠের দেওয়া রায়টি প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত? বিতর্কের অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, ত্রয়োদশ সংশোধনীটি ছিল ষষ্ঠ সংসদে পাস করা একটি আইন, যদিও সে সংসদই ছিল একদলীয় ও বিতর্কিত। তৎকালীন বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে এটি পাস করা হয়। এটি দলমত-নির্বিশেষে সবাই গ্রহণ করেছিলেন এবং সারা দেশে এ নিয়ে মতৈক্যও সৃষ্টি হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, ত্রয়োদশ সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট বিভাগে অতীতে আরও দুটি মামলা হয়। সাঈদ মশিউর রহমান বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে বিচারপতি মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি এম এ মতিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বৈধ বলে ঘোষণা দেন [১৭ বিএলডি (এইচসিডি) (১৯৯৭)]। দ্বিতীয় মামলায় (এম সালিম উল্লা বনাম বাংলাদেশ) হাইকোর্ট বিভাগের একটি বৃহত্তর বেঞ্চের তিন বিচারক—বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীন, বিচারপতি মো. আওলাদ আলী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার—২০০৪ সালে পৃথক পৃথক রায়ে [৫৭ ডিএলআর (২০০৫)] ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বলে মতামত দেন।
বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার তাঁর রায়ে বলেন যে গণতন্ত্র আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। আর ত্রয়োদশ সংশোধনী অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাকে উন্নত করেছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ হাইকোর্টের দু-দুটি বেঞ্চের পাঁচজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে সাংবিধানিকভাবে বৈধ বলে রায় দিয়েছেন।
এরপর ১৬ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি আবদুল ওহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাও রায় দেন যে তাঁদের মতে, ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ বা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় এবং এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকেও ধ্বংস করে না। আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলীও তাঁর পৃথক রায়ে একই মত প্রকাশ করেন, যদিও তিনি বলেন যে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার অপপ্রয়োগের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তিনি এ ব্যবস্থাটি পরিবর্তনের দায়িত্ব জনপ্রতিনিধিদের ওপর ছেড়ে দেন। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে ‘নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ হিসেবে নামকরণেরও সুপারিশ করেন।
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের উপরিউক্ত তিনটি রায় থেকে দেখা যায়, যে ১২ জন বিচারপতি এ রায়গুলো দিয়েছেন, তাঁদের আটজনই (হাইকোর্ট বিভাগের পাঁচজন ও আপিল বিভাগের তিনজন) নির্বাচনকালীন একটি নির্দলীয় সরকারের পক্ষে। অর্থাৎ উচ্চ আদালতের বিচারকদের মধ্যেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রবল মতানৈক্য রয়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষেরই পাল্লা ভারী। তবু আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ, অর্থাৎ চারজনের রায়ই চূড়ান্ত এবং সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিকের জন্য এটি মানা বাধ্যতামূলক। কিন্তু প্রশ্ন হলো: রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, নাগরিকেরা মেনে নিলেও মনে নিবে কি না!
তৃতীয়ত, টি এইচ খান, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ড. এম জহির, মাহমুদুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি—এই আটজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আপিল বিভাগের সামনে ‘অ্যামিকাস কিউরি’ হিসেবে বক্তব্য দেন। আজমালুল হোসেন কিউসি ব্যতীত এঁদের সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি, রাষ্ট্রের কৌঁসুলি হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেলও একই অবস্থান নেন। অর্থাৎ আমাদের বার ও বেঞ্চের অধিকাংশই তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে।
চতুর্থত, স্মরণ করা যেতে পারে যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের জুলাই মাসে সংসদ উপনেতা বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়, যাতে বিএনপি অংশ নেয়নি। কমিটি তিনজন সাবেক প্রধান বিচারপতি, ১১ জন শীর্ষ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ১৮ জন বুদ্ধিজীবী, ১৮টি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক বা জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক, কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের নেতাদের মতামত নেয়। বিশেষজ্ঞ এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের প্রায় সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেন, কেউই এর বিরোধিতা করেননি। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও কমিটির কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করেনি।
শুধু বিশেষজ্ঞ মতামতই নয়, সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী সংযোজনের পরও সাধারণ নাগরিকদের অধিকাংশই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অব্যাহত রাখার পক্ষে। উদাহরণস্বরূপ, গত ১৮ মে ২০১২ প্রথম আলো পরিচালিত জরিপে ‘তত্ত্বাবধায়করূপী দানব আর মানুষ দেখতে চায় না—প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে আপনি কি একমত?’ প্রশ্নের উত্তরে ছয় হাজার ৪৯৩ জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৮৬ দশমিক ৪২ শতাংশই ‘না’ উত্তর দেন। ‘হ্যাঁ’ উত্তর দিয়েছেন মাত্র ১২ দশমিক ৮৮ শতাংশ। আরও সম্প্রতি প্রথম আলো পরিচালিত জরিপে, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ায় রাজনৈতিক সংকট গভীর হবে মনে করেন কি?’ এ প্রশ্নের দুই হাজার ৭২৪ জন উত্তরদাতার মধ্যে ৮৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ এবং ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ ‘না’ উত্তর দেন (১৭ সেপ্টেম্বর ২০১২)। অনলাইন জরিপের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এর থেকে জনমত সম্পর্কে একটি তথ্যভিত্তিক ধারণা পাওয়া যায়।
ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হলেও রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার খাতিরে সংসদ ইচ্ছা করলে পরবর্তী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে উল্লেখ আছে। কিন্তু মাননীয় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সমাপ্ত সংসদ অধিবেশনের সমাপ্তি পর্বে ঘোষণা দিয়েছেন যে নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হলেও দলীয় সরকারের অধীনেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ব্যক্তিদের মতামত উপেক্ষা করে সরকারি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ছাড়াই নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর।
এটা সুস্পষ্ট যে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া রায়টিতে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ ও উচ্চ আদালতের অধিকাংশ বিচারকের মতামত উপেক্ষিত হয়েছে। উপেক্ষা করা হয়েছে জনমতও। প্রসঙ্গত, শ্রদ্ধেয় এবিএম মূসা সম্প্রতি লিখেছেন, অন্ধ আইনের দোহাই দেওয়া বিচারক তো অন্ধ হতে পারেন না (প্রথম আলো, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২)। এ ধরনের বিচারিক অবিমৃষ্যকারিতা জাতিকে ভবিষ্যতে চরম বিপদের দিকে ঠেলে দিতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা। বিরোধীদলীয় নেতা ইতিমধ্যেই রায়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন, আগামী নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে তা প্রতিহত করারও ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন করার পক্ষে দৃঢ় অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। নিঃসন্দেহে দুই দলীয় প্রধানের এমন বিপরীতমুখী অবস্থান জাতির জন্য এক অশনিসংকেত।
বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক।
সূত্র: প্রথম আলো, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১২