‘স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের নির্বাচন রাজনৈতিক দলভিত্তিক হওয়া উচিত নয়। রাজনৈতিক দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচন বিরাজমান দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির নেতিবাচক প্রভাবকে গ্রামাঞ্চল তথা ঘরে ঘরে বিস্তৃত করবে’ _ এমনি বক্তব্য তুলে ধরা হয় সুজন কর্তৃক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে। আজ ২ মার্চ ২০১৬ সকাল ১১.০০টায়, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সুজনÑসুশাসনের জন্য নাগরিক আয়োজিত সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বানে এক সংবাদ সম্মেলনে সুজন নেৃতৃবৃন্দ এ মন্তব্য করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খান, সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এবং সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার প্রমুখ।
লিখিত বক্তব্যে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, “আগামী ২২ মার্চ ২০১৬ থেকে ৪ জুন ২০১৬ পর্যন্ত সারাদেশের ৪,২৭৫টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে (শুধুমাত্র চেয়ারম্যান পদে) অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলসমূহ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। তাই দেশবাসীর বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে এই নির্বাচনকে ঘিরে। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পূর্বেই এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমরা সুজন-এর পক্ষ থেকে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ধাপের ৭৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন মোট ৩,৫৬৮ জন। এর মধ্যে ১৬টি রাজনৈতিক দলের ১,৯০০ এবং স্বতন্ত্র ১,৬৬৮ জন। ৭৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ৭৪১ জন প্রার্থী। খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার যোগীপল, কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর উপজেলার আমবাড়ীয়া এবং কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের জন্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দু জন করে চেয়ারম্যান প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইতোমধ্যেই সেসকল অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে মনোনয়ন বাণিজ্য; মনোনয়নপত্র দাখিলে বাধা দান ও ছিনিয়ে নেয়া; যাচাই-বাছাইয়ের সময় প্রভাবিত হয়ে বা অর্থের বিনিময়ে প্রার্থীতা বাতিল বা প্রার্থিতা বৈধকরণ; নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করা বা প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য প্রার্থীকে ভয়-ভীতি প্রদর্শন ও মারধর করা, দৃশ্যমান অনিয়ম এমনকি অভিযোগ দায়েরের পরেও নির্বচন কমিশন কর্তৃক ব্যবস্থা না নেয়া; এক ইউনিয়নে একটি রাজনৈতিক দল থেকে একাধিক প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করলেও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী সবগুলো বাতিল না হওয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘এছাড়াও নির্বাচনের তারিখ বেশ দূরে থাকলেও এখন থেকেই সংঘর্ষ শুরু হওয়া; ২৫টি ইউনিয়নে শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের এককভাবে মনোনয়নপত্র দাখিল; অনেক ইউনিয়নে বিএনপি থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রার্থী পাওয়া না যাওয়া; ১১৪টি ইউনিয়নে বিএনপি’র প্রার্থী না থাকা, অতীতের তুলনায় প্রার্থী সংখ্যা হ্রাস পাওয়া; দক্ষ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীর পরিবর্তে অনেক ইউনিয়নেই রাজনৈতিক দল থেকে অযোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রদানের অভিযোগ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে আমরা নেতিবাচক বলে মনে করছি। ৭৩৮টি ইউনিয়নের মধ্যে মাত্র ১২ জন নারীর (৬ জন আওয়ামী লীগ ও ৬ জন বিএনপি থেকে) চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নকেও আমরা উদ্বেগের বিষয় বলে মনে করছি।’
দিলীপ কুমার সরকার বলেন, ‘সুজন-এর পক্ষ থেকে আমরা চাই, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও অর্থবহ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন যথাযথ ভূমিকা পালন করুক। এক্ষেত্রে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীসহ নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলেই যাতে নির্বাচনী আচরণবিধি যথাযথভাবে মেনে চলেন, সে ব্যাপারে নির্বাচন পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিরপেক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। পাশাপাশি সকল দল ও প্রার্থীর জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করতে হবে। কালোটাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। কেউ নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করলে তাৎক্ষণিকভাবে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘২০১৩ সালের পর এ নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। সরকার থেকে নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করা হচ্ছে না। মানসম্মত নির্বাচন না হওয়ায় প্রার্থীদের নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা নেই। তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। তাই সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করার সুযোগ দিতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সুজন-এর পক্ষ থেকে বলেছি যে, দলভিত্তিক স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ফলাফল শুভ হয় না। আমরা বিগত পৌর নির্বাচনে সেটিই লক্ষ করেছি।’ তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত যুক্তিযুক্ত হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হলফনামা প্রদানের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা কয়েকজন মিলে হাইকোর্টে এ বিষয়ে মামলা করেছিলাম। যেদিন এ মামলার রায় হওয়ার কথা সেদিন সিনিয়র জাজকে আপিল বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়, যার ফলে রায় হয়নি। গত কয়েক বছর ধরে আমরা চেষ্টা করেও এ সংক্রান্ত শুনানি করাতে পারিনি। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর আমরা এ বিষয়ে আবারো উদ্যোগ নিবো।’ তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার জনগণের দোরগোড়ার সরকার। আর তাই এ নির্বাচনে যদি সৎ ও যোগ্য লোক নির্বাচিত হয়ে না আসে, তাহলে তা আপামর জনগণের জন্য কখনোই কল্যাণ বয়ে আনবে না।’ সংবিধানের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রজাতন্ত্র হবে গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন দরকার। আর নির্বাচন হতে হবে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য।’ ড. মজুমদার আরও বলেন, ‘এবারে নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা গড়ে ৪.৮২%। অথচ গতবার ইউপি নির্বাচনে চূড়ান্ত প্রার্থী ছিল ছয়ের মত। অর্থাৎ এ নির্বাচনে প্রার্থী সংখ্যা গতবারের তুলনায় কমে গেছে, যা শুভ লক্ষণ নয়।’
মূল প্রবন্ধ পড়তে ক্লিক করুন