বদিউল আলম মজুমদার
পূর্বঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন চারটি সিটি করপোরেশন ও নয়টি পৌরসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এগুলোই প্রথম নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো সংসদ নির্বাচনের দাবিতে অত্যন্ত সোচ্চার হলেও তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের প্রবল বিরোধী। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে এবং বিএনপি এসব নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় নির্বাচনের এমন বিরোধিতা কি যুক্তিযুক্ত?
আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র, যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকিবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হইবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিবে।’ গণতন্ত্র মানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে প্রশাসনের সব স্তরে জনগণের শাসন, শুধু নির্বাচিত সংসদ নয়। বস্তুত জাতীয় সংসদ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপরিকাঠামো, যদিও রাজনীতিবিদেরা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে নির্বাচিত সংসদই গণতন্ত্র। নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ−জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ এবং সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা−এ উপরিকাঠামোর খুঁটিস্বরূপ। এসব খুঁটি গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। আর মেরুদণ্ডহীন ‘আংশিক’ গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য, যা ঘটেছিল ১১ জানুয়ারি ২০০৭ তারিখে। তাই মেরুদণ্ডসম্পন্ন ‘পূর্ণাঙ্গ’ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া জনগণের দোরগোড়ার সরকার হিসেবে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই শাসন-প্রক্রিয়ায় তাঁদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়, তাঁরা ক্ষমতায়িত হন এবং স্বশাসন প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। এর মাধ্যমে ‘প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র’ ও ‘অংশগ্রহনমূলক গণতন্ত্রে’ উত্তোরনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। উপরন্তু শক্তিশালী স্থানীয় সরকার স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ভারসাম্যের মাধ্যম হিসেবেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, আমাদের মতো ‘এককেন্দ্রিক’ শাসনব্যবস্থায় যা অনেকটা দুর্বল।
আমাদের সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ এমনই একটি পূর্ণাঙ্গ ও গণসম্পৃক্তভিত্তিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা প্রদান করেছে। এতে বলা হয়েছে: ‘(১) আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের (administrative unit) স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে। (২) এই সংবিধান ও অন্য কোন আইন-সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করিবেন, এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লেখিত অনুরূপ প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক একাংশের মধ্যে সেইরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন এবং অনুরূপ আইনে নিম্নলিখিত বিষয় সংক্রান্ত দায়িত্ব অন্তর্ভুক্ত হইতে পারিবে: (ক) প্রশাসন ও সরকারী কর্মচারিদের কার্য; (খ) জনশৃংখলা রক্ষা; (গ) জনসাধারণের কার্য (public services) ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।’ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ থেকে এটি সুস্পষ্ট যে রাষ্ট্রে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হলে ‘স্থানীয় শাসনের ভার’ গ্রহণ করার জন্য সব স্তরে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হবে ন্যূনপক্ষে প্রশাসন ও সরকারি কর্মচারীদের কার্যপরিচালনা, জনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, জনস্বার্থে গৃহীত সরকারি সেবা বিতরণ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে অতীতে প্রশাসনের সব স্তরে কার্যকর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে না তোলার ফলে শুধু সংবিধানই লঙ্ঘিত হয়নি, উপরিউক্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমগুলোও উপেক্ষিত হয়েছে। এর ফলেই আমাদের মাঠপর্যায়ের প্রশাসনে এবং তৃণমূলের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপক স্থবিরতা সৃষ্টি হয়েছে।
অতীতে আমাদের নির্বাচিত সরকারগুলো নির্বাচিত জেলা ও উপজেলা পরিষদ গঠন না করে শুধু সংবিধানই উপেক্ষা করেনি, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ অমান্য করেছে। উপজেলা প্রথা বাতিলের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ১৯৯২ সালে সব প্রশাসনিক স্তরে অনধিক ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনির্বাচিত ব্যক্তিদের পরিবর্তে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন। [‘The existing local bodies are … required to be brought in line with Article 59 by replacing the non-elected persons by election … Necessary action in this respect should be taken as soon as possible?in any case within a period not exceeding six months from date. 44DLR(AD) (1992)?]। কিন্তু গত ১৬ বছরেও এই রায় বাস্তবায়িত হয়নি, যা আদালত অবমাননার সমতুল্য।
আমাদের অতীতের সরকারগুলো সংবিধান লঙ্ঘন এবং আদালতের নির্দেশ অমান্য করেই ক্ষান্ত হয়নি, তারা নিজেদের সুস্পষ্ট নির্বাচনী ইশতেহারও ভঙ্গ করেছে। যেমন, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল তার নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দেয়: ‘বিএনপি প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ এবং প্রশাসনের সকল পর্যায় ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে নিশ্চিত করার নীতিতে বিশ্বাসী। এ নীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আমরা ঘোষণা করছি যে−প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে উপজেলা পরিষদ এবং জেলা পরিষদ গঠন এবং পরিকল্পিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেগুলিকে সকল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। ইউনিয়ন পরিষদসমূহের অধিকতর কর্মক্ষম, গতিশীল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থানীয় সংস্থার পর্যায়ে উন্নীত করার বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ জোট সরকারের আমলে উপজেলা ও জেলা পরিষদের নির্বাচন তো করা হয়ইনি, বরং ১৩০ বছরের অধিককালের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদকে প্রায় পুরোপুরি অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। এটি করা হয়েছে মাননীয় সংসদ সদস্যদের অযাচিত হস্তক্ষেপ এবং গ্রাম সরকারের মতো একটি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান সৃষ্টির মাধ্যমে, যা পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট সংবিধান-পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেছেন।
সংবিধান লঙ্ঘন, আদালতের নির্দেশ অমান্য এবং নিজেদের নির্বাচনী ওয়াদা ভঙ্গ−এ সবই করা হয়েছে মাননীয় সংসদ সদস্যদের অযাচিত ও অনৈতিক চাপের কারণে। কারণ তাঁরা ‘আইন প্রণয়নের’ সাংবিধানিক দায়িত্ব (অনুচ্ছেদ-৬৫) পালনের পরিবর্তে আইনগত কোনো বৈধতা ছাড়াই স্থানীয় উন্নয়নের কাজে বেশি আগ্রহী ছিলেন এবং এ কাজে তাঁরা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দেখতে চাননি। তাই তাঁরা জেলা ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রতিহত করেছেন। ফলে নিজ নির্বাচনী এলাকায় তাঁদের, বিশেষত সরকারি দলের সংসদ সদস্যদের এক ধরনের ‘জমিদারিত্ব’ সৃষ্টি হয়, যার পরিণতি ছিল সীমাহীন দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, টেন্ডারবাজি, দখলদারি প্রভৃতি। মাননীয় সংসদ সদস্যদের অনেকের এ ধরনের যথেচ্ছাচারের পরিণতিই ১১ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখের ঘটনাবলি। নির্বাচিত জেলা ও উপজেলা পরিষদ থাকলে এবং সব স্তরে কার্যকর স্থানীয় সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসই হয়তো ভিন্ন হতো এবং সাম্প্রতিক সময়কার দুঃখজনক ঘটনাবলি এড়ানো যেত বলেই আমাদের বিশ্বাস। কিছু স্বার্থান্বেষী আইনপ্রণেতার খোলসে আইন ভঙ্গকারীর ‘পাপের’ মাশুল আজ শুধু তাদের নিজেদেরই দিতে হচ্ছে না, পুরো জাতিকেই তার ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে। কায়েমি স্বার্থের বাড়াবাড়ির জন্যই আমাদের এখন জরুরি অবস্থার মধ্যে বসবাস এবং মৌলিক অধিকার জলাঞ্জলি দিতে হচ্ছে।
নির্বাচনের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একটি যুক্তি হলো, এটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ প্রসঙ্গে তারা সংবিধানের ৫৮(ঘ)-এর উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। এ অনুচ্ছেদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নীতিনির্ধারণী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার এবং শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে প্রয়োজনীয় সব সাহায্য ও সহায়তা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৫৮(ঘ) থেকে সুস্পষ্ট যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নয়।
বস্তুত সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ নির্বাচন কমিশনকে চারটি সুস্পষ্ট দায়িত্ব প্রদান করেছে: রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান, সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ এবং ভোটার তালিকা প্রণয়ন। এ ছাড়া ওই অনুচ্ছেদে কমিশনকে আইনানুগভাবে প্রদত্ত অন্য যেকোনো দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা রয়েছে। অতীতে সরকার কর্তৃক আইনানুগভাবে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন পরিচালনা করেছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারও আইনানুগভাবে নির্বাচন কমিশনকে সেই ক্ষমতা দিয়েছে। তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানও কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্বে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠান একটি রুটিন দায়িত্ব, যা নীতিনির্ধারণী কাজের পর্যায়ে পড়ে না।
রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধিতার অবশ্য দুটো সংগত কারণ রয়েছে। এগুলো হলো: আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত এবং এর মাধ্যমে কিংস পার্টি গঠনের প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হতে পারে। নাগরিক হিসেবে এ আশঙ্কাগুলো আমাদেরও। তবে আমরা মনে করি যে এগুলো অমূলক।
আমাদেরও সুস্পষ্ট দাবি যে রোডম্যাপ অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই ডিসেম্বরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হতে হবে। সরকার ও নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছে। যেহেতু সব নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, কখন কোন নির্বাচন করা হবে সে সিদ্ধান্ত আমরা কমিশনের ওপর ছেড়ে দিতে চাই। কমিশন যদি সংসদ নির্বাচনের সময়সীমা ব্যাহত না করে এর আগে স্থানীয় নির্বাচন করতে পারে, তাতে আপত্তি থাকার কথা নয়। এ ছাড়া প্রস্তুতির দিক থেকে স্থানীয় নির্বাচনও জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলেই আমরা মনে করি।
গত কয়েক বছরের দুঃখজনক অভিজ্ঞতার পর পাতানো নির্বাচনের কথা ভাবতেও কষ্ট হয়। তবু কারও যদি এমন কোনো দুরভিসন্ধি থাকেও, তা থেকে তাদের বিরত থাকায় আমরা অনুরোধ জানাই। কারণ পাতানো নির্বাচন আমাদের বিরাজমান সমস্যা সমাধান না করে তাকে আরও প্রকট করে তুলবে, এমনকি জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবে চারটি সিটি করপোরেশন ও নয়টি পৌর নির্বাচনকে আমরা পরীক্ষা(টেস্ট কেস) হিসেবে দেখতে পারি। এ কটি নির্বাচন থেকেই সুস্পষ্ট হবে নির্বাচন কমিশন ও সরকার প্রশ্নাতীত নিরপেক্ষতা প্রদর্শন করছে কি না। এছাড়াও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে দলীয় সরকারের নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে ব্যর্থতার কারণেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সৃষ্টি হয়েছিল।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, জাতীয় নির্বাচনের পর তারা ক্ষমতায় গিয়ে স্থানীয় নির্বাচন করবে। অতীতে তারা কথা রাখেনি, তাই তাদের কথার ওপর আস্থা রাখা দুরূহ। একটি শক্তিশালী কায়েমি স্বার্থ অতীতে উপজেলা ও জেলা পরিষদের নির্বাচনকে ভণ্ডুল করেছে, ভবিষ্যতেও তা করার চেষ্টা করবে। এ ছাড়া অতীতে তারা স্থানীয় সরকারব্যবস্থা বিকৃত করারই চেষ্টা করেছে। যেমন বিএনপি সরকারের ১৯৯১ সালে উপজেলা প্রথা বাতিলের পর আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৮ সালে উপজেলা পরিষদ এবং ২০০০ সালে জেলা পরিষদ গঠনের জন্য দুটি আইন প্রণয়ন করে, যা তারা বাস্তবায়ন করেনি। বাস্তবায়ন না করা একদিকে ভালো হয়েছে, কারণ এর মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের নিয়ন্ত্রণে উপজেলা পরিষদ গঠনের বিধান করা হয়েছিল। আইনের ২৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে: “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৬৫ এর অধীন একক আঞ্চলিক এলাকা হইতে নির্বাচিত সংশ্লিষ্ট সংসদ-সদস্য পরিষদের উপদেষ্টা হইবেন এবং পরিষদ উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ করিবে।” এ ধরনের সংসদ সদস্যদের অধীনস্থ বিকৃত স্থানীয় সরকারব্যবস্থা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতো না।
অনেকে স্থানীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বিরাজনৈতিকীকরণের আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। বস্তুত আমাদের অতীতের নির্বাচিত সরকারগুলোই স্থানীয় সরকার নির্বাচন না করে নগ্নভাবে বিরাজনৈতিকীকরণের কাজটি করেছে। কারণ স্থানীয় সরকার হলো নেতৃত্ব সৃষ্টির ‘খামার’−এসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হয়েই অতীতে রাজনীতিবিদেরা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন এবং পরবর্তী সময়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু উপজেলা ও জেলা পরিষদের নির্বাচন না করার ফলে নেতৃত্বে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণ করার জন্যই অনেকে রাজনীতিতে উড়ে এসে জুড়ে বসার সুযোগ পেয়েছেন। এ কারণেই আমাদের গত সংসদ ব্যবসায়ীদের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল।
উপরিউক্ত আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত এবং সর্বস্তরে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গণতন্ত্র পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে। বস্তুত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সংসদভিত্তিক গণতান্ত্রিক কাঠামোর মেরুদণ্ডস্বরূপ। তা সত্ত্বেও আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যদের অযাচিত বিরোধিতার কারণে অতীতে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ স্তরগুলোতে নির্বাচন হয়নি। তাদের এ ব্যর্থতার কারণেই বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের অধীনে এসব নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা ব্যাহত হওয়া এবং কিংস পার্টি গঠনের আশঙ্কায় রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করছে। আমরা মনে করি, এ বিরোধিতা যুক্তিযুক্ত নয়। আশা করি তারা বিরোধিতা প্রত্যাহার করবে এবং দলীয় সমর্থকদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরোধিতা থেকে বিরত রাখবে। একই সাথে তারা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন প্রদানের অনৈতিক কাজ থেকেও বিরত থাকবে। ঐতিহ্যগতভাবে স্থানীয় সরকার দল নিরপেক্ষভাবে হয়ে আসছে। সর্বস্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধির সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেই গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ ও জনগণের ক্ষমতায়নের পথ সুগম হবে।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন−সুশাসনের জন্য নাগরিক।
তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ২৮ জুন ২০০৮
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিরোধিতা কি যুক্তিযুক্ত?
Categories: