সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক ড. বদিউল আলম মজুমদার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে নাটকীয়তা

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নারী প্রতিনিধিত্ব নিয়ে নাটকীয়তা

বদিউল আলম মজুমদার

সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ২৪ এপ্রিল উপদেষ্টা পরিষদ ‘স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) অধ্যাদেশ ২০০৮’, ছয়টি সিটি করপোরেশন আইন একীভূত করে ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) অধ্যাদেশ ২০০৮’ এবং ‘স্থানীয় সরকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০০৮’-এর চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এর আগে ২৩ মার্চ ২০০৮ এগুলোর খসড়া উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়। একই সঙ্গে অনুমোদিত হয় জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের খসড়া অধ্যাদেশ। এসব আইনের ভিত্তি হলো সরকার কর্তৃক গত জুন মাসে গঠিত ‘স্থানীয় সরকার গতিশীল ও শক্তিশালীকরণ কমিটি’র (শক্তিশালীকরণ কমিটি) প্রস্তাবিত সুপারিশমালা ও খসড়া আইন।
সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, অনুমোদিত চূড়ান্ত পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশে শক্তিশালীকরণ কমিটির সুপারিশের অধিকাংশই রাখা হলেও নারী প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে বিরাট পরিবর্তন আনা হয়েছে। বস্তুত এই পরিবর্তনকে নাটকীয় বলা যায়। কারণ চূড়ান্ত অনুমোদিত অধ্যাদেশগুলোতে ২৩ মার্চের নীতিগতভাবে অনুমোদিত খসড়ায় অন্তর্ভুক্ত নারী প্রতিনিধিত্বের পুরো কাঠামোই বদলিয়ে ফেলা হয়। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার ২৭ এপ্রিলের ঘোষণা অনুযায়ী মন্ত্রণালয় কর্তৃক চূড়ান্ত স্থানীয় সরকার (জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ) অধ্যাদেশ ২০০৮-এও নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। শেষোক্ত অধ্যাদেশের ক্ষেত্রে অবশ্য উপদেষ্টা পরিষদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
স্নরণ করা যেতে পারে, শক্তিশালীকরণ কমিটি প্রধান উপদেষ্টার কাছে গত ১৩ নভেম্বর জমা দেওয়া প্রতিবেদনে স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরে নারীদের জন্য ৪০ শতাংশ আসন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সংরক্ষিত করার সুপারিশ করে। সুপারিশে এই সংরক্ষণ পদ্ধতিকে তিন মেয়াদের জন্য সীমিত এবং দুই মেয়াদের পর এটিকে পুনর্মূল্যায়নের প্রস্তাব করা হয়। ঘূর্ণায়মান পদ্ধতির ফলে প্রত্যেক নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা এবং একই পদে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের একই ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব থাকবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এর মাধ্যমে নারী প্রতিনিধিদের ক্ষমতার কাঠামোর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং নারীর সত্যিকারের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে।
প্রধান উপদেষ্টা শক্তিশালীকরণ কমিটির প্রতিবেদন ও খসড়া আইনগুলো গ্রহণের পর মন্ত্রণালয়কে এগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। একই দিন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন শুরু করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া গত ৫ জানুয়ারি ১০ সহস্রাধিক স্থানীয় সরকার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে সরকারের পক্ষ থেকে কমিটির সুপারিশের সারাংশ উপস্থাপন করা হয়। সমাবেশে আবারও প্রধান উপদেষ্টা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশগুলো মূল্যায়ন ও দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন বলে জানান।
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশে মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকারের জন্য যে খসড়া অধ্যাদেশগুলো প্রণয়ন করে, তাতে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে প্রথম নির্বাচনে নারীদের জন্য ৪০ শতাংশ এবং পরবর্তী দুই নির্বাচনে ৩০ শতাংশ করে আসন সংরক্ষণের বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ বিধানটিই ২৩ মার্চের উপদেষ্টা পরিষদের সভায় নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়, যা এর এক মাস পরের উপদেষ্টা পরিষদের ২৪ এপ্রিলের সভায় পুরোপুরি উল্টে দিয়ে স্থানীয় সরকারে নারী প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে মূলত আগের বিধানকেই পুনর্বহাল করা হয়। এটি একটি নাটকীয় পরিবর্তন এই অর্থে যে উপদেষ্টা পরিষদে নীতিগতভাবে অনুমোদিত কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত খুব কদাচিৎই পরিবর্তন করা হয়। অভিজ্ঞদের মতে, গত ১৭ বছরে এ ঘটনা শুধু একবার ঘটেছিল, যা ছিল গত জোট সরকারের আমলে কওমি মাদ্রাসার নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত বাতিলের ক্ষেত্রে। কেন এই নাটকীয়তা?
প্রসঙ্গত, মার্চ-এপ্রিলে বাংলাদেশে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, যার সঙ্গে উপদেষ্টা পরিষদের নাটকীয় সিদ্ধান্তের কোনো যোগসূত্রতা আছে কি না, তা অনেকের মনে প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে। স্নরণ করা যেতে পারে, গত ৮ মার্চ সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের, বিশেষত নারীসমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টা ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০০৮’ ঘোষণা করেন। ঘোষণার পর একটি বিশেষ গোষ্ঠী এর বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং সহিংস প্রতিবাদে লিপ্ত হয়। পরে গত ২৭ মার্চ চারজন উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আলেম-ওলামাদের আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভারপ্রাপ্ত খতিবকে আহ্বায়ক করে ২০ সদস্যবিশিষ্ট একটি নারীনীতি পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয় এবং কমিটি গত ১৭ এপিল তার প্রতিবেদন পেশ করে। লক্ষণীয়, পর্যালোচনা কমিটির প্রতিবেদনে নারী নীতিমালার ১০.৫, ১০.৬ এবং ১০.৭ অনুচ্ছেদ বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এ তিনটি অনুচ্ছেদে জাতীয় সংসদে এক-তৃতীয়াংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষণ এবং স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরে সংরক্ষিত আসনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং এসব আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির মতে, এ তিনটি ধারা ‘ইসলাম, গণতন্ত্র ও সংবিধান পরিপন্থী’ এবং এগুলো ‘পুরুষের ক্ষেত্রে চরম বৈষম্যমূলক এবং নারীদের ক্ষেত্রে চরম পক্ষপাতদুষ্ট’।
মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হয়েছে যে ২০০৩ সালে খুলনা সিটি করপোরেশনের ১০ রজন মহিলা কমিশনারের একটি মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চের ২০০৪ সালের ১৬ আগস্ট প্রদত্ত রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে হয়েছে (রিট পিটিশন নং-৩৩০৪/২০০৩)। মন্ত্রণালয়ের এ যুক্তি অগ্রহণযোগ্য এবং মনে হয় নিতান্তই অজুহাত মাত্র। কারণ মামলাটি ছিল নারী কমিশনারদের প্রতি দায়িত্ব বণটনের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টিকারী ২০০৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের জারি করা একটি পরিপত্রের বিরুদ্ধে। মামলার রায়ে বৈষম্য দূর করার জন্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়ে বলা হয়: ‘…নারী ও পুরুষ উভয়ই জন্নগতভাবে স্বাধীন ও সমান; কিন্তু ঐতিহাসিক কারণে তাদের প্রতি অসম ব্যবহার করা হয়েছে, যদিও প্রকৃতপক্ষে তারা অসম নয়। তাদের উভয়ের জন্নগত সমান অধিকার রয়েছে, তা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত হোক বা না হোক। কিন্তু তা যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল। আমাদের সংবিধান এ অসমতার ব্যাপারে সচেতন এবং তা দূর করার জন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে−এটি সংবিধানের কাম্য। এটিও মনে রাখা প্রয়োজন, রাষ্ট্রের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর অস্তিত্ব সংবিধানের ওপর নির্ভরশীল এবং তারা এর নির্দেশ মানতে বাধ্য।’
উপরিউক্ত রায়ে দায়িত্বের ক্ষেত্রে সমতার কথা বলা হলেও দুর্ভাগ্যবশত এটিকে স্থানীয় সরকারে নারী প্রতিনিধিত্ব খর্ব করার লক্ষ্যে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত। বাংলাদেশের সংবিধান, যা দেশের সর্বোচ্চ আইন, অঙ্গীকার করেছে যে ‘রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিগণ সমন্বয়ে গঠিত স্থানীয় শাসনসংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে উৎসাহ দান করিবেন এবং এই সকল প্রতিষ্ঠানসমূহে কৃষক, শ্রমিক এবং মহিলাদিগকে বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দেওয়া হইবে (অনুচ্ছেদ-৯)।’ এ ছাড়াও ‘কুদরত-ই-এলাহী পনির বাংলাদেশ’ মামলায় [৪৪ ডিএলআর (এডি) (১৯৯২)] বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ১৯৯২ সালে এক সর্বসম্মত রায়ে মন্ত্রণালয়কে স্থানীয় সরকারের সর্বস্তরে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করার সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদের বিশেষ প্রতিনিধিত্বের বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি দেওয়ার নির্দেশ প্রদান করেন। এমনকি বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি মো. মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরীও তাঁদের ২০০৪ সালের রায়ে অতীতের বৈষম্যের জন্য ক্ষতিপূরণের কথা বলেন: ‘১. নারী ও পুরুষের জীবনের সকল ক্ষেত্রে সমান অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে। ২. সংবিধান এই সমতা নারী অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি তা নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের কথা স্বীকার করে এবং এই ক্ষতি পূরণ করার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার অনুমতি দেয়।’ তাই পশ্চাৎপদতা দূরীকরণের স্বার্থে নারীদের বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে তাদের জন্য ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে আসন সংরক্ষণ সংবিধান এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ সংগতিপূর্ণ হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
এ ছাড়া নির্বাচনে দাঁড়ানো একটি ‘আইনি অধিকার’ (statutory right) এবং নারীদের জন্য বিশেষ প্রতিনিধিত্ব একটি ‘সাংবিধানিক অধিকার/অঙ্গীকার’ (constitutional right/commitment)। কোনো নির্বাচনী এলাকার ওপর কারোরই জন্নগত অধিকার নেই এবং তা তার জন্য বাধ্যবাধকতাও নেই। যেমন, প্রতিবেশী ভারতে বর্তমানে নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ চলছে এবং এর ফলে লোকসভার স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নির্বাচনী এলাকা আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে যাবে, যে বিষয়ে কারোরই কিছু করার থাকবে না। উপরন্তু, সমতার যুক্তিই যদি ব্যবহার করা হবে, তাহলে সাংবিধানিক অঙ্গীকার অনুযায়ী বিশেষ প্রতিনিধিত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে জাতীয় ও স্থানীয় সকল পর্যায়ে নারীদের জন্য ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণ করাই যুক্তিযুক্ত হবে। উল্লেখ্য, ভারতের অনেক প্রদেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোতে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতি অনেক দিন থেকে বিরাজমান, যা ভারতীয় আদালত সংবিধান পরিপন্থী বলে ঘোষণা করেননি।
বলাবাহুল্য যে অতীতে পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদে প্রতি তিনটি সাধারণ আসনের জন্য একটি নারী আসন সংরক্ষিত ছিল; উপদেষ্টা পরিষদের সর্বশেষ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও তা বলবৎ করা হয়। উপজেলা ও জেলা পরিষদের ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পরিষদের ২৩ মার্চের নীতিগত অনুমোদন রহিত করে উপজেলার আওতাধীন সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নারী সদস্যদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ এবং অনুরূপভাবে জেলা পরিষদের আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠানের নারী সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশকে যথাক্রমে উপজেলা ও জেলা পরিষদের সদস্য করার প্রস্তাব মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত করেছে বলে শোনা যায়। এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত প্রস্তাবে উপজেলা ও জেলা পরিষদে দুজন ভাইস চেয়ারপারসনের বিধান করা হয়েছে, যার মধ্যে একজন হবেন নারী।
নিঃসন্দেহে উপজেলা ও জেলা পরিষদে নারী ভাইস চেয়ারপারসন রাখার প্রস্তাব প্রশংসনীয়। তবে এটিকে ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’ বলেই মনে হয়। কারণ এর জন্য উচ্চ ‘মূল্য’ দিতে হবে। একটি প্রাথমিক খসড়া হিসাব থেকে দেখা যায়, শক্তিশালীকরণ কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে পৌরসভা, সিটি করপোরেশন এবং ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় ২৩ হাজার ২০০ নারী নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেতেন। এর বিপরীতে অতীতের পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে প্রায় ১৪ হাজার ৮০০ নারী এ সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ জেলা ও উপজেলা পরিষদের কথা বাদ দিলেও প্রতি জেলায় ও উপজেলায় একজন করে ভাইস চেয়ারপারসন (মোট ৫৪৩) পদের জন্য প্রায় আট হাজার ৪০০ প্রতিনিধি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। এ ছাড়া শক্তিশালীকরণ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে যেখানে নতুন নারী নেতৃত্ব সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ তৈরি হতো, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেখানে একই নারীরা ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদে প্রতিনিধিত্ব করবেন।
স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা নির্বাচনের ক্ষেত্রে অবশ্য অতীতের পদ্ধতি ব্যবহার করলেও নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিদের সমদায়িত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন। আমাদের আশঙ্কা যে এটি সম্ভব হবে না। কারণ অতীতের পদ্ধতি বৈশিষ্ট্যগতভাবেই বৈষম্যমূলক−এ পদ্ধতিতে নারীদের তিনটি সাধারণ আসন থেকে নির্বাচিত হতে হয় এবং এটি নারীকে বিদ্যমান ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে রাখে। এ ছাড়া অভিজ্ঞতা হলো যে ২০০৪ সালের হাইকোর্টের রায়ের পর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরিপত্র জারি করে নারীদের অধিক ক্ষমতা দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছিল, যা সফল হয়নি।
এটি সুস্পষ্ট যে স্থানীয় সরকারে নারী প্রতিনিধিদের ক্ষেত্রে উপদেষ্টা পরিষদের নাটকীয় সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বঞ্চিত নারীদের আরও বঞ্চিত করবে। এর মাশুল অবশ্য পুরো জাতিকে দিতে হবে দুইভাবে। প্রথমত, সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থা এবং অবস্থানের পরিবর্তন ব্যতীত সমাজে বিদ্যমান ব্যাপক ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অপুষ্টির সমস্যার সমাধান করা যাবে না। কারণ নারী ও কন্যাশিশুরাই প্রধানত এগুলোর শিকার এবং বংশপরম্পরায় এগুলোর অনাগ্রহী বাহক। দ্বিতীয়ত, তৃণমূলের নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া উদীয়মান উগ্রবাদকে প্রতিহত করা যাবে না। কারণ এ লড়াইয়ে তাঁরাই হবেন প্রথম কাতারের সৈনিক এবং এতে সংগত কারণেই অধিকাংশ পুরুষের ভূমিকা হবে মূলত নীরব দর্শকের।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন−সুশাসনের জন্য নাগরিক।

তথ্য সূত্র: প্রথম আলো, ৭ মে ২০০৮

Related Post

ভিত সুদৃঢ় করা আজ অতি জরুরিভিত সুদৃঢ় করা আজ অতি জরুরি

গণতন্ত্র বদিউল আলম মজুমদার অনেক বিদেশিই আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। এদের মধ্যে বিশেষজ্ঞ যেমন আছেন, তেমনি আছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি সতর্ক পর্যবেক্ষক। যেমন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ

নির্বাচন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনানির্বাচন কমিশনের সংস্কার প্রস্তাব ও কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা

লেখক: ড. বদিউল আলম মজুমদার । শনি, ২০ অগাষ্টঁ-এ ২০১১, ৫ ভাদ্র ১৪১৮ নির্বাচন কমিশন কতগুলো সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপ শেষ করেছে। কমিশন গণমাধ্যম ও নাগরিক

পঞ্চদশ সংশোধনীর পরিণতি শুভ হবে নাপঞ্চদশ সংশোধনীর পরিণতি শুভ হবে না

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ১২-০৭-২০১১ গত ৩০ জুন আমাদের জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল ২৯১-১ ভোটে পাস হয়েছে। এর মাধ্যমে মোটা দাগে সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ