বদিউল আলম মজুমদার
সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নব নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আশরাফুল ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেন যে সংসদের আগামী অধিবেশনে উপজেলা পরিষদ আইনে সংশোধনী আনা হবে (প্রথম আলো, ৩০ জুলাই ২০০৯)। এ ঘোষণার মাধ্যমে উপজেলা পরিষদ নিয়ে যে একটি চরম জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, তা সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হলো, নিঃসন্দেহে যা একটি শুভ লক্ষণ। বস্তুত আমাদের স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় আজ এক চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। এমন আশঙ্কা আমরা অবশ্য বহু দিন থেকেই ব্যক্ত করে আসছি, যার জন্য আমাদের অনেকের বিরাগভাজনও হতে হয়েছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা জাতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ, তাই বিষয়টির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত মনোযোগ ও নেতৃত্ব আজ অত্যন্ত জরুরি।
স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনা গ্রন্থে জোরাল যুক্তি উত্থাপন করেছেন। বর্তমান লেখকও একাধিকবার তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে এ ব্যাপারে লিখেছেন। স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার বেশকিছু যৌক্তিকতা রয়েছে। প্রথমত, প্রশাসনের সকল স্তরে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র পরিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্র হইবে একটি গণতন্ত্র…প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করিতে হইবে।’ একইভাবে সংবিধানে ৫৯(১) অনুচ্ছেদের বিধান মোতাবেক, ‘আইনানুয়ায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ অর্থাৎ প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন আমাদের সাংবিধানিক অঙ্গীকার। কারণ, এর মাধ্যমে সংসদভিত্তিক গণতান্ত্রিক উপরিকাঠামোর জন্য শক্ত ভিত বা খুঁটি তৈরি হয়। আর অভিজ্ঞতায় বলে, খুঁটিহীন গণতন্ত্র টিকে থাকে না।
দ্বিতীয়ত, অতীতের বিভিন্ন মহলের হস্তক্ষেপের ফলে বিদ্যমান উপজেলা প্রশাসন প্রায় ভেঙে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে আমাদের অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর ২০০২ সালে প্রণীত জেলায় জেলায় সরকার গ্রন্থে লিখেছেন, ‘উপজেলায় অর্থাৎ থানায় সেই ১৯৬১ সাল থেকে একটি কার্যকরী প্রশাসনিক কাঠামো স্থাপনের কাজ শুরু হয়…এই কাঠামো বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের নিম্নতর স্তর…এই কাঠামোর মূল্যায়ন, তত্ত্বাবধায়ন ও পরিদর্শন অত্যন্ত দুর্বল ও শ্লথ। এই কাঠামোকে সত্যিকারভাবে ব্যবহারের জন্য একে স্থানীয় শাসনের অংশীভূত করা উচিত ছিল।’ অর্থাৎ আমাদের অর্থমন্ত্রী উপজেলার বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামোকে ক্রিয়াশীল করার জন্য এটিকে উপজেলা পরিষদের আওতায় আনার প্রস্তাব করেন। এ জন্য অবশ্য প্রয়োজন হবে একটি শক্তিশালী উপজেলা পরিষদ।
১৯৯৮ সালের উপজেলা আইনকে সংশোধন করে নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে যা পাস করা হয়েছে, তা দিয়ে এমন শক্তিশালী পরিষদ গঠন সম্ভবপর নয়। বস্তুত আমাদের অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, ১৯৯৮ সালের আইনের অধীনে গঠিত হলে−যে আইন এখন কিছু সংশোধনীসহ পুনঃপ্রচলন করা হয়েছে, সে উপজেলা পরিষদ হতো একটি ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে উপজেলা প্রশাসনের অবস্থা আরও করুণ। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ব্যতীত অনেক কর্মকর্তাই এখন উপজেলা সদরে বসবাস করেন না। তাই এ উপজেলা প্রশাসনে গতিশীলতা এনে সব সরকারি সেবা জনগণের জন্য সহজপ্রাপ্য করার এবং দায়বদ্ধতার সঙ্গে তাদের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি কার্যকর ও স্বয়ম্ভর উপজেলা পরিষদের কোনো বিকল্প নেই।
তৃতীয়ত, স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমেই উন্নয়নকে একটি ‘আন্দোলন’-এ পরিণত করা সম্ভব হবে। মানুষ প্রতিনিয়ত যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় (যেমন−শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়োনিষ্কাশন, পরিবেশ, নারীর প্রতি সহিংসতা ও বৈষম্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদি), তার অধিকাংশই স্থানীয় এবং এগুলোর সমাধানও স্থানীয়ভাবে হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তা হলেই ‘কৃষি ও পল্লীজীবনে গতিশীলতা’ আসবে, যা ‘দিনবদলের সনদ’-এ ব্যক্ত করা আওয়ামী লীগের সুস্পষ্ট নির্বাচনী অঙ্গীকার।
চতুর্থত, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার ওপরই কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠা বহুলাংশে নির্ভর করবে। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য বিদ্যমান (১৯৯৮ সালের সংশোধিত ও পুনঃপ্রচলিত) উপজেলা আইনের ২৫ ধারা, যা উপদেষ্টা হিসেবে সাংসদদের পরামর্শ গ্রহণকে পরিষদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, রহিত করে এগুলোকে তাঁদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ নিয়ন্ত্রণে লিপ্ত থাকলে সাংসদদের জাতীয় দায়িত্ব পালন ব্যাহত হবে। জনগণ জাতীয় সংসদে প্রতিনিধি প্রেরণ করে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য, তাদের স্বার্থে যথাযথ আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণের জন্য। সর্বোপরি তাদের পক্ষে সরকারের কার্যক্রমে ‘পাহারাদার’-এর ভূমিকা পালনের জন্য। এ ভূমিকা, যাকে ‘ওভারসাইট’ বা নজরদারিত্বের ভূমিকা বলে আখ্যায়িত করা হয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই অধিকাংশ সম্পদ ও দক্ষ জনবল এবং এগুলোর কার্যকর ব্যবহারের ওপরই জনগণের সুখ ও সমৃদ্ধি বহুলাংশে নির্ভর করে।
উল্লেখ্য, সাংসদেরা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধি’ (৫৯ অনুচ্ছেদ) নন এবং তাঁদের এসব প্রতিষ্ঠানে হস্তক্ষেপ সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। উপজেলা পরিষদ (সংশোধিত) আইন, ২০০৯ আরেক কারণেও সংবিধানের পরিপন্থী−এর মাধ্যমে শুধু একক আঞ্চলিক এলাকা থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরই পরিষদে উপদেষ্টা করা হয়েছে। সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত নারী সদস্যদেরও বঞ্চিত করা হয়েছে, যা বৈষম্যমূলক এবং সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে সাংসদদের হস্তক্ষেপ সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করে হাইকোর্টের একটি রায়ও রয়েছে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বনাম বাংলাদেশ মামলার [১৬বিএলটি(এইচসিবি) ২০০৮] রায়ে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ‘জেলা মন্ত্রীর’ বিধান ২০০৬ সালে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেন। তাঁরা সুস্পষ্টভাবে বলেন, ‘মন্ত্রী, হুইপ এবং অন্যান্য কর্মকর্তাদের…কাউকেই উল্লেখিত কোনো জেলার জন্য নিয়োগ প্রদান করা যায় না। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মন্ত্রী হিসেবে পুরো দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য দায়িত্ব ব্যতীত জেলাগুলোতে তাঁদের অন্য কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। একইভাবে সংসদ সদস্যদেরও জেলা বা অন্যান্য প্রশাসনিক একাংশে উন্নয়ন বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা বা দায়িত্ব নেই। অতএব মামলার বাদী, যিনি একজন সংসদ সদস্য, পিরোজপুর জেলা সম্পর্কে তাঁর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই।’
এ ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয় যে সার্বভৌম সংসদ আইন করে যা ইচ্ছা করতে পারে, এমনকি সংবিধানও সংশোধন করতে পারে। তবে যেসব রাষ্ট্রে লিখিত সংবিধান রয়েছে, সেখানে সংসদ সার্বভৌম নয় [রাজা রামপাল বনাম স্পিকার, (২০০৭)৩এসসিসি]। আর সংসদ সংবিধান সংশোধিত করে সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে এবং সংবিধান অনুসরণ করেই। এ ছাড়া কুদরত-ই-এলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ মামলার রায়ে [৪৪ডিএলআর(এডি)(১৯৯২)] বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে স্থানীয় সরকার বিষয়ে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংসদ সংবিধানকে উপেক্ষা করতে পারে না। উপরনতু যা প্রত্যক্ষভাবে করা যায় না, তা আইন করে উপদেষ্টার লেবাসে করা হলে তা হবে ‘কালারেবল লেজিসলেশন’ বা রঙিন আইন।
পঞ্চমত, অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে স্থানীয় উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলে, যা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে দুর্বল করে, সাংসদেরা দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জেলা প্রশাসক সম্মেলনে ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে অভিযোগ উঠেছে। স্নরণ রাখা প্রয়োজন যে গত জোট সরকারের আমলে সাংসদেরা আইনগত কোনো বৈধতা না থাকা সত্ত্বেও স্থানীয় উন্নয়নে হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে অনেক অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, যার মাশুল গত সংসদ নির্বাচনে তাঁদের গুনতে হয়েছে।
ষষ্ঠত, স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই ক্ষমতা ও আর্থিক বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব। জনগণের সবচেয়ে কাছের সরকার হওয়ার কারণে স্থানীয় সরকারের কার্যক্রমে জনগণ সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে পারে। তাই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহে অধিক ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব দেওয়া হলে জনগণের ক্ষমতায়নের পথ সুগম হয়। সপ্তমত, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে হলে বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালীকরণ করার কোনো বিকল্প নেই। দুর্নীতির মূল কারণ স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার অভাব। আর স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার চর্চা তৃণমূলেই সম্ভব। গ্রাম/ওয়ার্ড সভা, প্রকাশ্য বাজেট অধিবেশন, জনগণের কার্যকর সম্পৃক্ততা ইত্যাদির মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়েই দায়বদ্ধতার চর্চা করা আবশ্যক। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তা দুরূহ এবং কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থায়, যেখানে সীমিতসংখ্যক ব্যক্তি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত, তা প্রায় অসম্ভব। তাই আমাদের মতো এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থায় স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।
এসব গুরুত্বের কারণে সব স্থানীয় সরকার আইনকে পুনর্বিন্যাস করা আজ জরুরি। পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে কার্যকর স্থানীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যগুলো স্নরণ রাখা প্রয়োজন। স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: প্রথমত, স্থানীয় সরকারও একটি সরকার, তাই স্থানীয় সরকারব্যবস্থা হতে হবে স্বায়ত্তশাসিত। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ আইনানুযায়ী নির্বাচিত স্থানীয় প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হতে হবে, জাতীয় সংসদ সদস্যদের দ্বারা নয়। তৃতীয়ত, ‘স্থানীয় শাসন’-এর দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হলে স্থানীয় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়-দায়িত্ব থাকতে হবে (অনুচ্ছেদ ৫৯)। চতুর্থত, এ সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের জোগান থাকতে হবে। পঞ্চমত, এগুলোর মাধ্যমে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতে হবে। ষষ্ঠত, এগুলোতে সমাজের পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর, বিশেষত নারী, কৃষক ও শ্রমিকের অন্তর্ভুক্তিকরণ নিশ্চিত করতে হবে (অনুচ্ছেদ ৯)। সপ্তমত, স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার বিধান থাকতে হবে। অষ্টমত, স্থানীয় সরকারের প্রত্যেকটি স্তর হতে হবে স্বাধীন, অর্থাৎ পরস্পরের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। উল্লেখ্য যে এসব বৈশিষ্ট্যের অনেকগুলোই কুদরত-ই-এলাহী পনির মামলায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে উল্লিখিত আছে এবং এগুলোর আলোকেই আইনের পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
আইন পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সাংসদদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের হস্তক্ষেপ থেকে দূরে রাখা। সাংসদেরা অবশ্য যুক্তি প্রদর্শন করেন যে স্থানীয় উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত না হলে ভবিষ্যতে তাঁরা নির্বাচিত হতে পারবেন না। অতীতের, বিশেষত গত সরকারের আমলের অভিজ্ঞতা অবশ্য ভিন্ন কথা বলে। সাংসদেরা আরও দাবি করেন, জনগণ তাঁদের কাছ থেকে অনেক সহায়তা আশা করে। গত এপ্রিলে ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের পরিচালিত এক জরিপ থেকে দেখা যায়, মাত্র তিন শতাংশ নাগরিক স্থানীয় সমস্যা সমাধানের জন্য সাংসদদের কাছে সহযোগিতা চায়, পক্ষান্তরে ৮০ শতাংশ নাগরিক স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শরণাপন্ন হয়।
স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হলে এগুলোকে আরও সম্পদ দিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা সম্পদের মালিক জনগণ। অভিজ্ঞতা বলে, সম্পদ, ক্ষমতা ও দায়দায়িত্ব যত বেশি জনগণের কাছের সরকারের কাছে যায়, তা তত বেশি তাদের কল্যাণে আসে। বর্তমানে অতি সামান্য সম্পদই স্থানীয় সরকার, বিশেষত, গ্রামীণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে ব্যয় হয়। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণই গ্রামীণ দারিদ্র্যের ব্যাপকতার প্রধান কারণ। সম্পদের সুষম বণটনের মাধ্যমেই এ অবস্থার বিহিত ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এবং এ জন্য ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’-এর পুনঃপ্রচলন জরুরি।
সম্প্রতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের উপজেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী করার প্রস্তাব উঠেছে। এ প্রসঙ্গে কুদরত-ই-এলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সর্বসম্মত রায়ের কথা স্নরণ করা আবশ্যক। আদালত বলেন, ‘যদি সরকারি কর্মকর্তা কিংবা তাদের তল্পিবহদের (henchmen) স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কাজে নিয়োজিত করা হয়, তাহলে এগুলোকে স্থানীয় সরকার বলা যুক্তিযুক্ত হবে না।’ কারণ, এতে প্রশাসনের সকল পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠার সাংবিধানিক নির্দেশনা লঙ্ঘিত হবে।
পরিশেষে এটি সুস্পষ্ট যে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে, তৃণমূল পর্যায়ে বর্তমানে একটি চরম দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতিতে ইতিবাচক কিছু ঘটে না। এ ছাড়া নতুন উপজেলা পরিষদ আইন সংবিধানকে পদদলিত এবং উচ্চ আদালতের রায়কে উপেক্ষা করছে। সর্বোপরি, আমাদের আশঙ্কা, একটি শক্তিশালী ও দায়বদ্ধ স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দিনবদলের সনদ ও ২০২১ সালের জন্য প্রণীত রূপকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পথ সুগম হবে না। তাই এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব ও ব্যক্তিগত মনযোগ আমরা আন্তরিকভাবে আশা করছি। তিনি চাইলে আমরাও সহায়তা করতে প্রস্তুত। ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, ১০ আগষ্ট ২০০৯
স্থানীয় সরকার: প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত মনোযোগ জরুরি হয়ে পড়েছে
Categories: