ড. বদিউল আলম মজুমদার
(পূর্ব প্রকাশের পর)
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রণীত একটি অধ্যাদেশের ভিত্তিতে ২২ জানুয়ারি, ২০০৯ তারিখে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রায় দুই দশক পরে উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু নবনির্বাচিত সরকার অধ্যাদেশটি অনুমোদন না করে নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রণীত উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ সংশোধিত আকারে অনুমোদন করে। এ আইনের কতগুলো গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে: আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট এলাকার নির্বাচিত সংসদ সদস্য উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা হবেন এবং পরিষদকে উপদেষ্টার পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়াও আইনে (ধারা ৪২) সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্যের সুপারিশ গ্রহণপূর্বক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের বিধান করা হয়েছে। এমনকি সরকারের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও পরিষদের পক্ষ থেকে সাংসদকে অবহিত করার বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এ সকল বিধানের মাধ্যমে উপজেলা পরিষদের ওপর স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উপজেলা আইনটি চরমভাবে বৈষম্যমূলক। কারণ এতে একক আঞ্চলিক এলাকা থেকে নির্বাচিত ৩০০ জন সাংসদকেই উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা করা হয়েছে, সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত বাকি ৪৫ জন নারী সদস্যের এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখা হয়নি। এটি একটি ‘রঙিন’ বা বিকৃত আইন (colourable legislation)– যা প্রত্যক্ষভাবে করা যায় না, আইন করে পরোক্ষভাবে তা করলে সে আইনকে রঙিন আইন বলা হয়। সাংসদগণ জাতীয় সংসদের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচিত, তাঁদের দিয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করলে নিঃসন্দেহে সেসব প্রতিষ্ঠানকে স্থানীয় সরকার বলা যাবে না, যেমনিভাবে সরকারি কর্মকর্তাদেরকে দিয়ে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সরকার নয় (কুদরত-ই-এলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ)। প্রধান নির্বাহি হিসেবে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হলেও, সংশোধিত আইনের মাধ্যমে উপজেলা চেয়ারম্যানকে পরিষদের প্রধান নির্বাহি হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। আইনের ২৬(২) ধারা অনুযায়ী, ‘পরিষদের নির্বাহী ক্ষমতা পরিষদের নিকট হইতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, সদস্য বা অন্য কোন কর্মকর্তার মাধ্যমে প্রযুক্ত হইবে।’ এই বিধানের ফলে উপজেলা পরিষদে প্রধান নির্বাহির পদ নিয়ে অশুভ খেলা খেলার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আইনের ৫০ ও ৫১ ধারায় পরিষদের উপর সরকারের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা স্বশাসিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার চেতনার পরিপন্থি। আইনটি উপরোল্লেখিত স্থানীয় সরকারের বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথেও অসঙ্গতিপূর্ণ। এটি স্বশাসিত স্থানীয় সরকারের চেতনার সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
সংশোধিত আইনটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তা ভাবনা গ্রন্থে উল্লেখিত স্থানীয় সরকার সম্পর্কিত অনেকগুলো বলিষ্ঠ ধ্যান-ধারণার সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রণীত অধ্যাদেশে অনেকগুলো প্রগতিশীল বিধান ছিল, যা সংশোধিত আইনটিতে অনুপস্থিত। যেমন, তথ্য অধিকারের বিধান, সিটিজেন চার্টার প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা ইত্যাদি। এছাড়াও অধ্যাদেশে নির্বাচনে প্রার্থীদের যোগ্যতা-অযোগ্যতাকে আরো কঠোর করা হয়েছিল, যা অনাকাঙিক্ষত ব্যক্তিদেরকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারতো।
আইনগত সীমাবদ্ধতা ছাড়াও, উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেকগুলো জটিল, এমনকি ভয়াবহ সমস্যা দেখা দিয়েছে। এরই মধ্যে অনেক উপজেলার কর্তৃত্ব মাননীয় সংসদ সদস্যগণ নিয়ে নিয়েছেন। বিরোধী দলের উপজেলা চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে এ কর্তৃত্ব অযৌক্তিক পর্যায়ে পৌঁছেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাংসদের প্রতিনিধি হিসেবে দলীয় নেতারাও উপজেলার ওপর কর্তৃত্ব করছেন। উপজেলা নির্বাহি কর্মকর্তাগণও অনেকক্ষেত্রে, সম্ভবত বাধ্য হয়ে, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের পরিবর্তে সাংসদের অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজ করছেন। এ অবস্থা উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থাকেই অকার্যকর করে তুলতে পারে। উপজেলা পরিষদ নিয়ে আরেকটি জটিলতার উৎস হলো যে, অনেক উপজেলায় একাধিক সাংসদ রয়েছেন। এছাড়াও এর মাধ্যমে একটি অহেতুক দ্বন্দ্বাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে, যার বিস্ফোরণ অবসম্ভাবী। উপরন্তু, উপজেলা প্রশাসনকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্তৃত্বে এনে বর্তমানের স্থবির অবস্থাকে চাঙ্গা করার আকাঙক্ষাও ভেস্তে যাবে, যা আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করছে।
শুধু উপজেলা পরিষদেরই নয়, ইউনিয়ন পরিষদেরও বর্তমানে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। আইনগত কোনো ভিত্তি না থাকলেও, অনেক সাংসদ বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদকে অযাচিতভাবে পরামর্শ দিচ্ছেন এবং পরিষদকে এ পরামর্শ গ্রহণে বাধ্য করছেন। এছাড়াও কিছু সাংসদ দলীয় নেতা-কর্মীদের ইউনিয়ন পরিষদের ওপর খবরদারিত্ব করার জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। উপরন্তু দলীয় ক্যাডারদের চাপে অনেক ইউনিয়ন পরিষদই স্বাধীনভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না।
ইউনিয়ন পরিষদের জন্য গোদের ওপর এখন বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছেন কিছু উপজেলা চেয়ারম্যান – তাঁরা আইন বহির্ভূতভাবে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্থানীয় সরকারের কোনো স্তরই অন্য স্তরের নিয়ন্ত্রণে নয়, প্রত্যেক স্তরই স্বাধীন স্বত্ত্বার অধিকারী। অর্থাৎ সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচিত জেলা পরিষদের ওপর জেলার, নির্বাচিত উপজেলার ওপর উপজেলার এবং নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের ওপর ইউনিয়নের ‘স্থানীয় শাসনের ভার’ অর্পিত হওয়ার কথা – সংশ্লিষ্ট স্তরের বাইরের কার্যক্রম তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত।
এরশাদ আমল থেকে দলীয় নেতা-কর্মীদেরকে ফায়দা দেয়ার লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘পল্লী পরিষদ’, ‘গ্রাম পরিষদ’ ও ‘গ্রাম সরকার’ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালানো হয়। গ্রাম সরকারকে অসাংবিধানিক ঘোষণার পরও এ গর্হিত কাজটি থেমে থাকে নি। মাননীয় সংসদ সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতায় দলীয় ব্যক্তিরা বর্তমানে এ কাজটি অনানুষ্ঠানিকভাবে করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
উপসংহার
একটি রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিতে অর্জিত স্বাধীনতাকে সাধারণ জনগণের জন্য অর্থবহ করার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে একটি শক্তিশালী, গতিশীল ও সমন্বিত স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার বলিষ্ঠ অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের অভাবে আজকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা একটি বেহাল অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়েছে। কুদরত-ই-এলাহী পনির বনাম বাংলাদেশ মামলার সর্বসম্মত রায়ে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ৬ মাসের মধ্যে সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিলেও, অদ্যাবধিও নির্বাচিত জেলা পরিষদ গঠিত হয় নি। জনগণের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্যগণ উপজেলা পরিষদের ওপর তাদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ১৯৯৮ সালের উপজেলা আইনটিকে সংশোধিত আকারে পাশ করেছেন। আইনটি আমাদের সংবিধান ও আদালতের রায়ের সঙ্গে শুধু অসঙ্গতিপূর্ণই নয়, এটি জাতি হিসেবে আমাদের অগ্রযাত্রাকেও ব্যাহত করবে। নানামুখী চাপে ইউনিয়ন পরিষদও আজ অকার্যকর হওয়ার পর্যায়ে। সাংসদগণ এখন তাঁদের খবরদারিত্ব পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে বিস্তৃত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত। মোটকথা, আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আজ অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি।
শেষ করছি আমাদের মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব এএমএ মুহিতের লেখা উপজেলা আইন সম্পর্কে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। বর্তমান আইনের পূর্বসূরী উপজেলা আইন ১৯৯৮ সালে বিল আকারে সংসদে উত্থাপিত হলে তিনি সেটির কড়া সমালোচনা করেন। পরবর্তীতে ২০০২ সালে প্রণীত ‘জেলায় জেলায় সরকার’ বইয়ে তিনি লিখেন: ‘উপজেলায় অর্থাৎ থানায় সেই ১৯৬১ সাল থেকে একটি কার্যকরী প্রশাসনিক কাঠামো স্থাপনের কাজ শুরু হয়। ১৯৮২-৮৩ সালে উপজেলা পরিষদ সৃষ্টিতে এই কাঠামো আরো শক্তিশালী হয়। এই কাঠামো বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের নিম্নতম স্তর বলে বিবেচিত হতে পারে। এই কাঠামোর মূল্যায়ন, তত্ত্বাবধান ও পরিদর্শন অত্যন্ত দুর্বল ও শ্লথ। এই কাঠামোকে সত্যিকারভাবে ব্যবহারের জন্য একে স্থানীয় শাসনের অংশীভূত করা উচিত ছিল। সেজন্য প্রয়োজন হলো দায়িত্বশীল ও স্বয়ম্ভর জেলা বা উপজেলা সরকার। তার কোন চিন্তাভাবনা বর্তমান (১৯৯৮ সালের) আইনে রূপলাভ করেনি। সৌভাগ্যের বিষয় যে দু’বছরেও এই পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই ঠুঁটো জগন্নাথ পরিষদকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং সেই সুযোগটি এখনই হাজির হয়েছে।’ দুর্ভাগ্যবশত সে সুযোগটি আমরা এবারো হারাতে বসেছি। শুধু তাই নয় আদালতের রায় উপেক্ষা করে এবং জনস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে সাংসদদের অন্যায় আবদার রক্ষার জন্য যে উপজেলা আইন পাশ করা হয়, তা ভবিষ্যতে একটি অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। (সমাপ্ত)
[লেখক: সম্পাদক, সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক]
তথ্য সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ মে ২০০৯
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বর্তমান হালচাল
Categories: