সুজন- সুশাসনের জন্য নাগরিক গোলটেবিল বৈঠক ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পরিস্থিতি: কিছু ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পরিস্থিতি: কিছু ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

Press conference 12.06.14সুষ্ঠু নির্বাচনের পাশাপাশি, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক রীতি-নীতির চর্চা। গত ১২ জুন ২০১৪ জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পরিস্থিতি: কিছু ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে সুজন নেতৃবৃন্দ এ মন্তব্য করেন। সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার-এর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন ড. আকবর আলী খান, বিচারপতি কাজী এবাদুল হক, অধ্যাপক আবু সায়ীদ, মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর, হুমায়ূন কবীর হিরু, জনাব রেহানা সিদ্দিকী, ইঞ্জিনিয়ার মুসবাহ আলীম, জনাব এম এ সিদ্দিকী, জনাব আব্দুল হাই, প্রমুখ।

আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডি’র ডিসটিংগুইসড ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান। তিনি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, স্বাধীনভাবে সত্য কথা বলা একটি ভীষণ ঝুঁকির কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি বা অপরাধ উন্মোচন অথবা ভিন্ন মতাবলম্বী কথা বলার কারণে মিডিয়া বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরকে হুমকি বা হয়রানির বিভিন্ন ঘটনাও আমরা লক্ষ্য করছি। আমাদের যদি স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার না থাকে তাহলে দেশের গণতন্ত্রের সার্বিক পরিস্থিতি নিযে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বৈকি। তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ধারা অব্যাহত রাখার জন্য দেশের শাসনব্যবস্থায় নাকি সরকার অব্যাহত রাখার প্রয়োজন রয়েছে। এই ‘‘সরকার অব্যাহত রাখার” কথাটি কিন’ উদ্বেগজনক। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য নীতি কাঠামোর ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতার প্রয়োজন রয়েছে, বিশেষ করে যেসব নীতি সুফল বয়ে আনে, তবে আমাদের মনে রাখতে হবে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণই ভোটের মাধ্যমে ঠিক করবে তারা কোনো সরকারকে অব্যাহত রাখবে না পরিবর্তিত করবে। তিনি আরো উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, গণতন্ত্রের কিছু উপাদানের একসাথে কাজ করা উচিৎ। যেমন- অবাধ ও মুক্ত নির্বাচনের সাথে অহিংস ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি দু’টি অবিভাজ্য উপাদান এবং অতি অবশ্যই তাদেরকে একসাথে আসতে হবে। দেশে যদি সার্বক্ষণিক সহিংস পরিস্থিতি বিরাজ করে অথবা কিছু সম্প্রদায়কে অবিরতভাবে সহিংসতার শিকার হতে হয় – এরকম একটি পরিস্থিতিতে কখনোই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, দশম সংসদ নির্বাচনের পর সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো- প্রধান দলগুলোর অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি বিশ্বাসযোগ্য সংসদীয় নির্বাচন। কিন’ তবুও আমি মনে করি না যে, নিছক একটি স্বাধীন এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেই আমরা আমাদের গণতন্ত্রের গভীরে প্রোথিত সমস্যাগুলির সমাধান ঘটাতে পারবে। আমি মনে করি, আগামী নির্বাচনের পূর্বে দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে প্রথমেই ‘winner-takes all’ ‘বিজয়ী দল সব নেবে’ এই সংস্কৃতি চর্চা পরিত্যাগের ব্যপারে একমত হওয়া এবং প্রতিহিংসাও সহিংসতার রাজনীতি পরিত্যাগে নিজেদের অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। আমাকে যদি এক বাক্যে আমাদের গণতন্ত্রের সমস্যার সমাধানের উপায় কী তার উত্তর দিতে বলা হয়, তাহলে আমি বলবো এখন আমাদের প্রধান কাজ হবে আমাদের নির্বাচনী গণতন্ত্রের ‘গণতন্ত্রীকরণ’ প্রক্রিয়া বাসত্মবায়িত করার ব্যবস্থা নেওয়া।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যনত্মরীণ গণতন্ত্রের অভাব দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের গুণগত উন্নতি সাধনে একটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। যদিও সকল দলের গঠনতন্ত্রে নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে নেতা/নেত্রী নির্বাচনের কথা আছে এবং তৃণমূল পর্যায়ে পরামর্শ সংক্রানত্ম বিভিন্ন পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, কিন’ বাসত্মবে নির্বাচন হয় অনিয়মিত এবং সিদ্ধানত্ম গ্রহণের প্রক্রিয়াটি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের হাতেই রয়ে গেছে। তিনি এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে বলেন। এরই ধারাবাহিকতায় নির্বাচনী রাজনীতির ‘সুসংহত গণতন্ত্রায়ন’ সম্ভব হবে বলেও তিনি মনত্মব্য করেন। রাজনৈতিক দল ও নেত্রীবৃন্দকে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি নিবন্ধের অনুরোধ জানান। যেমন: (১) গত বছরে ভয়াবহ সহিংসতার পর আমরা সবাই মনে করি যে, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সহিংসতার কোনো জায়গা থাকতে পারে না। কিন’ বহু বছর ধরে দল ও নেতা ও কর্মীবৃন্দ সহিংস রাজনীতিতে অভ্যসত্ম হয়ে গিয়েছে। এখন কী উপায়ে তারা এর থেকে বের হবে? বিরোধী দলগুলো যদি রাজপথে সহিংসতা না করে তারা কি অন্য উপায়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে? এ নিয়ে বিরোধী দলগুলোকে সৃজনশীলভাবে ভাবতে হবে। (২) রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের ব্যাপ্তি থেকে দলগুলোকে বের হয়ে আসতে হবে। (৩) আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সকল রাজনৈতিক দলকে ঐক্যে পৌঁছাতে হবে। নীতি বিসর্জন না দিয়েও আলোচনা করে কোনো উপায় বের করা যায় কি না, যাতে করে সব বিরোধই সংঘাতে পরিণত না হয় সেদিকে দৃষ্টি প্রদান করতে হবে।

এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, দেশে পুরোপুরি একনায়কতন্ত্র চলছে, গণতন্ত্র নেই বললেই চলে। রাজনীতি আজ কলুষিত। এ থেকে উত্তরণ অতীব জরম্নরি। তিনি জনগণকে স্ব স্ব অবস’ান থেকে সচেতন ও সক্রিয় হবার আহ্বান জানান। তিনি দু:খ প্রকাশ আরো বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ব্যক্তি স্বার্থ দেখে, দলীয় স্বার্থ দেখে কিন’ দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ দেখে না।

ড. আকবর আলী খান বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা অত্যনত্ম জটিল। এ সংকটের কোন সমাধান নেই। জাতীয় সংয়সদ নির্বাচন হয়ে গিয়েছে এবং এ নির্বাচনকে সকলের নিকট কিভাবে গ্রহণযোগ্য করা যায় সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের সংবিধানে দুর্বলতা রয়েছে, রয়েছে গলদ আমাদের শাসনব্যবস্থায়। রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করা যেতে পারে সংবিধানে ‘রেফারেন্ডাম’ ও ‘রিকল’ পদ্ধতির ব্যবস’া করে। এই পদ্ধতির প্রবর্তন বিরোধী দলকে ধ্বংসাত্মক রাজনীতি পরিহারে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। তিনি আরো বলেন, আমাদের দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে প্রকৃত আদর্শবান রাজনীতিকগণ আজ অনেক দূরে সরে গিয়েছে। যারা হালুয়া-রম্নটি চান তারাই বর্তমানে রাজনীতি করছেন। তিনি রাজনীতিবিদগণের উদ্দেশ্যে বলেন, গণতন্ত্র থেকে বিচ্যুতি অতিতে জনগণ মেনে নেয়নি, ভবিষ্যতেও মেনে নেবে না।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, গণতন্ত্র আজ বিপন্ন। আপাততদৃষ্টিতে দেশে স্থিতিশীলতা বিরাজ করলেও দীর্ঘমেয়াদে অনেকগুলো সমস্যা রয়েছে। গণতন্ত্র মানে সম্মতির শাসন। এ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নির্বাচনের মাধ্যমে। আর এ নির্বাচন হতে হবে সুষ্টু, অবাধ ও প্রতিযোগিতামূলক। কিন’ গত ৫ জানুযারি যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সে নির্বাচনে এ সকল উপাদান অনুপসি’ত। সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে এ নির্বাচন অনষ্ঠিত হয়নি। মাত্র ২৯ শতাংশ অর্থাৎ ১২টি রাজনেতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে মাত্র ১৮ শতাংশ ভোটার ভোট প্রদান করেছে। তাই এ নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে নাগরিকদের মনে প্রশ্ন রয়েছে।

বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ড়্গোভ প্রকাশ করে বলেন, গণতন্ত্রে আমরা কি আদৌ বিশ্বাস করি? গণতন্ত্র কি আমাদের সংস্কৃতির অংশ? আমরা গণতন্ত্রের অপব্যবহার করি। আমাদের মধ্যে পরমসহিষ্ণুতা নেই। প্রত্যেকটি মানুষকে দায়িত্বশীল হতে হবে এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসতে হবে।

অধ্যাপক আবু সায়ীদ বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্রে কোন দুর্বলতা নেই। দোষ গঠনতন্ত্রে নয়, দোষ রাজনীতিবিদদের। আমাদের গণতান্ত্রিক পরিসি’তি অত্যনত্ম দুর্বল ও নাজুক। আমাদের দেশে যে গণতন্ত্র রয়েছে তার ওপরে আমরা চড়াঁও হয়েছি। আমরা আজ দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কবলে পড়েছি।

মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, আমাদের সচেতর নাগরিকদের সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলসমূহ যাতে দুর্বৃত্তায়নমুক্ত সুস্থ গণতন্ত্রের চর্চা করে – এই দুটি বিষয়ে প্রচারাভিযান চালাতে হবে। নির্বাচনে জয়ী হতে পারলে তারা কোন কিছুর তোয়াক্কা করে না। তিনি মূল প্রবন্ধের সাথে একমত প্রকাশ করে বলেন, দেশে সত্যিই ‘winner takes all’ এই সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত রয়েছে।

Related Post

দিনবদলের সনদের অঙ্গীকার ও বাস্তবতাদিনবদলের সনদের অঙ্গীকার ও বাস্তবতা

ড. বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক (৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১১) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট সরকারের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। ‘দিনবদলের’ অঙ্গীকারের ভিত্তিতে সরকার ক্ষমতায় এসেছে। গত ৬

“প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা“প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা” শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা

গত ২২ মে, ২০০৭ সকাল ৯.৩০টায় ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর উদ্যোগে জাতীয় প্রেস ক্লাব-এর ভিআইপি লাউঞ্জে একটি গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। “প্রধান রাজনৈতিক দলুগগুলোর গঠনতন্ত্র পর্যালোচনা” শীর্ষক এই গোলটেবিল আলোচনায় মূল

‘সংবিধান সংশোধনে নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত‘সংবিধান সংশোধনে নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

গত ৪ আগস্ট, ২০১১ সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘সংবিধান সংশোধনে নাগরিক ভাবনা’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ‘সুজনে’র আয়োজনে ‘সুজন’ সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ