আইনের শাসন জোরদারে যা জরুরি

বদিউল আলম মজুমদার

সংবিধানের সপ্তম সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেওয়ার পর থেকে দেশে একটি নতুন বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিতর্কের বিষয় হলো, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের অভিযোগে জেনারেল এরশাদের বিচার করা যাবে কি-না। অনেক আইনজ্ঞ দাবি করছেন, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে জোর করে ক্ষমতা দখলকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা এবং আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এমন অপরাধের জন্য সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান করলে, এরশাদের বিচার করা সম্ভব। আবার অনেকে বলছেন, সংবিধানের এমন সংশোধন এবং এ ধরনের আইন পার করেও তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো সম্ভব হবে না। এসব আইন বিশারদ বিচারিক প্রক্রিয়ায় সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত বিধিনিষেধকে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করান।

আবার অনেক আইনজীবীর মতে, এরশাদের বিচার এখনই করা যাবে। সংবিধান সংশোধন এবং আইন প্রণয়ন না করেই। তাদের দাবি, প্রচলিত আইনেই, দণ্ডবিধির অধীনেই, অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। তারা মনে করেন, বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ১২৪ ও ১২৪ক ধারা ব্যবহার করে বর্তমান সময়েই এরশাদের বিচার করা সম্ভব।

সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'অপরাধের দায়যুক্ত কার্য সংঘটনকালে বলবৎ ছিল, এইরূপ আইন ভঙ্গ করিবার অপরাধ ব্যতীত কোনো ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করা যাইবে না।' অর্থাৎ এরশাদ অবৈধভবে ক্ষমতা দখল করেছেন ১৯৮২ সালে, তাই এখন সংবিধান সংশোধন এবং আইন প্রণয়ন করে অতীতের এ অপরাধের বিচার করা হবে সংবিধানের লঙ্ঘন। আপাতত যৌক্তিক বলে মনে হলেও, সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদের এ বিধিনিষেধ এরশাদের বেলায় প্রযোজ্য হবে বলে মনে হয় না।

সংবিধানের ৩৫(১) অনুচ্ছেদের এ বিধিনিষেধের প্রাসঙ্গিকতা নির্ভর করে অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধের জন্য শাস্তি সম্পর্কে পূর্ব সতর্কীকরণের ব্যবস্থা ছিল কি-না। এ প্রসঙ্গে মাহমুদুল ইসলাম তার ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হধষ খধ িড়ভ ইধহমষধফবংয (দ্বিতীয় সংস্করণ) গ্রন্থে গধৎশং া. ট.ঝ, ৪৩০ টঝ ১৮৮; ইবধুবষষ া. ঙযরড়, ২৬৯ টঝ ১৬৬ মামলার রায়ের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, 'ঞযব নধংরপ ঢ়ৎরহপরঢ়ষব রং ঃযধঃ ধ ঢ়বৎংড়হ যধং ধ ৎরমযঃ ঃড় ভধরৎ ধিৎহরহম ড়ভ ঃযধঃ পড়হফঁপঃ যিরপয মরাব ৎরংব ঃড় পৎরসরহধষ ঢ়বহধষঃরবং ধহফ ঃযবৎবভড়ৎব, ঃযব পৎরসরহধষ য়ঁধষরঃু ধঃঃৎরনঁঃধনষব ঃড় ধহ ধপঃ ংযধষষ হড়ঃ নব ধষঃবৎবফ, ধভঃবৎ ঃযব ভধপঃ, ঃড় ঃযব ফবঃৎরসবহঃ ড়ভ ঃযব ধপপঁংবফ.' (এক্ষেত্রে মৌলিক নীতি হলো, যে কোনো ব্যক্তির আচরণের জন্য ফৌজদারি আইনের অধীনে শাস্তিপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকলে, যা তার স্বার্থের পরিপন্থী_ সে সম্ভাবনা সম্পর্কে তার উপযুক্ত পূর্ব সতর্কবাণী পাওয়ার অধিকার রয়েছে')।

পরবর্তী আলোচনা থেকে এটি সুস্পষ্ট হবে যে, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল দণ্ডবিধির ১২৪ ও ১২৪ক ধারা অনুযায়ী যে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ সে সম্পর্কে জেনারেল এরশাদের কাছে পরিষ্কার পূর্ব সতর্কবাণী ছিল।
দণ্ডবিধির ১২৪ ও ১২৪ক ধারায় অবৈধ ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। দণ্ডবিধির ১২৪ ধারা অনুযায়ী, 'যে ব্যক্তি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বা সরকারকে, যে কোনো প্রণালীতে রাষ্ট্রপতির বা সরকারের যে কোনো আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগ করিবার জন্য বা প্রয়োগ করা হইতে বিরত করিবার জন্য প্রলুব্ধ বা বাধ্য করিবার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রপতিকে বা সরকারকে আক্রমণ করে বা অবৈধভাবে বাধাদান করে, কিংবা অবৈধভাবে বাধাদানের উদ্যোগ গ্রহণ করে অথবা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগ বা অপরাধমূলক বলপ্রয়োগের ভান করিয়া ভয়াভিভূত করার উদ্যোগ নেয়, সেই ব্যক্তি যে কোনো বর্ণনায় কারাদণ্ডে_ যাহার মেয়াদ সাত বৎসর পর্যন্ত হইতে পারে, দণ্ডিত হইবে তদুপরি অর্থ দণ্ডেও দণ্ডিত হইবে।' একইভাবে দণ্ডবিধির ১২৪ক ধারায় আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শাস্তির বিধান রয়েছে। অর্থাৎ বিচারপতি সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের কারণে এরশাদকে দেশদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত করে দণ্ডবিধির ১২৪ ও ১২৪ক ধারার অধীনে বিচার করা যায়। তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দণ্ডবিধিতে এসব বিধান থাকার কারণে অবৈধ দখলের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান সম্পর্কে এরশাদ আগে অবহিত ছিলেন।

এছাড়া এরশাদকে আর্মি অ্যাক্টেও বিচার করা যায় বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন। আনিসুল হকের মতে, আর্মি অ্যাক্টের ৩১ ধারার অধীনে বিদ্রোহ (সঁঃরহু) ও অবাধ্যতার (রহংঁনড়ৎফরহধঃরড়হ) অভিযোগে বিচার করা সম্ভব।
আমরা জানি না, এরশাদের বিচার আদৌ হবে কি-না। সপ্তম সংশোধনী বাতিল এবং তার ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করে আদালতের রায়ের পর অনেকেই এরশাদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। মহাজোটের বামপন্থি শরিকরাও তার বিচার ও শাস্তি দাবি করছেন। খোদ আওয়ামী লীগেরও একাংশ 'প্রতীকী' হলেও এরশাদের বিচার হওয়া উচিত বলে মনে করছেন (কালের কণ্ঠ, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০)। এমন দাবির মুখে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে সমাধানের কথা বলা হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে সমাধানের বিষয়টি আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। কারণ এরশাদের বিচারের সঙ্গে আইন প্রয়োগের বিষয় জড়িত এবং এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, অর্থাৎ আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। তবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাম্প্রতিক সাক্ষাতের পর এরশাদ নাকি বলে বেড়াচ্ছেন, তাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে না (প্রথম আলো, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১০)।

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এরশাদের বিচারের ব্যাপারে আশাবাদী হওয়া দুরূহ। স্মরণ করা যেতে পারে, নব্বইয়ের তিন জোটের রূপরেখায় এরশাদের দলকে ভবিষ্যতে সঙ্গে নেওয়ার বিপক্ষে সংশ্লিষ্ট দলগুলোর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল। আমাদের প্রধান দলগুলো এ অঙ্গীকার রক্ষা করেনি; বরং তারা এরশাদকে নিয়ে অতীতে অনেক অনৈতিক খেলা খেলেছেন। উদাহরণস্বরূপ, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অর্থের বিনিময়ে তাকে নিজেদের জোটে ভেড়ানোর এক অশুভ প্রতিযোগিতায় দল দুটি লিপ্ত হয়েছিল। তাই এরশাদের বিচার না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে অনেকে মনে করেন। তবে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে এরশাদ শাস্তি এড়াতে পারলে ভবিষ্যতে এ ধরনের 'অ্যাডভেঞ্চারিজম' বা দুঃসাহসিকতা উৎসাহিত হবে বলেই অনেকের আশঙ্কা। সংবিধান সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধানও তা রোধ করতে পারবে কি-না সে ব্যাপারে অনেকেই সন্দিহান।

অনেকেই মনে করেন, দেশে আইনের শাসন কায়েম করার স্বার্থে এরশাদের বিচার হওয়া জরুরি। কারণ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শুধু আইনের বইতে আইন থাকলে কিংবা সংবিধান সংশোধন করে নতুন বিধান সংযোজন করলেই হবে না, এগুলোর প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, বাংলাদেশে অনেক বিষয়েই অনেক আইন আছে, কিন্তু এগুলোর প্রয়োগ নেই। তাই স্বাধীনতার প্রায় ৪০ বছর পরও আমাদের দেশে আইনের শাসন অর্জিত হয়নি, যার ফলে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও কার্যকারিতা লাভ করেনি। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গণতান্ত্রিক শাসনের সঙ্গে আইনের শাসনের গভীর যোগসূত্র রয়েছে। দিনবদলের স্বার্থে এখন সময় এসেছে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো।

আর বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো মানেই শাস্তি হওয়া নয়। বিচারের সম্মুখীন হওয়ার অর্থ অভিযোগ খণ্ডানোর সুযোগ পাওয়া। একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশে কেউই আইনের ঊধর্ে্ব নয়। তাই নৈতিকতার দিক থেকেও অবৈধ ক্ষমতা দখলের অভিযোগে এরশাদের বিচার এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এছাড়াও বিচারের ব্যবস্থা করে এরশাদকে নির্দোষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করার সুযোগই সৃষ্টি করে দেওয়া হবে।
৮ সেপ্টেম্বর ২০১০

ড. বদিউল আলম মজুমদার : সম্পাদক সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক

সূত্র: সমকাল, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১০

Related Post

উন্মোচিত হলো বিরাট সম্ভাবনার দ্বারউন্মোচিত হলো বিরাট সম্ভাবনার দ্বার

মন্তব্য প্রতিবেদন ড. বদিউল আলম মজুমদার ১৯৮৫ ও ১৯৯০ সালের পর তৃতীয়বারের মতো আজ উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার ব্যাপারে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কারণ

রাজনীতি: সংসদীয় কমিটি বনাম সাবেক স্পিকাররাজনীতি: সংসদীয় কমিটি বনাম সাবেক স্পিকার

বদিউল আলম মজুমদার নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে সাবেক স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, সাবেক ডেপুটি স্পিকার আখতার হামিদ সিদ্দিকী ও সরকারি দলের সাবেক চিফ হুইপ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির