আসন্ন নির্বাচন ও নাগরিক প্রত্যাশা


ড. বদিউল আলম মজুমদার
জাতীয় সংসদ ও উপজেলা নির্বাচন আসন্ন। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী ১৮ ডিসেম্বর সংসদ এবং ২৪ ও ২৮ ডিসেম্বর উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অব্যাহত রাখতে হলে নির্ধারিত তারিখে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। অন্যথায় জাতি হিসেবে আমরা আরো বৃহত্তর সংকটে নিপতিত হবো। তাই আমাদের আন্তরিক আকাঙৰা যে, সংশ্লিষ্ট সকলে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন এবং ঘোষণামতো নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তাদের করণীয় করবেন।

সৎ ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থী চাই
আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে নাগরিক হিসেবে আমাদের প্রত্যাশা – নির্বাচনে সৎ, যোগ্য ও জনকল্যাণে নিবেদিত প্রার্থীরা মনোনীত হোক এবং তারা নির্বাচিত হবার সুযোগ পাক। আরো স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, নাগরিক হিসেবে আমরা সন্ত্রাসের গডফাদার, কালোবাজারি, কালো টাকার মালিক, দুর্নীতিবাজ, স্বার্থান্বেষী, প্রতারক, দখলদার, নারী নির্যাতনকারী, যুদ্ধাপরাধী, উগ্রবাদী, ধর্ম ব্যবসায়ী, দলবাজ ও ফায়দাবাজদেরকে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে দেখতে চাই না। আশা করা যায় যে, এ সকল ব্যক্তিরা নির্বাচনী অঙ্গন থেকে বিদায় নিলে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি গুণগত পরিবর্তন ঘটবে এবং আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুসংহত হওয়ার পথ সুগম হবে।

বস্তুত, আমাদের আশংকা যে, সৎ, দক্ষ ও নিবেদিত ব্যক্তি তথা সজ্জনরা নির্বাচিত না হলে আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চরম ঝুঁকির সম্মুখিন হবে। এমনকি রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎও হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়াও দুর্বৃত্তরা নির্বাচিত হলে সমাজে দারিদ্র্য ও সাধারণ মানুষের প্রতি বঞ্চনা স্থায়ীরূপ লাভ করবে।
সজ্জনরা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ না পাওয়া আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য চরম ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। উৎসবের আমেজে প্রতি পাঁচ বছর পর পর ট্রান্সপারেন্ট ব্যালট বক্সে ভোট প্রদানও গণতন্ত্র নয়। নিরাপত্তা বাহিনী পরিবেষ্টিত হয়ে অবাধে তা প্রদানের অধিকারকেও গণতন্ত্র বলা যায় না।
বস্তুত নির্বাচন গণতান্ত্রিক যাত্রাপথের সূচনা মাত্র। দুই নির্বাচনের মাঝখানে ক্ষমতাসীনরা কী-করেন, না-করেন তার ওপরই নির্ভর করে গণতন্ত্র কায়েম হওয়া। নির্বাচিতরা যদি ক্ষমতার অপব্যবহার না করেন, সততা-স্বচ্ছতা-সমতা-ন্যায়পরায়ণতা ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে কাজ করেন, জনমত-মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, শাসন প্রক্রিয়ায় জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন এবং ব্যক্তি ও কোটারি স্বার্থের পরিবর্তে সমষ্টির স্বার্থ সমুন্নত রাখেন, তাহলেই গণতন্ত্র ও সুশাসন কায়েম হবে। কিন্তু আমাদের আশংকা যে, দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হলে, তারা গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি মেনে চলবেন না এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শাসনকার্যও পরিচালনা করবেন না। ফলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বে, যা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি। কারণ গণতন্ত্র কায়েম করতে হলে অন্যের, বিশেষত প্রতিপক্ষের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে অনুসৃত একটি অলিখিত আচরণবিধি মেনে চলতে হবে।
বিতর্কিত ব্যক্তিরা নির্বাচিত হলে তা রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধিরা যদি দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ন থেকে নিজেদের দূরে রাখতে না পারেন, তাহলে ইজারাতন্ত্র – অর্থাৎ লুটপাটের নিরঙ্কুশ অধিকার – আবারো প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আর এই ইজারাকে স্থায়ী করার জন্য অতীতের ন্যায় তারা পাতানো নির্বাচনের আয়োজন করতে, সকল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে তুলতে এবং পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আবারো অকার্যকর করে ফেলতে পারেন। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এমনি পরিস্থিতিতেই দ্বন্দ্ব, হানাহানি ও বিশৃঙখলতা সৃষ্টি হয় এবং উগ্রবাদের বিস্তার ঘটে ও রাষ্ট্রের কার্যকারিতাই দুর্বল হয়ে পড়ে। অতীতে এমনই ঘটেছিল এবং ভবিষ্যতে তা আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে অনেকের আশংকা।
এছাড়াও দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের ফলে সৃষ্ট অপশাসন গরিব মানুষদেরই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং তাদের প্রতি বঞ্চনা ও বৈষম্য আরো ভয়াবহ রূপ নেয়। ফলে ব্যাহত হয় দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রযাত্রা। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়া ১০০ ডলার মাথাপিছু আয় নিয়ে অর্থনৈতিকভাবে প্রায় একই অবস্থায় ছিল। গত ৩৭ বছরে বাংলাদেশের মাথপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ৬ গুণ, পক্ষান্তরে দক্ষিণ কোরিয়ার বেড়েছে প্রায় ২০০ গুণ। প্রায় প্রাকৃতিক সম্পদবিহীন কোরিয়ার তুলনায় উর্বর মাটি, মিষ্টি পানি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত বাংলাদেশেরই অনেক বেশি দ্রম্নতহারে উন্নত হওয়ার কথা ছিল! একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গত ৩৭ বছরে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর ব্যক্তি, যাদের অধিকাংশের বিরুদ্ধে লুটপাটের গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হলেও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি, তাদের অনেকের এখনও নুন আনতে পান্তা ফুরায়। বলা বাহুল্য যে, এমনি পরিস্থিতিই উগ্রবাদের অতীতের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।
সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত চারটি সিটি করপোরেশন ও নয়টি পৌরসভা নির্বাচনে আমাদের অভিজ্ঞতা ইতিবাচক নয়। এ সকল নির্বাচনের পূর্বে সজ্জনের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হলেও, বাস্তবে ‘ভাল মানুষরা’ উল্লেখযোগ্য হারে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামেননি এবং অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। নির্বাচিতদের অনেকে কারাগারে ছিলেন, অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগে বহু মামলা রয়েছে, যদিও মামলা থাকা ও দোষী সাব্যস্ত হওয়া এক কথা নয়। যেমন, নয় জন নির্বাচিত সিটি ও পৌর মেয়রের বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন এবং তাদের কেউ কেউ আরো মামলা গোপন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের অনেকে আয়কর পরিশোধ করেন না এবং আয়কর রিটার্নে প্রদত্ত তাদের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কিত তথ্য (যেমন, মাসিক বিদ্যুৎ ও টেলিফোন বিল, মাসিক পারিবারিক খরচ ইত্যাদি) অবিশ্বাস্য রকমের কম। এছাড়াও নির্বাচিতদের অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অল্প, যদিও অল্প প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা নিরক্ষরতা কোনভাবেই অযোগ্যতা নয়। উপরন্তু, নির্বাচিত মেয়র ও সাধারণ আসনের কাউন্সিলরদের ৮০ শতাংশের অধিক ব্যবসা তাদের পেশা বলে হলফনামায় দাবি করেছেন। ব্যবসায়ীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে অবশ্য কোন দোষ নেই, তবে সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় যখন রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে তারা ব্যবসায়ী হন। তাই এ কথা বলা যায় যে, গত আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত সিটি ও পৌর নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গুণগত মানে তেমন কোন পরিবর্তন ঘটেনি।
বিতর্কিত ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়ার পেছনে সম্ভাব্য অনেক কারণ রয়েছে। একটি কারণ হলো, ১১ জানুয়ারি, ২০০৭ তারিখের পর অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের এবং তাদের অনেককে কারাগারে অন্তরীণ করা হলেও, আমাদের রাজনীতিতে দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে কোনরূপ গণপ্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি। অনেকেই ১১ জানুয়ারির পূর্বাবস্থায় – অর্থাৎ রাজনৈতিক হানাহানিতে – ফিরে না যাওয়ার কথা বললেও, হানাহানির মূল কারণ, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে তেমন সোচ্চার হননি। ফলে কলুষিত রাজনীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠেনি এবং অভিযুক্তরা সামাজিকভাবে ধিকৃতও হননি। এর অন্যতম কারণ অবশ্য দেশের জনমত সৃষ্টিকারী ব্যক্তিবর্গের অধিকাংশের দলীয় আনুগত্য এবং দলবাজির ঊধের্ব উঠতে না পারা। এদের অনেকে দলীয় পক্ষপাতিত্বই শুধু প্রদর্শন করেননি, তারা পরিবর্তনকামীদের রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর অপচেষ্টায়ও লিপ্ত হয়েছেন। এ সকল কারণেই দুর্বৃত্তদের মধ্যে কোন অনুশোচনা বা লজ্জাবোধ সৃষ্টি হয়নি, যা তাদেরকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত রাখতে পারতো। অর্থাৎ, ১১ জানুয়ারি ২০০৭ তারিখের ঘটনার পর বড় বড় কিছু নেতা-নেত্রীদেরকে, যাদেরকে কোনভাবে স্পর্শ করা যাবে না বলে অনেকের ধারণা ছিল, কারাগারে অন্তরীণ করার মত চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটলেও, জাতির মানসিকতায় তেমন পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে পরবর্তীতে অভিযুক্তদের অনেককে, এমনকি তাদের কিংপিনদের বা মূল হোতাদেরকেও মুক্তি দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকারের অনেক অনৈতিক পদক্ষেপও, যা তাদেরকে ক্রমাগতভাবে দুর্বল করেছে, বর্তমান অবস্থার জন্য বহুলাংশে দায়ী।
এছাড়া আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিও এমন পর্যায়ে পৌঁছেনি যে, কোনরূপ গর্হিত কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকার সুস্পষ্ট অভিযোগে অভিযুক্তরা স্বেচ্ছায় জনপ্রতিনিধিত্বমূলক বা অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন এবং নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেন। আর বিতর্কিত ব্যক্তিরা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ফলে অনেক সৎ ও যোগ্য প্রার্থী এগিয়ে আসেননি। অর্থাৎ সাম্প্রতিক নির্বাচনে ‘গ্রাসামস্‌ ল’ কাজ করেছে – ‘খারাপ’ প্রার্থীরা ‘ভাল’ প্রার্থীদেরকে নির্বাচনী ময়দান থেকে বিতাড়িত করেছে।
সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোও বিতর্কিত প্রার্থীদেরকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে পারেনি। যেমন, সরকার অনেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের মামলা করেছে, কিন্তু এ সকল মামলাগুলো নিষপত্তি করতে পারেনি। অনেকের মতে, এক্ষেত্রে বিচার বিভাগের ভূমিকাও চরমভাবে বিতর্কিত। নির্বাচন কমিশনও মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করতে পারেনি এবং হলফনামায় অসত্য তথ্য দেয়ার কিংবা তথ্য গোপন করার জন্য মনোনয়নপত্র বাতিল করেনি। এছাড়াও কমিশন হলফনামা ও আয়কর রিটার্নের কপি প্রকাশের ব্যাপারে গাফিলতি করেছে। যেমন, আমরা ‘সুজনে’র পক্ষ থেকে বহু কাঠখড় পোড়ানোর পর মাত্র নির্বাচনের আগের দিন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের রিটার্নিং অফিসারের কাছ থেকে প্রার্থীদের আয়কর রিটার্নের তথ্য পাই, তাও সে তথ্য ছিল আংশিক। ফলে তথ্যগুলো গণমাধ্যম ও ভোটারদের কাছে যথাসময়ে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এছাড়াও ‘সুজন’ ব্যতীত অন্য কোন সংগঠন প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ধারাবাহিকভাবে এগুলো বিতরণের এবং এর মাধ্যমে ভোটার সচেতনতা সৃষ্টির কোনরূপ উদ্যোগ নেয়নি। গণমাধ্যমের জন্যও ছিল এটি প্রথম অভিজ্ঞতা, তাই তাদের পক্ষেও গভীর অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরি করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভবপর হয়নি।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক দলের ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। তারা দুর্নীতিবাজ ও দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কোনরূপ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। বরং তারা দুর্বৃত্তায়নের অভিযোগে কারারুদ্ধ ব্যক্তিদেরকেও মনোনয়ন ও সমর্থন প্রদান করেছে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, রাজনৈতিক দলের উদ্যোগী ভূমিকা ছাড়া রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করা অসম্ভব।
বিতর্কিত ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়ার পেছনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় কারণ আমাদের বিদ্যমান সামন্তবাদী সংস্কৃতি। সামন্তবাদী সংস্কৃতির কারণে আমাদের দেশে বর্তমানে একটি পেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে, যা রাজতন্ত্রের অধীনে রাজা-প্রজার সম্পর্কের সমতুল্য। স্বাধীন রাষ্ট্রের ‘নাগরিক’ হিসেবে জনগণ রাষ্ট্রের মালিক এবং সংবিধান অনুযায়ী সকল ৰমতার উৎস। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত স্বাধীনতার ৩৭ বছর পরও দেশের অধিকাংশ জনগণ, বিশেষত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের ‘মালিকে’ পরিণত হতে পারেনি – তারা এখনও প্রভুতুল্য শাসকদের করুণার পাত্রই রয়ে গিয়েছে। ফলে যে সকল নাগরিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা তাদের স্বাভাবিকভাবে প্রাপ্য, তা তারা পায় না। তাদের ন্যায্য অধিকারগুলো অর্জনের জন্য তাদের পেট্রনদের আশ্রয় নিতে হয়। বস্তুত, পেট্রন বা পৃষ্ঠপোষকদের কৃপা বা অনুগ্রহের কারণেই তারা বিভিন্ন ধরনের বৈধ-অবৈধ সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, পৃষ্ঠপোষকরা তাদেরকে নিরাপত্তাও প্রদান করে থাকে এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের হয়রানি থেকে রক্ষা করে। অনেকের কাছেই তারা হয়ে পড়েছেন আপদে-বিপদে সাহায্যকারী ‘আপনজন’। এভাবে বিভিন্ন ধরনের ফায়দা দেয়ার মাধ্যমে আমাদের দেশে রাজনীতিবিদরা ও তাদের মাস্তানরা পরিণত হয়েছেন নব্য প্রভুতে। আবার তারা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে প্রতিপক্ষকে হয়রানিও করে। নির্বাচনের সময় সাধারণ মানুষ নিজ স্বার্থের বিবেচনায় ‘যৌক্তিকভাবেই’ সে সকল রাজনীতিবিদ বা পেট্রনদেরই ভোট দেয় যারা তাদেরকে বেশি সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা প্রদান করে, যদিও রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে তাদের এ সিদ্ধান্ত জাতীয় স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে প্রার্থীদের সততা ও যোগ্যতার বিবেচনা সাধারণ ভোটারদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। সদ্যসমাপ্ত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনেও তাই হয়েছে – ভোটাররা ফায়দা প্রদানকারী তাদের নব্য প্রভুদেরকেই ভোট দিয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্ত)
[লেখক : সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক]
তথ্য সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ অক্টোবর ২০০৮

Related Post

সংসদ সদস্য আচরণ আইনের অপরিহার্যতাসংসদ সদস্য আচরণ আইনের অপরিহার্যতা

ড. বদিউল আলম মজুমদার আইনসভা বা সংসদ সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। আর সংসদীয় গণতন্ত্রের চরিত্র ও গুণগত মান নির্ভর করে সংসদ সদস্যদের নিজেদের গুণ, মান ও আচরণের ওপর। একইভাবে সংসদের মর্যাদা

স্থানীয় উন্নয়ন: কেন এই অর্বাচীন সিদ্ধান্ত?স্থানীয় উন্নয়ন: কেন এই অর্বাচীন সিদ্ধান্ত?

বদিউল আলম মজুমদার | তারিখ: ১৩-০২-২০১০ শোনা যায়, সরকার সংসদ সদস্যদের প্রত্যেককে তাঁদের মেয়াদকালের জন্য স্থানীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংসদ সদস্যরা এ টাকার পরিমাণ

সংলাপ ।। সমঝোতা ও কাঙিক্ষত পরিবর্তনসংলাপ ।। সমঝোতা ও কাঙিক্ষত পরিবর্তন

ড. বদিউল আলম মজুমদার বিখ্যাত বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন বলেছিলেন: “It is not the strongest species that survived, nor the most intelligent, but the ones most responsive to change.“ (প্রাণীকূলে সবচেয়ে